বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের অভয় দিয়ে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, সশস্ত্র বাহিনী আছে। এ দেশের জনগণ আছে। দেশের বাইরে যারা আছেন, তারা আছেন। কাজেই বিএনপির কোনো ভয় নেই, ভয়টা আওয়ামী লীগের। সরকার মনে করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরনি পার হওয়া যায়। সরকার প্রশাসনকে দলীয় নেতাকর্মীদের মতো ব্যবহার করছে। পুলিশকে বাধ্য করা হচ্ছে অন্যায় ও দলীয় কাজ করতে। কিন্তু প্রশাসন যদি একটু সুযোগ পায়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। কেননা, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর খিলক্ষেতের অভিজাত হোটেল লা মেরিডিয়ানের গ্র্যান্ড বলরুমে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেগম জিয়া একথা বলেন। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে নির্বাহী কমিটির সভা শুরু হয়। পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় সভা। এরপর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সভা শুরুর কিছু পরে লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রেকর্ডকৃত ভিডিও বক্তব্য প্রজেক্টরে দেখানো হয়। উদ্বোধনী পর্বে ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার আদালতে দেয়া জবানবন্দি’ নামের একটি পুস্তিকা দেওয়া হয়। জিয়া এতিখানা ট্রাস্ট মামলার বিবরণ ও আইনজীবীদের শুনানি এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতে খালেদার দেওয়া বক্তব্য নিয়েই ৪০ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকা। দুপুরের পর নির্বাহী কমিটির সঙ্গে রুদ্ধাদ্বার বৈঠকে বসেন খালেদা জিয়া। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত চলে। নেতা-কর্মী সকলকে বিদায় দেয়ার পর বেগম জিয়া হোটেল থেকে বের হন।

বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলার রায়কে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, যেকোনো বিপদ মোকাবিলায় সবাই ঐক্যদ্ধ থাকুন। আমি শুধু বলতে চাই, আমি যেখানে থাকি না কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। থাকবো ইনশাআল্লাহ। বিপদ এলে সবাই একসাথে মোকাবিলা করব, সুদিন এলেও আমরা সবাই এক সাথে দেশের জন্য কাজ করব। আমাদের সাহস সঞ্চয় করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।   খালেদা জিয়া বলেন, আমাকে কেউ ভয়ভীতি, লোভ দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না। অতীতেও পারেনি, এখনো পারবে না। আমি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি, আমি দেশের মানুষের সঙ্গে আছি, দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব। আজ এই নির্বাহী কমিটির সভা থেকে আমি সবাইকে বলব, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে বহু সন্ত্রাস হবে, ষড়যন্ত্র হবে, নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করা হবে। আমরা কেউ ভয়ে ভীত হব না। তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হবে শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। সেই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে আমি জনগণকেও আহ্বান করব। আসুন দেশের জনগণ, বিএনপি ও ২০ দল- সকলে মিলে এদেশটা রক্ষা করি, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনি। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করি। ভোটে যাবেন ৬ শর্তে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ছয়টি শর্ত দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শর্তগুলো হলো:ভোট হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আসার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে, সেনাবাহিনী মোবাইল ফোর্স হিসেবে কাজ করবে।যন্ত্রে ভোটের জন্য ইভিএম/ডিভিএম ব্যবহার করা যাবে না। সভায় ছয় শর্ত দেওয়ার পর খালেদা জিয়া নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান তারা এর সঙ্গে একমত কি না। তারা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ হলে সমর্থন জানান। খালেদা জিয়া বলেন, আমরা বলেছি যে, জাতীয় নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। জনগণ যাতে ভোট কেন্দ্রে আসতে পারে সেরকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। খালেদা শর্ত দেন, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এই সংসদ রেখে নির্বাচন হবে না। ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। তারা মাঠে থাকলে জনগণ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে। আমি নির্বাহী কমিটির এই সভা থেকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, ইভিএম-টিভিএম চলবে না। 

