মুখোমুখি মিসবাহ সিরাজ ও মাহমুদ-উস সামাদ
সংসদ নির্বাচনের এখনো অনেক দেরী। তবু আগেভাগেই আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে প্রার্থী হওয়ার লড়াই। প্রার্থী হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। বিশেষত সিলেট-৩ আসনের প্রার্থীতা নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও বর্তমান সাংসদ মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৩ মার্চ। ওইদিন ফেঞ্চুগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচনে সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংসদ অনুসারীরা বিবৃতি দিয়ে জানান, বহিরাগত কাউকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে না।
এই বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিতে উত্তাপপ ছড়ায় সিলেট-৩ আসনের রাজনীতিতে। দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে চলে কথার লড়াই। এদিকে, সিলেটে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন আগামী ২২ মার্চ। এই সম্মেলনের ঠিক পূর্ব মূর্হর্তে এই দুই নেতার মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে দলের ভেতরেও চলছে আলোচনা। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সিলেট-৩ আসনের বর্তমান আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ মাহমুদ-উস সামাদ কয়েসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ। এই দুই উপজেলার কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও প্রবীন নেতারাও বর্তমান সাংসদের উপর নাখোশ। তারাই মিসবাহউদ্দিন সিরাজকে আগামী নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী হতে চাপ দিচ্ছেন। মিসবাহ সিরাজ প্রার্থী না হলে নিজেরাই প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের অনেকে।
সাংসদ হওয়ার পর মাহমুদ-উস সামাদের কর্মকান্ড এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পিতার ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে দলের ভেতরেই। তবে এমপি সামাদের সমর্থকদের দাবি, বর্তমান সরকারের আমলে শুধু ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে শাহজালাল সার কারখানা এবং একাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ফেঞ্চুগঞ্জে স্থাপিত হয়েছে। একাধিক প্রকল্প এখনও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা জেয়ারম্যান আবু জাহিদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে কার পিতা কী করেছেন, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা থেকে আড়াই কোটি টাকার গাড়ি কে উপহার নিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যানার-ফেস্টুন কার লোকজন ছিঁড়েছে, তার বাড়িতে কারা হামলা চালিয়েছে সবকিছু বেরিয়ে আসছে। কোনো কিছুই গোপন থাকবে না। মূলধারার প্রবীণ নেতাদের কোণঠাসা করে টিআর, কাবিখার লোভ দেখিয়ে কিছু লোককে পদ দিয়ে আওয়ামী লীগ চালানো যাবে না।
তিনি বলেন, শুধু ফেঞ্চুগঞ্জ নয় দক্ষিণ সুরমা আওয়ামী লীগের অবস্থা আরও করুণ। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এমনকি ১৫ আগস্টও এখানে পালিত হয় না। মানুষ এই অবস্থার পরিবর্তন চায়। কোনো কারণে এই আসনে মিসবাহ উদ্দিন নির্বাচন না করলে সিলেট-৩ আসনে আমিই নির্বাচন করব বলে জানান আবু জাহিদ। তবে সাংসদ অনুসারী হিসেবে পরিচিত ফেঞ্চুগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শওকত আলী বলেন, টিআর, কাবিখা নয় লন্ডনের টাকা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগকে তছনছ করার অপচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, যারা দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়, তারাই এমপি সামাদসহ আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। পুরো আওয়ামী লীগ যেখানে এমপির সঙ্গে, সেখানে কিছু লোক বিচ্ছিন্নভাবে এসব গুজব-গুঞ্জন ছড়াচ্ছেন। তাদের ফায়দা হাসিল না হওয়ায় তারা এসব করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এমপি সামাদের পিতা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ হত্যা নয়, মানুষ রক্ষা করেছেন। অনেক প্রমাণ আছে। আর পিতা যুদ্ধাপরাধী হলে এমপি নিজে সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিল আনলেন কিভাবে? গত ১২ মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সিলেট-৩ আসনের বর্তমান এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন বক্তারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা। ওই রাতে ফেঞ্চুগঞ্জে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান ও সদস্য এ জেড রওশন জেবিন রুবাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে প্রধান অতিথি করা হয় মিসবাহকে। অনুষ্ঠানে স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা। এর জবাবে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, আপনাদের দুঃখ, ক্ষোভ শুনে আমি মর্মাহত হয়েছি। আমাদের দলনেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে অনুমতি দিলে আমি সিলেট-৩ আসনে নির্বাচন করব। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। এতে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সুপ্রিমকোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেলারেল আবদুর রকিব মন্টু, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান হাবিব প্রমুখ।
এদিকে ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ আওয়ামী লীগ। এতে বলা হয়েছে, অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা হবে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শওকত আলী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে উপজেলার ফেঞ্চগঞ্জ সদর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ঋষিকেশ দেব, সাধারণ সম্পাদক লোকমান আহমদ, ঘিলাছড়ার সভাপতি কমর উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মিছবাহ হোসেন চৌধুরী, মাইজগাঁওয়ের সভাপতি মঈন উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালিকসহ অনেকের স্বাক্ষর রয়েছে। বিবৃতিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী সংগঠনকে ‘ভুঁইফোড়’ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের কারণে তারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের দাবি, বর্তমান সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট চক্র পরিকল্পিতভাবে কথিত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দিয়ে জলঘোলা করতে মাঠে নেমেছে। এরপর শনিবার ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ এক বিবৃতিতে তাদের সংগঠনকে ‘ভুঁইফোড়’ দাবি করার প্রতিবাদ জানায়।