‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ’ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিলেন
‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ’ খাওয়ার বিষয়ে দেয়া বক্তব্যের তীব্র সমালোচনার মুখে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি এই কথা বলেছিলেন। রবিবার রাজধানীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকারী (ডিআইএ) কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেয়ার তিন দিন পর বুধবার সচিবালয়ে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেনি শিক্ষামন্ত্রী। তার দাবি, রবিবার দেয়া বক্তব্য খণ্ডিতভাবে এসেছে গণমাধ্যমে এবং এ কারণেই এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে তারা সরকারে আসার পর শুরুর দিকে ডিআইএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে নিয়ে আসতেন শিক্ষকরা। তারা বলতেন, সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নিলে তারা চলতে পারবেন। এই উদাহরণই তিনি দিয়েছেন সেদিন। ‘অনেক শিক্ষক এসে আমার কাছে কান্নাকাটি করে বলতেন, আমরা নিম্ন বেতনে চাকরি করি, এত টাকা আমরা কোথা থেকে দেবো। এক মাসের বেতন সম্পূর্ণ টাকা ঘুষ দিলে পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা খাব কী করে? ঘুষের মাত্রা আরেকটু সহনীয় হলেও বাঁচতাম বলে তারা মন্তব্য করতেন। এটা শিক্ষকদের কথা।’
নিজেকে দুর্নীতিবাজ ও চোর আখ্যা দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রী বলেন, ‘তারা যখন শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা চাইতেন, পুরা মাসের বেতন নিয়ে নিতে চাইতেন, তখন শিক্ষকরা কম দিতে চাইতেন। তখন তারা বলতেন এত কম টাকায় হবে না, ওপরেও দিতে হবে। তাতে শিক্ষক কর্মচারীরা মনে করতে বাধ্য হতো তাদের প্রদত্ত ঘুষ শুধু পরিদর্শনকারীরা পেত না, ঊর্ধ্বতন আমলারা পায় এবং মন্ত্রী হিসেবে আমিও পাই। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক কর্মচারীরা মনে করত অফিসাররা চোর, মন্ত্রীও চোর।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অতীতে এই ছিল অবস্থাটা। মানুষের কাছে টাকাটা যখন চাইত, তখন বলত ওপরে দিতে হয়। ওপরে মানে কী? আরও বড় অফিসার, আরও বড় মন্ত্রী, তখন মানুষ বলত মন্ত্রীও খায়।’ ‘তখন মানুষ মনে করত, আমলা, অফিসার আর মন্ত্রীরাও ঘুষ খায়। আমি মন্ত্রীও ঘুষ খাই, আমি মন্ত্রীও চোর, এটা মানুষের একটা ধারণা ছিল। শিক্ষকরা আমাদেরকে এ কথা বলেছেন।’ তবে মন্ত্রী বলেন, সেদিন তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলের উদাহরণ দিলেও ওই সরকারের নাম নেননি। বিএনপির সমালোচনার জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আসলে তাদের সময়ই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের সময়, বরং তাদেরই উচিত এর ব্যাখ্যা দেয়া, তাদের কুশাসনের ফসল এটা।’
খণ্ডিত প্রক্তব্য প্রচারের অভিযোগ
যে বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সেটি গণমাধ্যমে খণ্ডিতভাবে এসেছে বলে দবি করেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেন, ‘অধিকাংশ পত্র পত্রিকা ও মিডিয়ায় এই বক্তব্য সঠিকভাবে আসলেও দুই একটি মিডিয়ায় কথাটা বিভ্রান্তিকরভাবে এসেছে এবং এ কারণে আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই।’ ‘আমার কিছু হারানোর নেই’ এমন মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নতুন করে কিছু পাওয়ারও নেই। আমি বিনয়ী কিন্তু নীতিগত দিক থেকে অবিচল। কেউ যদি তাকে অসহায়ত্ব মনে করেন তবে তা হবে অন্যায়।’
সব প্রশ্নের জবাব মেলেনি
