পর্তুগাল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশিরা
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধ হয়ে পড়া বহু বাংলাদেশি অভিবাসী পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বর্গরাজ্য খ্যাত আটলান্টিক পাড়ের দেশ পর্তুগালে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে বৈধ অভিবাসনের স্বীকৃতি লাভের আশায় তারা এই দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তারা পর্তুগাল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। কিছুদিন ধরে পর্তুগিজ অভিবাসন কার্যালয়ের নানা হয়রানি, অবৈধভাবে পর্তুগালে প্রবেশের কারণ দেখিয়ে পর্তুগিজ বর্ডার সার্ভিস (সেফ) কর্তৃক দেশটি ত্যাগের নির্দেশসহ নানা কারণে বাংলাদেশিরা পর্তুগাল ছাড়ছেন। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের মার্তৃম-মুনিজে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। মার্তৃম-মুনিজের বেনফরমসো নামের একটি সড়কের প্রায় সিংহভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মালিকানায়। প্রথম দেখায়, যে কেউ এই সড়ককে বাংলাদেশের কোনো সড়ক হিসেবে মনে করতে পারেন। কারণ এখানে বাংলাদেশিদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস রয়েছে, দেশীয় শাক-সবজি, মাংসের দোকান, অসংখ্য বাংলাদেশি খাবারের রেস্তেরাঁসহ অাশপাশের প্রায় সবকটি দালানবাড়িই বাংলাদেশিদের দখলে।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ভিসাবিহীন পর্তুগালে প্রবেশ করা অভিবাসীদের জন্য বৈধকরণ প্রক্রিয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। অবৈধভাবে পর্তুগালে প্রবেশের কারণ দেখিয়ে পর্তুগাল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন পর্তুগিজ বর্ডার সার্ভিস (সেফ)। এরপর থেকে ফাঁকা হচ্ছে লিসবনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত মার্তৃম মুনিজ এলাকা। যেখানে মাস ছয়েক আগেও সন্ধ্যা হলেই বাংলাদেশি অভিবাসীদের আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠতো। সেখানে এখন অভিবাসীদের তেমন ভিড় দেখা যায় না। অভিবাসীদের সঙ্গে পর্তুগিজ অভিবাসন কার্যালয়ের কঠোর মনোভাবের কারণে পর্তুগাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বৈধ অভিবাসনের জন্য স্বীকৃতি লাভের আশায় দীর্ঘ দিন ধৈর্য ধরে থাকা এসব অভিবাসীরা। ইতোমধ্যে অনেকেই আশাহত হয়ে পর্তুগাল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে সিংহভাগই অবস্থান করছেন ফ্রান্সে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্তুগালে ব্যবসা শুরু করা অধিকতর সহজ হওয়ায় বিগত দিনে অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী মিনি সুপার মার্কেট, কাবাবসপ, কফিসপসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বৈধ কাগজের আশায় এসব ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন। যাদের সিংহভাগই নতুন ব্যবসায়ী হওয়ায় অনেকেই না বুঝে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে ধরাশায়ী হয়েছেন। এরপর হঠাৎ অভিবাসন কার্যালয়ের এমন কঠোরতায় অনেকেই বৈধ কাগজ পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ও ব্যবসায়ে আলোর মুখ না দেখে ব্যবসা গুটিয়ে ইউরোপের অন্যত্র চলে গেছেন।
এরকমই একজন অভিবাসন প্রত্যাশী ব্যবসায়ী রকিব উদ্দিন। যিনি বৈধ অভিবাসী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে ব্রিটেন থেকে পর্তুগালে এসেছিলেন ২০১৫-এর শুরুর দিকে।এই অভিবাসন প্রত্যাশী ব্যবসায়ী জানান, তিনি ব্রিটেন থেকে তার জমানো ২৮ হাজার পাউন্ড ২০১৫ সালের দিকে পর্তুগালে একটি সুপার মার্কেট ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। ২০১৬ সালের মাঝামাঝির দিকে বহু চেষ্টা করেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। সে বছর শেষের দিকে তার ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়। এরই মধ্যে ১৮ মাস ধরে তিনি পর্তুগিজ স্যোশাল সিকিউরিটিতে ট্যাক্স-পে করে আসছেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনো তিনি অভিবাসন কার্যালয়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। বর্তমানে হতাশায় দিন কাটছে তার। ফারহান জামাল খান নামের আরেক বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশী জানান, ১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি কাঙ্ক্ষিত রেসিডেন্স কার্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পর্তুগিজ বর্ডার সার্ভিস (সেফ) কার্যালয়ে রেসিডেন্স কার্ডের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক নিয়মে এক মাসের মধ্যে রেসিডেন্স কার্ড তার হাতে এসে পৌঁছানোর কথা থাকলেও ১৬ মাসেও কার্ড পাননি। তিনি জানান, তার মতো এমন হাজারও বাংলাদেশিরা মাসের পর মাস, বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের রেসিডেন্স কার্ড পাচ্ছেন না। এছাড়াও অনেক বাংলাদেশি অভিবাসীদের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তারা পর্তুগিজ অভিবাসন কার্যালয়ের প্রতি ক্ষোভ ও চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও এখনো সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর (পর্তুগিজ স্যোসাল সিকিউরিটি) পাননি। ফলে চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী রুট আলগারভিও`র কাছে অভিবাসন পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পর্তুগালে বর্তমানে ভিসাবিহীন প্রবেশকারী অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার পথ মোটামুটি বন্ধ বলা চলে। বৈধ উপায়ে ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থায় পর্তুগালে প্রবেশের প্রমাণ স্বরূপ বিমান, বাস বা ট্রেনের টিকিট চাওয়া হচ্ছে। যারা এগুলো দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের অাবেদন প্রত্যাখ্যাত করে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা ভিসা থাকাকালীন বৈধ পথে পর্তুগালে প্রবেশের প্রমাণ দেখাতে পারছেন তাদের জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে। গত জানুয়ারিতে নতুন করে একটি অভিবাসন আইন হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত নতুন আইন হয়নি। পর্তুগিজ বর্ডার সার্ভিস (সেফ) কেন এমন কঠোর আচরণ করছে জানতে চাইলে রুট আলগারভিও বলেন, আগের বছরগুলোতে পর্তুগিজ অভিবাসন কার্যালয় আইনের তোয়াক্কা না করে বিপুল স্যংখক অভিবাসীদের যত্রতত্র রেসিডেন্স কার্ড পেতে সাহায্য করেছিলেন। বর্তমান সেফের নতুন কর্মকর্তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন এবং বিগত দিনে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে তারা এমন কঠোর মনোভাব পোষণ করছেন। রুট আরও বলেন, ইউরোপীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পর্তুগিজ সরকারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চাপ রয়েছে, যে কারণে ভিসাবিহীন অভিবাসীদের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সবসময়ই শঙ্কিত।