পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বাবা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই ভাই ও দুই চাচা খালাস পাবেন বলে আশা করেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। নিজ খরচেই দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে পরিবারের পাঁচ সদস্যের সাজা বহাল রয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই একই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তার মা। জান্নাতুল ফেরদৌসের চোখে তাই কেবলই অশ্রু। সোমবার (২৭ নভেম্বর) পিলখানা হত্যাকাণ্ডে হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে দেখা যায় অশ্রুসজল জান্নাতুল ফেরদৌসকে। সেই অবস্থাতেই তার সঙ্গে কথা হয়। জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের দিন আমরা বাসাতেই ছিলাম। বাবা-মা ও ভাবিদের নিয়ে আমরা পিলখানার রেজিমেন্ট কোয়ার্টারের পাঁচ তলায় থাকতাম। ৪৪ ব্যাটালিয়নের সঙ্গেই ছিল বাসা। আমার বড় ভাই সিপাহি আলামিন নাইক্ষ্যংছড়ি ১৫ নাম্বার ব্যাটালিয়নে ছিল। ছোট ভাই ফয়সাল ছিল সুনামগঞ্জের ১০ নম্বর ব্যাটালিয়নে। প্যারেডে অংশ নিতে তারাও তখন পিলখানায়। সকালে পরিবারের সবাইকে নিয়েই আমরা নাস্তা করি।’ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমার এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। বাবা (সুবেদার মেজর জাকির হোসেন জামাল) ছিলেন এলপিআরে। সেদিন (২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৭টায় ব্যাংকের কাজে বাবা সাভার যান। আমি সকাল ৯টার পর স্কুলে যাওয়া পথে দেখি পিলখানায় গণ্ডগোল চলছে। আমি আব্বুকে ফোন করে সেই খবর জানাই। আব্বু বলে, তোর এটা জানার দরকার নেই। আমি এরপর স্কুলের দিকে যেতে থাকি।’
সেদিন মাকে হারিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। সেই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মা নার্গিস ফাতেমা পিলখানায় বিডিআর হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মৃত্যু হয় তার। খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আইডি কার্ড আর গলার চেন ছাড়া আর কিছুই পাইনি। মা যে সেই গেলো, আর ফিরে আসল না। কে বা কারা গুলি করেছিল, তাও জানি না। আজ পর্যন্ত মায়ের লাশটাও খুঁজে পেলাম না।’ ঘটনার পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বাবা বাসায় ফেরেন বলে জানালেন জান্নাতুল। তার দুই ভাইও আসেন বাসায়। সবাই মিলে অনেক খোঁজাখুজি করেও তার মাকে আর পাওয়া যায়নি। জান্নাতুল বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমার দুই ভাই ও দুই চাচাকে (মিজান ও শাহজাহান) গ্রেফতার করা হয়। এর প্রায় চার মাস পরে থানায় গিয়ে আব্বুও আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বিস্ফোরক মামলায় আব্বু খালাস পেলেও এই মামলায় (পিলখানায় হত্যাকাণ্ড) তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা সুবেদার মেজর জাকির হোসেন জামাল এখন কারাগারে। মাকে তো হারিয়েছেন আগেই। নিম্ন আদালতের রায়ে দুই ভাই ও দুই চাচার যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হওয়ার পর ভাবি আর চাচিরা ফের বিয়ে করেছেন। বলতে গেলে আত্মীয়-স্বজনদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। অশ্রুসজল কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি এখন একা ও অসহায় হয়ে পড়েছি। গ্রামের বাড়িতেই (কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে) থাকি। বাড়ি-ঘর দেখাশোনা করি। কাজ করে নিজে চলি, আর মামলার খরচ চালাই। কিন্তু আমাকে দেখার মতো তো কেউ নাই। কী করব এখন?’
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn