আসুন, সবাই মিলে রুখে দিই সন্ত্রাস
ডলার। তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয় জ্যাকসন হাইটসের সোনালি এক্সচেঞ্জে। অকপটে আমাকে বলেন, ‘ভাইয়া দেখুনতো ফরমটা ঠিকমতো পূরণ হয়েছে নাকি!’ তখন সামনে ঈদ, মানি এক্সচেঞ্জে বেজায় ভিড়। বাংলাদেশি সেই ললনার টাকা যথা সময়ে না পৌঁছালে ভাইবোনের হয়তো ঈদের জামা কেনা হবে না অথবা আটকে থাকবে বাবার চিকিৎসা অথবা বোনের বিয়ে। এ রকম লাইনে দাঁড়ায় সিদ্দিক, যে নাকি ম্যানহাটনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফল বিক্রি করে প্রতিদিন প্রায় ১৫ ঘণ্টা। তাঁর কাছে শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ম কোনো ভেদাভেদ নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে শামসু ভাই, চমৎকার যার গানের গলা। ট্যাক্সি চালিয়েও গানের চর্চা থামাননি। সুযোগ পেলেই গলা ছেড়ে গান ধরেন ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়।’ লায়লা ভাবি এনওয়াইপিডি ট্রাফিক পুলিশ। সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও গৃহকাজে নিপুণা। আরে এই যে সুব্রত দা, নিউ ইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, মুজিব ভাই, অ্যাটর্নি, তিনিও লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এভাবে লাইন বাড়তেই থাকে। বিদেশে থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও প্রতিবছরই বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এই রিজার্ভের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় ধাপ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ স্বজনদের দেয় কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য, কিছুটা আর্থিক মুক্তি। দেশের দুর্যোগে প্রবাসীদের হৃদয় কাঁদে। এরা রাস্তায় নেমে আসে। ঘুরে ঘুরে দেশের জন্য, মানুষের জন্য সংগ্রহ করে অর্থ। আমেরিকান হয়েও পালন করে বাংলা নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারির তীব্র ঠান্ডায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের। শহীদ মিনারের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে ভাবে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা।
কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশি প্রবাসীদেরই আরও কয়েক জনের একজন হলেন আকায়েদ, যিনি অতি সম্প্রতি বোমা দিয়ে নিজেকে উড়িয়ে আমেরিকার ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন। এখন পুলিশের হেফাজতে আছেন। বিচারে যে সাজা হতে পারে তা হলো আজীবন কারাবাস। মাত্র ২২ বছর বয়সী পারভেজ আহমেদ যিনি এই বছরই যোগ দিতে চেয়েছিলেন আইসিসে। গ্রেপ্তার অবস্থায় বিচারের অপেক্ষায় আছেন। আরও কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা মাত্র ২১ বছর বয়সী নাফিস, সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। বিচারের পর এখন আছেন জেলে। এরা সবাই আসলে এককভাবে আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। ইংরেজি পরিভাষায় এদের বলা হচ্ছে ‘লোন উলফ’ বাংলায় ‘একাকী নেকড়ে’—কথাটির খুব একটা প্রচলন নেই। প্রশ্ন হলো, এরা কেন এমন করছে? এদের ফেরাবার উপায় কি? এটা যে শুধু আমেরিকায় ঘটছে বা বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ঘটছে তা না। এ রকম সন্ত্রাসী হামলায় বারবার জর্জরিত হয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ আরও অনেক দেশ।
এ পর্যন্ত এই সব যুবকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, অনেক সময় এই যুবকেরা নিজেদের প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না। অথবা একা একা ইন্টারনেট ঘেঁটে তাদের প্রশ্নের জবাব পেতে চেষ্টা করে। অনেকের মাঝেই স্বভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে বন্ধু বান্ধব ছাড়া এরা একা একা চলাফেরা করে। দেখা যায়, কোনো কোনো সময় এরা মসজিদে যায়। তবে খুব নিয়মিতভাবেও সেখানে যায় না। এককভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর দায় পুরো কমিউনিটির ওপর চাপান যায় না আবার এরা যা করেছে তা এককভাবে করলেও বাংলাদেশি কমিউনিটি এর দায় এড়াতে পারে না। তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের সজাগ হতে হবে। শুধু নিন্দা জানালেই হবে না, কেন এমন হচ্ছে তা বের করতে হবে। কেমন করে এটা এড়ানো যাবে তা নিয়ে এখনই সবাইকে চিন্তা করতে হবে। নিউইয়র্কের মতো বড় শহরে আমাদের কমিউনিটির এমন কোনো সংগঠন নেই যেখানে সবাই একসঙ্গে হতে পারে। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে নিজ নিজ অঞ্চলভিত্তিক জেলা উপজেলা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। যদি কেউ যুক্ত নাও হন তবুও তাদের বন্ধু বান্ধব হয়তো সংযুক্ত আছেন। এই সংগঠন গুলির পক্ষে ওই অঞ্চলের সকলের খোঁজ খবর রাখা সম্ভব। তাই মনে হয়, এটিই হতে পারে এককভাবে সংগঠিত সন্ত্রাস প্রতিরোধের একটি উপায়। কোনো কোনো সময় মানুষ সাধারণত হতাশাগ্রস্ত হয়েও এই সমস্ত কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এমন কারও সন্ধান পাওয়া গেলে যদি কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন হয় তবে সংগঠনগুলি তার ব্যবস্থা করতে পারে। এমনকি চাকরি পাওয়া, আর্থিক বা ইমিগ্রেশন সহ অন্য কোনো প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। স্থানীয় ভাবে নিউইয়র্কে অনেক বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই মিডিয়াগুলি সবাইকে সজাগ করতে পারে। আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষ করে এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যে ইসলাম সমর্থন করে না এই নিয়ে আরও আলোচনা ছাড়াও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে যুব সমজকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতে হবে।