লিখিত বক্তব্যের পর মন্ত্রিত্ব ছাড়তে টিআইবির আহ্বানের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘টিআইবি তাদের কাজ করেছে। আমি কারো বিষয়ে কোন মন্তব্য বা দোষী করতে রাজি নই।’ সাংবাদিকরা এরপরও নানা প্রশ্ন তুলে ধরতে থাকলে মন্ত্রী ‘আজ আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো না। আমার বক্তব্য আমি তুলে ধরেছি। এর বাহিরে আর কিছু নাই’ বলে সংবাদ সম্মেলন থেকে চলে যান।
‘পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে’
মন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল ডিআইএ। চরম দুর্নীতি, অব্যবস্থা, দুর্বলতা ছিল দৃশ্যমান। আট বছরে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে বলে দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী। ‘বহুদিন ধরে কাজ করে মটিভেশন করে, প্রস্তুতি নিয়ে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে সেই সঙ্গে ‘পিআর ইনস্পেকশন’ আমরা চালু করেছি যেখানে শুধুমাত্রা অফিসার না, আমাদের বিভিন্ন অধ্যক্ষ, হেডমাস্টার বা শিক্ষক বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত করে আমরা মিলিয়ে দিয়েছি। যাতে করে আমাদের সংখ্যাও বাড়ে, বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারবে ঘন ঘন।’ মন্ত্রী জানান, ডিআইএ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে ফলে সবাই এখন কানেকটেড থাকে। এতে অনেক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে বলে দাবি করেন মন্ত্রী।
নাহিদ বলেন, ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি জোরদার করা হয়েছে। ডিআই্এর পুরনো দুর্নাম ঘোঁচানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং পদ্ধতি জোরদার করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে ইতিবাচক হতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘পিআর ইনস্পেকশন পদ্ধতি চালুকরণ, ডিজিটাল মনিটরিং পদ্ধতি চালুকরণ, ২৬ হাজার ৭০০ স্কুল কলেজে ডিজিটাল অটোমেশন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ, ওয়েসবাইট, ফেসবুক, ইউটিউব চালুকরণসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ সম্প্রতি ডিআইএর একজন কর্মকর্তাকে ঘুষসহ ধরে দুদকের হাতে তুলে দেয়ার কথাও সংবাদ সম্মেলনে জানান মন্ত্রী।
শিক্ষাখাতে দুর্নীতি বাংলাদেশে কম
শিক্ষাখাতে দুর্নীতি বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে কম বলেও দাবি করেন মন্ত্রী। বলেন, দেড় বছর আগে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এই বিষয়টি উঠে এসেছে। মন্ত্রী বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষায় দুর্নীতি পরিমাপ করে। তারা বলেছে বিশ্বে শিক্ষায় গড় দুর্নীতি হয়েছে ১৭ পারসেন্ট। আমাদের দেশে এটা কম’।
সেদিন যা বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী
বরিবার রাজধানীতে ডিআইএর কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘স্কুলে খাম তৈরি করা থাকে। খামটা আপনার হাতে ধরাই দিলে আপনি খাইয়্যা-দাইয়্যা চলে আসবেন। আইস্যা রিপোর্ট দেবেন ঠিক আছে।’ ত্যক্ত-বিরক্ত মন্ত্রী পরিদর্শকদের ভালো কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলতে থাকেন, ‘আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা ঘুষ খাবেন, তবে সহনশীল হইয়া খাবেন। অসহনীয় হয়ে বলা যায় আপনারা ঘুষ খাইয়েন না, নইলে অর্থহীন কথা হবে।’ শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সমালোচনার ঝড় উঠে। শিক্ষাখাতে ঘুষ-দুর্নীতি নতুন কোনো ঘটনা না হলেও মন্ত্রীর কথায় তা বৈধতা পেয়ে যাবে বলে আশঙ্কার কথা বলাবলি হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমেও। বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ বার্তা। দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি এক বিবৃতিতে দুর্নীতির নৈতিক দায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে মঙ্গলবার।