নিখোঁজ মারুফের বাসায় ঢোকা ৩ যুবক কারা?
ঢাকা: কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা মারুফ জামান গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ। অথচ ওই দিনই রাত পৌনে আটটার দিকে তিনি নিজেই টেলিফোন করেন বাসার ল্যান্ডফোন নম্বরে। বাসায় থাকা গৃহপরিচারিকা টেলিফোন ধরলে মারুফ জামান তাকে বলেন, কিছুক্ষণ পরে বাসায় কয়েকজন লোক যাবে। তাদের হাতে যেন তার ব্যবহৃত ল্যাপটপটি দিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই রাত ৮টা ৫ মিনিটে ওই বাসায় প্রবেশ করেন মাথায় ক্যাপ ও মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পড়া তিন ব্যক্তি। নির্দেশমতো তাদের দরজা খুলে দেন গৃহপরিচারিকা। বাসায় ঢুকে ওই তিন ব্যক্তি মারুফ জামানের ল্যাপটপ, বাসার কম্পিউটারের সিপিইউ, ক্যামেরা ও স্মার্টফোন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। ওই বাসার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৮টা ১৭ মিনিটের দিকে বাসাটি থেকে বের হয়ে যান তিনি, যা দেখা গেছে ওই বাসার সিসিটিভি ফুটেজে। মারুফ জামানের আত্মীয়স্বজন ও তার নিখোঁজের ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই সব তথ্য জানা গেছে। এই ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তার মেয়ে সামিহা জামান। মারুফ জামানের ছোট ভাই রিফাত জামান জানান, মারুফ জামান কাতার ও ভিয়েতনামের সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব।
ভাই রিফাত বলেন, ২০১২ সালের এপ্রিলে তাদের মা মারা যান। এরপর ওই বছর ডিসেম্বরে মারুফ জামানের স্ত্রীর মৃত্যু হয়। পরের বছর বাবা মারা যান। এসব কারণে মারুফ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলেও তার সঙ্গে নিখোঁজ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই মনে করেন তার ভাই। রাজনৈতিক কোনো সংগঠনের সঙ্গেও মারুফ যুক্ত ছিলেন না বলে ভাই জানান। মারুফ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিগনাল কোরের (ষষ্ঠ শর্ট কোর্স) একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন। ভাইয়ের দেওয়া তথ্য মতে, মারুফ জামান সর্বশেষ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্ট্যাডিজে (বিআইএসএস) অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন।
গত ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মারুফ জামানের ছোট মেয়ে বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় নির্ধারিত ছিল। সে কারণে মেয়েকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাসায় নিয়ে আসতে ধানমণ্ডির ৯/এ সড়কের ৮৯ নম্বর বাসা থেকে তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে মারুফ জামান বাসার ল্যান্ডফোনে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে বাসার গৃহপরিচারিকা সাহেরা বেগমকে বলেন, বাসায় কেউ গেলে তাকে যেন তার ব্যবহৃত ল্যাপটপটি দিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই ৮টা ৫ মিনিটে মাথায় ক্যাপ ও মুখে মাস্ক পরা তিনজন বাসায় প্রবেশ করেন। তারা বাসায় ঢুকে মারুফ জামানের ল্যাপটপ, বাসার কম্পিউটারের সিপিইউ, ক্যামেরা ও স্মার্টফোন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। একই সঙ্গে মারুফ জামানের ঘরেও তল্লাশি চালান তারা। এ সময় মারুফ জামানের মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করছিলেন সাহেরা বেগম। কিন্তু তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এ কারণে তার সঙ্গে তখন যোগাযোগ করতে পারছিলেন না ওই গৃহপরিচারিকা।
বাবাকে না পেয়ে বিমানবন্দর থেকে একাই বাসায় চলে আসেন মারুফ জামানের ছোট মেয়ে। বাসায় এসেও বাবাকে না পেয়ে এবং সারা রাত তার ফোন বন্ধ থাকায় গতকাল দুপুরে ধানমণ্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা করেন সামিহা জামান। এরপর গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ খিলক্ষেত থানা এলাকা থেকে তার ব্যবহৃত গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো- গ-২১-১৩৯৯) উদ্ধার করে। ধানমণ্ডি ৯/এ সড়কে পৈত্রিক জমিতে করা ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় মারুফ জামান থাকেন। ওই বাড়ির চতুর্থ তলায় থাকেন তার বড় বোন শাহরিনা কামাল, পঞ্চম তলায় থাকেন তার ছোট ভাই রিফাত জামান। মারুফ জামানের ছোট বোন শাহরিনা কামাল জানান, মারুফ জামান নিখোঁজের পর থেকেই পরিবারের সব সদস্যরা অনেকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। এই ঘটনায় তার দুই মেয়ে অনেক বেশি ভেঙে পড়েছেন। দুই মেয়ের মধ্যে একজন এখন বেলজিয়ামে রয়েছেন। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি। মারুফ জামানকে দ্রুত উদ্ধারের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানান শাহরিনা কামাল।
আজ দুপরে ধানমণ্ডির ৯/এ সড়কের ৮৯ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার সামনে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় জমিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে কেউই রাজি হননি। ওই বাসায় তদন্তের জন্য এসেছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণের একটি দল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণের সহকারী কমিশনার (এসি) ফজলুর রহমান বলেন, মারুফ জামান কীভাবে নিখোঁজ হয়েছেন তা তদন্ত করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আর এই বাসায় যে তিনজন এসেছিলেন, তারা কারা তা জানার জন্য বাসার গেটে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এই বিষয়ে ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ আজ দুপুরে জানান, ধানমণ্ডির ৯/এ সড়কের ৮৯ নম্বর বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন মারুফ জামান। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি ধানমণ্ডির বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তায়র মেয়ে সামিহা জামানের বিদেশ থেকে বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর কথা ছিল। মেয়েকে নিতেই তিনি বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন । এরপর সন্ধ্যা থেকেই নিখোঁজ মারুফ জামান। তবে সন্ধ্যায় তার বাসায় বাসায় ল্যান্ডফোনে ফোন আসার কিছু সময় পরেই ওই বাসায় তিনজন লোক প্রবেশ করেছিল। সিসিটিভির ফুটেজ থেকে তাদের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে তাদের নিজেদের চেহারা লুকাতে তারা মাথায় ক্যাপ ও মুখে মাস্ক পরে এসেছিল। সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য সূত্রগুলো ধরে মারুফ জামানকে খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান ওসি।
অন্যদিকে দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মারুফ জামান নিখোঁজের বিষয়ে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। আর একই সাথে আমরাও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করব। গত অগাস্ট থেকে চার মাসে ঢাকায় রাজনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী মিলে ডজনখানেক মানুষ নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়সহ চারজন পরিবারের কাছে ফিরে এলেও অধিকাংশের এখনও সন্ধান জানা যায়নি।