ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে কে কার বিরুদ্ধে লড়াই করছে?
২০১৫ সালের মার্চ থেকে গৃহযুদ্ধে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির সৌদি এবং পশ্চিমা সমর্থিত সরকার এবং ইরান সমর্থিত শিয়া হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৮৬০০ লোকের, জখম হয়েছে প্রায় ৫০,০০০। এই তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ যিনি হুতি বিদ্রোহীদের সাথে কোয়ালিশনের অংশ ছিলেন। কিন্তু অতি সম্প্রতি হুতিদের সাথে তার সমর্থকদের বিরোধ তৈরি হয়। এরপর আগে সৌদিদের সাথে মীমাংসার ইঙ্গিত দেওয়ার দুদিন পর সোমবার সাবেক মিত্র হুতিদের হামলায় তার মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেল।
কীভাবে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ?
লড়াইয়ের সূচনা ২০১১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিরোধ থেকে। বর্তমান সৌদি সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির তখনকার প্রেসিডেন্ট সালেহ’র ডেপুটি ছিলেন। স্থিতিশীলতার স্বার্থে মীমাংসা অনুযায়ী সালেহ হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু দক্ষিণে আল কায়দার তৎপরতা থেকে শুরু করে বেকারত্ব এবং সালেহ’র প্রতি কিছু সেনা কর্মকর্তার অব্যাহত আনুগত্যের কারণে হাদি ক্ষমতা নিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করেন। সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয় ইয়েমেনের সংখ্যালঘু জাইদি শিয়া মুসলিম মিলিশিয়া বাহিনী যারা হুতি নামে পরিচিত। তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় সাদা প্রদেশ এবং আশপাশের বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। হাদির সরকারের প্রতি বিরক্ত অনেক সুন্নিও সেসময় হুতিদের সমর্থন দেয়। এরপর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় ঢুকে পড়ে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তারা সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং প্রেসিডেন্ট হাদি এবং তার সরকারের সদস্যদের কার্যত গৃহবন্দী করে ফেলে। প্রেসিডেন্ট হাদি পালিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী এডেনে পালিয়ে যান। এরপর সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ’র সমর্থকদের সাথে জোট বেঁধে হুতি মিলিশিয়ারা পুরো ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৫ সালের মার্চে হাদি দেশ থেকে পালিয়ে যান। শিয়া ইরান পাশের দেশে হাত বাড়াচ্ছে – এই আশঙ্কায় সৌদি আরব সাতটি সুন্নি আরব দেশের সাথে মিলে হুতিদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে। অস্ত্র এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে তাদের সমর্থন যোগায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স।
তখন থেকে কি হয়েছে?
২০১৫’র মার্চ থেকে চলতে থাকে লড়াই। তখন থেকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তির তিন দফা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। সৌদি বিমান হামলার ছত্রছায়ায় পলাতক প্রেসিডেন্ট হাদির অনুগত সৈন্যরা সুন্নি উপজাতীয় যোদ্ধাদের সাথে মিলে এডেনের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সমর্থ হয়, কিন্তু দীর্ঘ সেই লড়াইতে শত শত লোকের মৃত্যু হয়। সৌদি নেতৃত্বে কোয়ালিশনের স্থল সৈন্যরাও এডেনে এসে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এবং এখন পর্যন্ত এই বন্দর শহর এবং দেশের সিংহভাগ দক্ষিণাঞ্চল হুতিদের আওতামুক্ত রাখতে পেরেছে। এডেনে প্রেসিডেন্ট হাদির সরকারও রয়েছে যদিও সেই সরকারের অধিকাংশ সদস্য দেশছাড়া। সানা এখনও হুতিদের নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তায়েজও তাদের হাতে অবরুদ্ধ, এবং মাঝেমধ্যেই তারা সৌদি আরবের ভেতরে মর্টার এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। নভেম্বরে রিয়াদ বিমানবন্দর লক্ষ্য করে একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর সৌদি আরব ইয়েমেনের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। বিদ্রোহীদের মধ্যে বিরোধ কেন : বেশ কমাস ধরে শোনা যাচ্ছে সালেহর সমর্থক যোদ্ধাদের সাথে হুতি বিদ্রোহীদের সম্পর্ক চটে যাচ্ছে। ২৯ নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের সানায় দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফা লড়াই হয়।
দোসরা ডিসেম্বর সালেহ টিভিতে হাজির হয়ে বলেন সৌদিদের সাথে ‘নতুন সম্পর্ক’ রচনায় তিনি প্রস্তুত। এর দুদিন পর সোমবার তার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। একথা অনস্বীকার্য যে সালেহ একসময় সৌদিদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং হুতিরা একসময় তার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিল। বাকি বিশ্বের কী যায় আসে : পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে ইয়েমেন ভিত্তিক একিউএপি আল কায়দার সবচেয়ে ভয়ানক শাখা এবং ইয়েমেনের অস্থিতিশীলতা এই গোষ্ঠীকে সাহায্য করছে। এছাড়া হুতি বিদ্রোহী এবং হাদি সরকারের মধ্যে লড়াইকে অনেকেই দেখছেন মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সৌদি আরবের প্রভাব বিস্তারেরএকটি লড়াই হিসাবে। এছাড়া ইয়েমেনের অবস্থানও কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাব আল-মান্দাব প্রণালি ইয়েমেনের লাগোয়া। সরু এই জলপথটি লোহিত সাগর এবং গাল্ফ অব এডেনকে সংযুক্ত করেছে। বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রধান একটি রুট এই জলপথ। বিবিসি