হযরত শাহজালাল (রহ.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। তিনি ছিলেন ওলিকুল শিরোমণি। ১৪ শতাব্দীতে যে সকল অলি-আউলিয়ারা বর্তমান বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন তাদের একজন হলেন হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)।  ভারত উপমহাদেশে খাজা মইনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর পরে এই ভূ-খণ্ডে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)। বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী, তিনি সুলতানে বাংলা, হযরত মাওলানা শাহজালাল মুজারদ ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।  এতদঞ্চল ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম্য ব্যাপক ও অতুলনীয়। সিলেটের মানুষের কাছে হযরত শাহজালালের মাজার শরিফ একটি ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান। এর সাথে সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি জড়িত। হযরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর সফরসঙ্গি ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি অভিধায়ও অভিহিত করেন। হযরত শাহজালালের দরগাহ শরিফ শুধু সিলেটের মানুষের কাছেই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষরা ছুটে আসেন মহান এ অলির দরগাহে। মাজার জিয়ারতের পাশাপাশি ঘুরে দেখেন ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শন। নিদর্শন সমূহের মধ্যে রয়েছে- হযরত শাহজালাল (রহ.) এর ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি, চিল্লাখানা, পুকুরের গজার মাছ, জালালি কবুতর, ঝর্নাধারা।

কিন্তু কিছু অলি-আউলিয়া বিদ্বেশী পবিত্র এই দরগাহ শরিফ নিয়ে যুগে যুগে নানা যড়যন্ত্র করে আসছে। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শাহজালাল (রহ.) দরগা চত্ত¡রের উত্তর দিকে পুকুরের ৭শ’ গজার মাছ বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয়। সেদিন সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে রক্তক্ষরণ হয়েছিলো। এর এক বছর পর ২০০৪ সালের ২১ মে হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী মাজার জিয়ারতে আসলে তাঁর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন।  আহত হয়েছিলেন আনোয়ার চৌধুরী, সিলেটের জেলা প্রশাসক আবুল হোসেনসহ আরো ৭০ জন। আজ অবদি জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে দেশের প্রধান দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেন।  পাক-পবিত্র স্থান হিসেবেই ধর্মীয় ভাবগাম্বির্যের সাথে এমন প্রচারণার শুরু পূণ্যভূমি সিলেট থেকে হয়ে থাকলেও অলি বিদ্বেষীরা মাজার জিয়ারতকে ‘মাজার পূজা’ বলেও মন্তব্য করেছেন। নানা অপপ্রচার চালিয়ে মাজার গুড়িয়ে দেওয়ার মতো অনেকে হুংকার ছেড়েছেন। কিন্তু সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষের কঠোর মনোভাব বুঝে এরা নিভৃত হয়েছেন। তারপরও যেনো শাহজালালের মাজার নিয়ে ষড়যন্ত্র থামতে চাইছে না। এমনটাই মনে করছেন দরগাহ কর্তৃপক্ষ।

রবিবার সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে শাহজালাল (রহ.) মাজারে প্রতারণার অভিযোগ এনে একটি সিআর মামলা দায়ের করেছেন কদমতলি দরিয়াশাহ মাজার রোডের এম এ কুদ্দুস ভিলার বাসিন্দা এইচ এম আব্দুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন- ১০ অক্টোবর বিকেলে মাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ঝরনার পারে মক্কার ‘পবিত্র জমজম কুপের পানি’ বিক্রি করা হচ্ছে।  তিনি সরল বিশ্বাসে ৫০ টাকা দিয়ে দুই বোতল পানি কিনে নিয়ে যান। কিন্তু ৩১ অক্টোবর ‘একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে তিনি জানতে পারেন ‘গভীর নলকুপের মাধ্যমে পাম্পের সাহায্যে তোলা পানিকে জমজমের পানি বলে প্রচার ও বিক্রি করা হচ্ছে।’ যে কারণে তিনি কোন ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, তার জন্য তিনি অভিযোগটি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দানে আবেদন করেন। অভিযোগে তিনি শাহিন ও আব্দুছ ছত্তার নামে অজ্ঞাত দুইজনের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের কোন পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। এর আলোকে আগামী ৩০ নভেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজিকে তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে দরগাহ কর্তৃপক্ষ জানান- হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ শরীফ  সকল ধর্মানুরাগীর একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে দেশি-বিদেশি আশেক, ভক্ত, অনুরক্ত দর্শনার্থী-পর্যটক এর সমাগম হয়, ধর্ম, বর্ণ তথা সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে সুলতানুল আওলীয়ার এ দরগাহ শরীফের রয়েছে আলাদা কদর। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ সরকারে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ সিলেটে এসে সর্বপ্রথম শাহ জালাল (রহ.) মাজার জিয়ারত করে পরবর্তী কার্যক্রমে অংশ নেন। তাছাড়া  দেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানরা এ মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে থাকেন।

অথচ এ পবিত্র দরগাহ নিয়ে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র অতীতকাল থেকে  ষড়যন্ত্র করে আসছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়া একটি রিপোর্ট ও সর্বশেষ কোর্টে মামলা নিয়ে মাজার ভক্তদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র উত্তেজনা। টিভি চ্যানেলে রিপোর্ট ও তারই সাথে সাথে আদালতে মামলা এ দুয়ের মধ্যে রাজনৈতিক যোগসূত্রতার আলামত দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে মাজার ভক্তদের অভিযোগ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সব সময়ই ধর্ম ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করার তৎপরতায় লিপ্ত। তাঁরা বলেন- মামলার বাদীর রাজনৈতিক পরিচয় সামনে নিয়ে এলে এর পেছনের রহস্য উদঘাটন হয়ে যাবে। দরগাহ নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে দরাগাহে হযরত শাহ জালাল (রহ.)’র খাদেম ও সেক্রেটারী সামুন মাহমুদ খাঁন উত্তরপূর্বকে বলেন- এ মামলা গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস। এর আগেও ষড়যন্ত্র হয়েছে। তিনি বলেন- মাজারের পক্ষ থেকে জমজমের পানি বলে বিক্রির যে অভিযোগ তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।  এখানে এ ধরণের কিছু করা হচ্ছে না। স্বতন্ত্রভাবে মাজারে আগত ভক্তদের চাহিদা পূরণে কেউ কেউ বোতল নিয়ে পানি নিয়ে যাচ্ছেন।

তাছাড়া এ কুয়ার সাথে জমজমের পানির যোগসুত্র রয়েছে বলে আমাদের কোন প্রচারণা নেই। অনেকেই ভক্তিভরে পানি নিয়ে থাকেন। তিনি আরো বলেন- টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদনে কুয়ার সংস্কার নিয়ে ও মিথ্যাচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে ২০০৫ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান কুয়া সংস্কার করেছিলেন। তা সঠিক নয়, প্রকৃত সত্য হলো ২০০৯ সালে কুয়া সংস্কার করা হয়েছে। এমন অপ্রচারের বিরুদ্ধে তিনি সকলকে সজাগ হওয়ার আহবান জানান।এদিকে অভিযোগকারী আব্দুর রহমান জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। তার ভাই আব্দুল করিম শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। আরেক ভাই আব্দুর রহিম কানাইঘাট উপজেলা জামায়াত নেতা। গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন।  মূলত জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িতরা অলি-আউলিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার করে আসছেন। এমন কী দলের শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধী মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদরাসার মাঠে একটি মাহফিলে প্রকাশ্যে শাহজালালের মাজার নিয়ে কটুক্তি করেন। প্রতিক্রিয়াশীল এই গোষ্ঠি সবসময় শাহজালালের মাজার নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলেও মন্তব্য করেন দরগাহ কর্তৃপক্ষ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn