ভোটাররা মাত্র একদিনের বাদশা : আকবর আলি
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। দেশে-দেশে ভোট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসব দেশে আনুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু নেই, সেসব দেশে সংখ্যালঘু ভোট পেয়েও দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করছে নির্বাচিতরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান ‘অবাক বাংলাদেশ, বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইতে ভোটের মারপ্যাঁচের খেল নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমা প্রকাশিত বইতে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন নির্বাচনের সবচেয়ে বেশি ভোটপ্রাপ্ত দলকে নির্বাচিত করা হয়, সেখানে শাসন ব্যবস্থা কতটুকু গণতান্ত্রিক তাও পরীক্ষা করা হয়েছে। লেখার শুরুতে প্রস্তাবনায় আকবর আলি খান লিখেছেন- বৃটিশ নাট্যকার টম স্টপার সুন্দরভাবে বলেছেন, It is not the voting that is democracy, it is the counting শুধু ভোটের ব্যবস্থা থাকলেই গণতন্ত্র হয় না।
ভোট কিভাবে হিসাব করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করে ভোটের ফলাফল। যোসেফ স্ট্যালিন তাই বলেছেন, The people who cast the vote decide nothing, the people who count the vote decide everything. যারা ভোট পরিচালনা করেন, তাদের কাজ শুধু জালভোট প্রত্যাখ্যান করাই নয়, তাদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ভোট গণনার সঠিক পদ্ধতি নিরূপণ।গণতন্ত্রের ধারণাটি অত্যন্ত সহজ কিন্তু অনেক সময় এর বাস্তবায়ন সহজ নয়। তত্ত্ব অনুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। ধরুন, একটি দেশে ১০টি দল রয়েছে। ১০টি দলই প্রায় সমান জনপ্রিয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটি ১১ শতাংশ ভোট পায় আর বাকি ৯টি দল মিলে ৮৯ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পায়। সবচেয়ে বেশি ভোট যে দল পায়, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হলে যে দলটি ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তাকেই নির্বাচিত বলে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। অবশ্যই এ দলটি অন্য ৯টি দলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। কিন্তু দেশের ৮৯ শতাংশ ভোটার এ দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এ পরিস্থিতিতে যে দল বেশি ভোট পায়, তাকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে,
সে সম্পর্কে ৮টি সূত্রের তালিকা প্রণয়ন করেছেন:
১. সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধি (Majority rule): এই সূত্র অনুসারে যে ব্যক্তি ৫০ শতাংশের একটি ভোট বেশি পাবেন, তাকেই নির্বাচিত করা হবে।
২. উপর্যুপরি ব্যর্থ নির্বাচনের পর চূড়ান্ত পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থী নির্বাচন (Majority rule, run off election): যদি কোনো প্রার্থী প্রথম নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তাহলে যে প্রার্থী নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন, তাকে বাদ দিয়ে আবার নির্বাচন হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে যারা সবচেয়ে কম ভোট পান, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন চলতে থাকবে। এক পর্যায়ে যখন মাত্র দু’জন প্রার্থী থাকবেন, তখন অবশ্যই একজন প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন।
৩. সবচেয়ে বেশি ভোট (Plurality rule): যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন (তা ৫০ শতাংশের অনেক কম হলেও), তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে এবং তার ওপর দেশের শাসনভার দেয়া হবে।
৪. কনডরসেট নিয়ম (ঈড়হফবৎপবঃ বৎরঃবৎড়হ): দুইয়ের অধিক প্রার্থী হলে প্রতি দু’জন প্রার্থী নিয়ে একটি জোড়া তৈরি করতে হবে এবং প্রতিটি জোড়ায় আলাদা করে ভোট নেয়া হবে। যে ব্যক্তি এই ধরনের নির্বাচনে সব প্রার্থীকে পরাজিত করবেন, তাকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
৫. হেয়ার ব্যবস্থা (The Hare system): ভোটাররা প্রত্যেক প্রার্থীর মান অনুসারে নম্বর দেবেন। যিনি সবচেয়ে কম নম্বর পাবেন, তাকে প্রথমে বাদ দেয়া হবে এবং আবার নির্বাচন করে যিনি সবচেয়ে কম নম্বর পাবেন, তাকে বাদ দেয়া হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থীর সংখ্যা দুই না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের বাছাই নির্বাচন চলবে। দু’জন প্রার্থী যখন হবেন, তখন তাদের মধ্যে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাবেন, তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
৬. কুম্বস ব্যবস্থা (The Coombs system): প্রত্যেক ভোটার প্রার্থীদের মধ্যে যাকে সবচেয়ে অযোগ্য মনে করেন, তাকে চিহ্নিত করেন। যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোটারদের দ্বারা অযোগ্য বিবেচিত হবেন, তার নাম বাদ দেয়া হবে। একই পদ্ধতিতে আবার নির্বাচন হবে ও সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রার্থীকে বাদ দেয়া হবে। এভাবে বাদ দিতে দিতে যে প্রার্থী শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন, তাকে নির্বাচিত করা হবে।
৭. অনুমোদন ভোট (Approval voting): প্রত্যেক ভোটার সবচেয়ে পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেবেন। যিনি সবচেয়ে বেশি সর্বোচ্চ পর্যায়ের পছন্দের ভোট পাবেন, তাকেই নির্বাচিত করা হবে।
৮. বরদা গণনা পদ্ধতি (The Borda Count): ভোটাররা প্রত্যেক প্রার্থীর স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করবেন। যে প্রার্থী মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
উপরে উল্লিখিত প্রতিটি পদ্ধতিরই দুর্বলতা ও সবলতা রয়েছে। বাস্তবে এদের প্রয়োগের সময়ে দুটি বিষয় দেখতে হয়। (১) নির্বাচন সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে ও (২) নির্বাচনে কত ব্যয় হবে। ফ্রান্সসহ কিছু দেশে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে ফ্রান্সে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কয়েক পর্যায়ে হতে পারে। তবে সংসদীয় ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে, সেখানে উপরের সূত্রগুলোর বেশির ভাগের প্রয়োগ সম্ভব নয়। যদি প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য বারবার ভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হয়, তবে তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে অথবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী কলেজ ব্যবস্থা (যাতে কলেজের সদস্যরা সংসদ সদস্যদের মতো নির্বাচিত হন) রয়েছে, সেখানে মূলত দুই ধরনের পদ্ধতি দেখা যায়। একটি হলো যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান (তার প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ যত কমই হোক না কেন), তাকে নির্বাচিত করা। আরেকটি পদ্ধতি হলো আনুপাতিক হারে নির্বাচন। আনুপাতিক ব্যবস্থাতে প্রতি দল যে পরিমাণ ভোট পায়, সে পরিমাণ আসন তারা পায়। এর ফলে সরকার পরিচালনা করতে হলে ৫০ শতাংশের বেশি ভোটারদের প্রতিনিধিদের একত্র করতে হবে। যেসব দেশে আনুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু নেই, সেসব দেশে সংখ্যালঘু ভোট পেয়েও দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশের শাসন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, তারা পুরো মেয়াদে দেশ শাসন করে। একবার নির্বাচিত হলে চার-পাঁচ বছর (যা মেয়াদকাল) ভোটাররা কী ভাবছেন, সেটার তোয়াক্কা না করে দেশ শাসন সম্ভব। এ ধরনের পদ্ধতিতে ভোটাররা রাষ্ট্রের মালিক নন, তারা মাত্র একদিনের বাদশা। নির্বাচনের দিন ছাড়া ভোটারদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো ভূমিকা থাকে না। অবশ্য এ ধরনের ব্যবস্থা মোকাবিলা করার জন্য কোনো কোনো রাষ্ট্রে গণভোট বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।