স্ত্রীর পরকিয়া সন্দেহে স্বামীর হাতে খুন হলেন আরফান
আসাদুজ্জামান
সহপাঠী আরফানের সঙ্গে স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক আছে—এমন সন্দেহে আরফানকে খুন করার পরিকল্পনা করেন স্বামী ইমরান হোসেন। এ জন্য নিজের কলেজপড়ুয়া চাচাতো বোনকে ব্যবহার করেন তিনি। ভাইয়ের কথায় আরফানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন তিনি। দেখা করার কথা বলে ওই ছেলেকে ঢাকায় ডেকে আনেন ইমরানের চাচাতো বোন। তুলে দেন ভাইয়ের কাছে। এরপর সেই কলেজছাত্রকে খুন করেন ইমরান ও তাঁর দুই সহযোগী। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন আরফান খুন হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার ইমরানের চাচাতো বোন। প্রধান আসামি ইমরান এখনো পলাতক। পুলিশ বলছে, ঘটনার প্রায় দুই মাস আগে আরফানকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেন ইমরান। চাচাতো ওই বোনকে দিয়ে আরফানকে ডেকে আনা হলেও খুনের সময় বোনটি সেখানে ছিলেন না বলে তথ্য দেন তিনি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ইমরানের সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ঢাকার আশুলিয়ার রাস্তার পাশে গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাওয়া যায় যুবকের বস্তাবন্দী লাশ। বয়স আনুমানিক ৩২ বছর। গায়ের রং শ্যামলা। গায়ে সাদা শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট। সেখানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দুই হাত ছিল পিছমোড়া করে বাঁধা।
পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করে। যুবকের পরিচয় তখনো জানতে পারেনি পুলিশ। পরিচয় জানতে তাঁর ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে পুলিশ। ওই ছবি দেখে তাঁর পরিবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুলিশ তখন জানতে পারে, নিহত যুবকের নাম আরফান ইসলাম। রাজবাড়ী সরকারি কলেজের ছাত্র তিনি। পুলিশ তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) জোগাড় করে। এর সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে, আরফানের সঙ্গে এক নারীর মুঠোফোনে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। ওই নারী রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ঢাকার পশ্চিম শেওড়াপাড়া থেকে তাঁকে আটক করা হয়। পরে এই খুনের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই নারী আরফান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য দেন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ইমরানের চাচাতো বোন তথ্য দেন—কীভাবে ঢাকায় এনে আরফানকে ভাইয়ের কাছে তিনি তুলে দেন। তাঁর ভাষ্য, আরফানের সঙ্গে স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক আছে—এমন সন্দেহ ছিল ইমরানের। পুলিশ বলছে, ইমরান ও তাঁর দুই সহযোগীর ফোনকলের রেকর্ড সংগ্রহ করে খুনের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এই হত্যার সন্দেহভাজন তিন আসামি এখনো গ্রেপ্তার হননি। পুলিশের ধারণা, হত্যায় তিনজন অংশ নেন। ফোনকল ট্র্যাকিং করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের ধারণা, ইমরান ভারতে পালিয়ে গেছেন। ফারুক ও সাইদুর নামের আরও দুজন সন্দেহভাজন আসামি দেশেই আছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। তবে তাঁরা এখনো ধরা পড়েননি। তাঁরা দুজন ইমরানের রেন্ট-এ কারের গাড়ি চালাতেন বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। পুলিশ একজন কর্মকর্তা বলেন, এই তিন আসামির মোবাইল ফোনের সিডিআর দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আরফানকে যেদিন খুন করা হয়, সেদিন তাঁদের সবার মুঠোফোন সাভারের আশুলিয়া পর্যন্ত সচল ছিল। এরপর থেকে তিনজনের মুঠোফোন বন্ধ।
তদন্ত ও আদালত সূত্র বলছে, খুন হওয়া আরফান ইসলামের বাড়ি রাজবাড়ীতে। তিনি রাজবাড়ী সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়তেন। একই কলেজে পড়েন ইমরানের স্ত্রী। তিনি আরফানের সহপাঠী। তাঁর বাড়িও রাজবাড়ীতে। চার বছর আগে ইমরানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ইমরান ঢাকায় রেন্ট-এ কারের ব্যবসা করেন। তাঁর অফিস ঢাকার আজিমপুর এলাকায়। বিয়ের পরও বেশির ভাগ সময় রাজবাড়ীতেই থাকতেন ইমরানের স্ত্রী। ইমরানের চাচাতো বোন ঢাকার শেওড়াপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থেকে লেখাপড়া করেন। চলতি বছরের জুলাইয়ে চাচাতো বোনকে ইমরান বলেন, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আরফান ইসলামের সম্পর্ক আছে। তিনি এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারছেন না। চাচাতো বোনকে আরফানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে বলেন ইমরান। সে অনুযায়ী চাচাতো বোন প্রথমে ফেসবুকে আরফানের সঙ্গে চ্যাটিং শুরু করেন। এরপর মোবাইল ফোনে কথা বলা শুরু। ইমরান চাচাতো বোনকে এ জন্য একটি মোবাইল ফোনও কিনে দেন।
দেড় মাস ফোনে কথা বলার পর ইমরানের চাচাতো বোন দেখা করার জন্য আরফানকে ঢাকার ইডেন কলেজের সামনে আসতে বলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর আরফান ঢাকায় আসেন। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে ইডেন কলেজের সামনে চাচাতো বোনের সঙ্গে আরফান দেখা করেন। ইমরানও সেখানে আসেন। চাচাতো বোনকে পাঠিয়ে দিয়ে ইমরান গাড়িতে তোলেন আরফানকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মুকিব হাসান বলেন, ইডেনের সামনে থেকে আরফানকে তুলে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোড়াপীর মাজার সড়কের ফাঁকা জায়গায় বস্তাবন্দী করে ফেলে রেখে যায়। হত্যাকাণ্ডে ইমরান সঙ্গে আরও দুজন ছিল বলে মোবাইল ফোনের কললিস্ট থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।