অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় ‘দুঃখ’ মুহিতের
সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার আক্ষেপ জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যিনি একাত্তরে প্রবাসে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।মঙ্গলবার রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিশু-কিশোরদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। আমি বিদেশে ছিলাম এবং সেখান থেকে বাংলাদেশের সীমানায় এসে যুদ্ধ করতে পারিনি, এটা আমার একটি মহাদুঃখ।”শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে একাত্তরের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ‘মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা শোন’ শীর্ষক জাতীয় কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী একথা বলেন।ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ জানিয়ে ওই ‘দুঃখমোচনের’ চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মুহিত।
তিনি বলেন, “দুঃখটা মোচনের চেষ্টা করেছি বিদেশে, নিউ ইয়র্কে এবং আমেরিকার ৪০টি রাজ্যে। আমি সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী এবং কথা বলে গিয়েছি, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।“সেখানে আমাদের একটা দুঃখ ছিল আমেরিকায় রিচার্ড নিক্সনের সরকার…তারা সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং চেষ্টা করেছে যাতে আমাদের স্বাধীনতা না আসে। আমেরিকায় সংবাদমাধ্যম, জনগণ, ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। এবং মুক্তিযুদ্ধের ডাইমেনশন জানার আগ্রহ তাদের মধ্যে ছিল। এ ফলশ্রুতিতে আমি ৪০টি অঙ্গরাজ্যে আমন্ত্রিত হয়ে কথা বলেছি।” ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন মুহিত। এজন্য ২০১৬ সালে তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।
অনুষ্ঠানে আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, পরিবেশন করা হয় কয়েকটি গণসঙ্গীত।শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ করে দেশপ্রেমিক নাগরিক হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম শফিউল্লাহ।শিশু-কিশোররা তার সঙ্গে শপথ করে, “মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তকে বুকে ধারণ করে আমরা নিজেদের বিকশিত করব। সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব, এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করব।” শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা শোনাতে এসে ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আলম শহীদ নিজের যুদ্ধে যাওয়ার পটভূমি তুলে ধরার পাশাপাশি সবচেয়ে কম বয়সে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলামের যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন।তিনি বলেন, ২৩ বছরের বৈষম্য ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।“যখন পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করে, তখন আমরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। প্রথমত, টাঙ্গাইলে আমরা ছোট ছোট গেরিলা দলে হয়ে যুদ্ধ শুরু করি। তখন অনেকে বলত, অস্ত্র নেই কীভাবে যুদ্ধ করবে?“আমরা বলেছি, মায়ের ইজ্জত রক্ষার জন্য সন্তানের অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না।”কিশোর শহিদুল ইসলামের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বয়স কম হওয়ায় তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নেওয়া হচ্ছিল না বলে জানান আনোয়ারুল আলম শহীদ।
“এক পর্যায়ে তাকে নেওয়া হল এবং একটি পাকিস্তানি ক্যাম্পে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়। চালের বস্তার মধ্যে গ্রেনেড দিয়ে পাঠানো হয় তাকে। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে বলে, আমাদের বাড়ি পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে দিয়েছে নানাবাড়িতে যাচ্ছি। ওই বন্ধু তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়।“ক্যাম্পের কাছাকাছি ওই বন্ধুর বাড়িতে রাতে থাকে শহীদুল এবং রাতেই গ্রেনেড অপারেশন চালায়।” বক্তব্যে ফোরামের মহাসচিব সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কোনো প্রথাগত যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ হয় একটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের।মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, “২৩ বছর ধরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি দিক থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে পাকিস্তানিরা। বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। যুদ্ধ কারও ঘোষণার অপেক্ষা করেনি, দীর্ঘ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা অঞ্চলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপক হাছিবুর রহমান বক্তব্য দেন।জাতীয় সঙ্গীত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহালানবিশসহ ফোরামের নারী সেলের সদস্যরা।অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অর্থমন্ত্রী। এক শিক্ষার্থী পরিবেশন করে নৃত্য।