ডাকসুর ১১ কোটি টাকার হদিস নেই!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে টাকা খরচ করা হচ্ছে। তবে কোন খাতে খরচ হচ্ছে, এ বিষয়ে যথাযথ কোনো ব্যাখ্যা গত ২৭ বছরের মধ্যে প্রশাসন একবারও দিতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচন না দিয়ে কর্তৃপক্ষ নিজের অধ্যাদেশও বছরের পর বছর ধরে কেন লঙ্ঘন করে আসছে, এর কোনো ব্যাখ্যাও কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। কোষাগারে ডাকসু বাবদ কোনো টাকা জমা নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘ডাকসু না থাকলেও এসব টাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল পর্যায়ে নানা খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়।’ টাকার হদিস জানেন না কেউ : ডাকসুর সবশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। ১৯৯১ সালের ১৮ জুন নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তা হয়নি। ঢাবিতে এখন প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী। প্রতি বছর ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদের নামে ৬০ টাকা করে মোট ১২০ টাকা নেওয়া হয়। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মাস্টার্স ও এমফিলসহ অন্যান্য কোর্সে ভর্তি হওয়ার সময়ও আদায় করা হয় একই পরিমাণ টাকা।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওই দুই খাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হতো ৪০ টাকা করে। ১৯৯২ সালে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় ৬০ টাকা। তবে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বর্তমান সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থী কম ছিল। এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। ঢাবির নিজস্ব তহবিল মিলিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ কোটি টাকা। বাজেট বইয়ের তথ্যানুযায়ী, সবশেষ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ডাকসুর জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। একই অর্থ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৮টি আবাসিক হলে ছাত্র সংসদের জন্য ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয় ১২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এ টাকা কোথায় যাচ্ছে, তার কোনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি কর্তৃপক্ষের কাছে। কেউ কথা রাখেননি : গত ২৭ বছরে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ এ প্রতিষ্ঠানে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে কয়েকজন ডাকসুর নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি শোনান। তবে কেউ কথা রাখেননি। ২০০৫ সালের মে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমল। ঢাবির তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণার পর ছাত্র সংগঠনগুলো নড়েচড়ে বসে। শেষ পর্যন্ত তা ঘোষণাতেই আটকে থাকে।
২০০৯ সালে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডাকসুর নির্বাচনের আশা প্রকাশ করেলেন। তার ঘোষণা অনুযায়ীও কাজ আগায়নি। গত বছরের ৪ মার্চ সমাবর্তনে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির তাগাদার পরপর তখনকার উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দেব। সব সময়ই চেষ্টা করেছি ডাকসু নির্বাচন হোক। সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ ওয়ালিদ আশরাফ নামের এক শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন শুরু করলে গত ১০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সেখানে হাজির হয়ে ডাকসু নির্বাচনের আশ্বাস দেন। তবে তিনি এও বলেন, ‘সেটি সময়ের ব্যাপার।’ ১৯৭৩ অধ্যাদেশ লঙ্ঘন : ঢাবি পরিচালনা অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এ বলা হয়েছে, সিনেটে শিক্ষার্থীদের মতের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত পাঁচজন প্রতিনিধি থাকবেন। ২৭ বছর ধরে এ আইনের বাস্তবায়ন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্তেও শিক্ষার্থীদের মতের প্রতিফলন নেই। গণতান্ত্রিক অধিকারকে পাশ কাটিয়ে ‘একলা চলো’ নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে ঢাবি। কেন্দ্রীয় ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন, আবাসন ও শ্রেণিকক্ষ সংকট, সংস্কৃতিচর্চায় বন্ধ্যত্বসহ নানা সমস্যা বিরাজ করলেও এ নিয়ে কথা বলার কোনো ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম নেই। আদালতের রায়ও উপেক্ষিত : ডাকসু নির্বাচন চেয়ে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ উচ্চ আদালতে রিট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চান আদালত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। গত ৪ মার্চ ঢাবির সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচন না হলে দেশে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করেন। তিনি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্যতা সৃষ্টি হবে।’ ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুনের পর গঠিত তদন্ত কমিটি ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার সুপারিশ করেছিল, কিন্তু তা পানি পায়নি।