নেতারা চান আন্দোলন, খালেদা জিয়া চান ঐক্য
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কোনো ‘নেতিবাচক’ রায় হলে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি চেয়েছেন দলের নেতারা। বেগম খালেদা জিয়া এই নিয়ে বলেছেন, ‘যে কোনো সংকটে’ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রথম অধিবেশন শেষে রুদ্ধদ্বার সভায় ৪১ জন নেতা তাদের বক্তব্যে আন্দোলনকে প্রাধান্য দেন। খালেদা জিয়া সমাপনী ৪ মিনিট বক্তব্য দেন। এসময় তিনি বলেন, আমি এসব কেয়ার করি না। ষড়যন্ত্রকারীরা আমার কিছু করতে পারবে না। আপনার ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। জনগণের দাবি আদায়ে আপনারা আন্দোলনের জন্য তৈরি হোন। আমি সব হারিয়েছি, আমার হারাবার কিছু নেই। আপনারাই আমার সন্তান, আপনারই আমার সব। সভায় সূত্রে জানা যায়, রুদ্ধদ্বার সভায় জেলার নেতাদের বক্তব্য সবার একটাই কথা ‘নেত্রী আপনার কিছু হলে আমরা জীবন দিতে প্রস্তত আছি। কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে, আমরা অতীতেও রাজপথে ছিলাম ভবিষ্যতেও থাকবো।  সভায় উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, সভায় বিগত দিনে আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে নেতার ভূমিকা কঠোর সমালোচনা করেন তৃণমূলের নেতারা। তারা বলেন, আগামী দিনে সবাইকে রাজপথে সক্রিয় থাকতে হবে। বিগত দিনের মতই তৃণমূল রাজপথে থাকবে। নেতা-কর্মীরা শপথ নিয়েছেন- পরিস্থিতি যা হোক না কেনো, শান্তিপূর্ণভাবে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা মোকাবিলা করা হবে। বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান বরকতুল্লাহ বুলু জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ওইদিনের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নির্বাহী কমিটির সভায় শপথ নিয়েছেন দলের নেতারা।
সঠিক রায় দেওয়ার ক্ষমতা বিচারকদের নেই
খালেদা জিয়া বলেন, সর্বোচ্চ আদালত বলছে নিম্ন আদালত সরকারের কব্জায়। পত্রিকায় যা দেখছি তাতে বোঝা যাচ্ছে সঠিক রায় দেয়ার সুযোগ নেই। সঠিক রায় দিলে কী পরিণতি হয় তা তো দেখেছেন। নিম্ন আদালত সরকারের পুরো কব্জায়। কতটা কব্জায় তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা সত্য, সঠিক রায় দেয়ার ক্ষমতা এখন তাদের (বিচারকদের) নেই। 
ফাঁদে পা দিয়ে দলে ভাঙন সৃষ্টি করবেন না
খালেদা জিয়া বলেন, নেতাকর্মীদের বলব ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। বহু ষড়যন্ত্র হবে, অনেক সন্ত্রাস হবে। কিন্তু আমরা ভীত নই। যারা বেইমানি করেনি, আমরা যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসি, তাদের কথা বিবেচনা করা হবে। ক্ষমতাসীনদের ফাঁদে পা দিয়ে দলে ভাঙন সৃষ্টি করবেন না।এক এগারোর সময় বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র হলেও ভাঙতে পারেনি। জিয়াউর রহমান ও তারেক রহমান তৃণমূলে যে ভীত তৈরি করেছে যে কারণে অনেক ষড়যন্ত্র করেও ভাঙতে পারেনি। 
বেইমানদের ওপর নজর রাখছি
দলের সিদ্ধান্ত ‘অমান্যকারীদের’ বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারন করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, যারা বেঈমানি করবে, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চায়, এমন ‘বেঈমানদের’ ওপর নজর রাখছি। যারা এদিক-ওদিক, এক পা এদিক অন্য পা অন্য দিকে রাখবে, তাদের চিহ্নিত করা হবে। এদের মূল্যায়নের জায়গা থাকবে না। এদের তারাও (সরকার) নেবে না, আমরাও নেব না। আমরা আগে একবার ক্ষমা করেছি, ক্ষমা বার বার হয় না।
৩২ ধারা দিয়ে কালাকানুন পাস করতে চাইছে সরকার
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, এটি একটি কালাকানুন। মানুষের কথা বলা তো বন্ধই হয়ে গেছে। এখনো আমাদের দলেরসহ যারা একটু-আধটু বলতে চান, তাদের মুখ বন্ধ করতেই ৩২ ধারা দিয়ে কালাকানুন পাস করতে চাইছে সরকার।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn