ডাকসু নির্বাচন, সময়ের দাবি এখন
পীর হাবিবুর রহমান।।
রাতে ডা. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের ‘স্মৃতির পালে লাগলো হাওয়া’ বইটি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লেখালেখিতে সুপরিচিত না হলেও, পেশায় চিকিৎসক, ঢাকায় বেড়ে ওঠা এ লেখকের মনখানি কবির। নাড়ির টান রয়েছে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর, জল জোছনা মিশ্রিত প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপের সঙ্গে। ছেলেবেলা, শিক্ষাকাল ও ভ্রমণজীবনের সঙ্গে একটি মানবিক জীবনের সহজ-সরল স্মৃতিময় গদ্য উঠে এসেছে বইটিতে। ৩৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মুনিয়ার হাসিমুখ বুকের গভীরে গোপনে লুকিয়ে রাখা থেকে মায়ের মৃত্যু চমৎকারভাবে উঠে এসেছে তার লেখায়। তা যে কাউকেই ওইখানে নস্টালজিক করে তুলতে পারে অনায়াসে।
বহুদিন পর আজকাল ফের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে এনেছি। আগেভাগে ঘুমিয়ে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায় সকাল ৭টায়। চায়ের মগ হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসতেই মন জুড়িয়ে যায়। কোকিলের প্রাণ আকুল করা ডাক বৃষ্টিস্নাত সকালকে এত সুন্দর ও রোমান্টিক মনে হয়— একান্ত গোপনে যেন কার মুখোমুখি বসে থাকতে ইচ্ছে করে। এত সুন্দর সকাল, ফেলে আসা জীবনের অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়। এক ভাবনার জগৎ থেকে আরেক ভাবনার জগতে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল আমাদের সাদাকালো যুগ কতই না সুখের ছিল! গোলাভরা ধান ছিল, পুকুরে মাছ ছিল, আদর্শের রাজনীতি ছিল। নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা নিরাবরণ, সরল, সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত রাজনীতিবিদ যাদের পেশা ছিল আইনজীবী থেকে শিক্ষক, রাজনীতি ছিল তাদের হাতে। নেতারা ছিলেন নেতাদের জায়গায়, কর্মীরা ছিলেন সুশৃঙ্খলভাবে তাদের পেছনে। সেই আদর্শিক মূল্যবোধের রাজনীতির অবক্ষয় সমাজ জীবনে ক্যান্সারের মতো ভাইরাস ছড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে মানবকল্যাণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন রাজনীতি দেখতে দেখতে চলে গেল ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের হাতে। এ বিবর্তনে রাজনীতিতে যেমন রক্ত সঞ্চালন ঘটেনি, তেমনি রাজনীতি হারিয়েছে তার জৌলুস। স্থানীয় রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি পর্যন্ত গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনে মেধা, যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় তারকাখ্যাতি নিয়ে উঠে আসা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর উৎসস্থল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন। সামরিক শাসনমুক্ত বাংলাদেশে ২৭ বছর ধরে ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে করে দেশের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যের ধারাটি হোঁচট খায়নি, মানুষের আস্থা ও সম্মানের জায়গা থেকেই সরে যায়নি, জাতীয় রাজনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাতীয় রাজনীতি দিনে দিনে রূপহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন হতে হতে যৌবনই হারায়নি; ভঙ্গুর হয়েছে।
দিনের পর দিন ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিয়ে লিখেছি। টকশোতে নিয়মিত বলছি। আমি একা নই, অনেকেই বিভিন্ন সময় এ কথা বলছেন। যারা সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতির গৌরব ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব দেখতে চান, পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান, তারাই এটি বলছেন। এ নিয়ে কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। সবাই চান মেধাবী, সৃজনশীল, আদর্শবান, গণমুখী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তৈরির জন্য নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন হোক। সবাই চান, নিয়মিত ছাত্রদের মধ্য থেকে মেধাবী নেতৃত্ব নির্বাচিত হোক প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে। নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন আদর্শিক সুস্থ ধারার, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক তারুণ্যকে ছাত্ররাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করে।
শিক্ষাজীবন শেষে ছাত্ররাজনীতির এই শিক্ষা জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের মহান ব্রতে কাজ করতে শক্তি জোগায়। যার যার কাজের জায়গায় মানবকল্যাণের বা মানুষকে সেবাদানের মনোভাব নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে তাগাদা দেয়। শিক্ষাজীবন শেষে যারা ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে গণসংগঠনে যোগদান করেন তারা সেই দলকে সাংগঠনিকভাবে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় হৃষ্টপুষ্টই করেন না; রাজনীতির চারণ কবিদের মতো রাজনীতিকে আলোকিত করেন। মানুষের কল্যাণে যে রাজনীতি সেটিকে গতিময় করেন। ছাত্ররাজনীতি থেকে গণরাজনীতি পর্যন্ত মানুষের সম্মান ও সমর্থন আদায়ে তারা ভূমিকা রাখেন। আমাদের ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরব ও অহঙ্কারের। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে পায়ে পায়ে ছাত্ররাজনীতি উঠে এসেছে। আমাদের বীরত্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে মহিমান্বিত করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬২-এর শিক্ষা, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, ’৬৯-এর ১১ দফা, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ বেয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একনদী রক্ত, ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদানে অর্জিত বিজয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। আমাদের ছাত্ররাজনীতির একদা যৌবন ছিল স্রোতস্বিনী নদীর মতো। মানুষের অধিকার, গণতান্ত্রের সংগ্রাম, সামরিক শাসনের কবল থেকে হারানো সাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার আদায়ের কর্মীমুখর আন্দোলন সংগ্রামের মালাগাঁথা। হলিউড থেকে বলিউড যেখানে ফিল্মস্টাররাই সুপারস্টার সেখানে আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতির চিরসংগ্রামের পথ হেঁটে তারুণ্যের শক্তি, সমর্থন ও ভালোবাসায় জনগণের হৃদয়ে আসন নেওয়া ছাত্ররাজনীতির নায়করাই ছিলেন সুপারস্টার।
হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নানা মত-পথ থেকে ছাত্ররাজনীতির পথ ধরে যে নেতৃত্ব অভিষিক্ত হয়েছে বারবার তাদের জনমত যাচাই হয়েছে ডাকসুসহ বিভিন্ন কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যাটল বিপ্লবে। ২৭ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখায় জাতীয় রাজনীতি ৫৪ জন নেতা জনপ্রিয় তরুণ নেতাকে পায়নি। সারা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদে এই সময়ের মধ্যে তার সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। শুধু কি তাই, ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যে তারুণ্য ডাকসুসহ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে ’৯০ সালে গণতন্ত্র মুক্ত করেছিল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সেই ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই দিন দিন হরণ করেছে।
২৭ বসন্তজুড়ে এদেশের ছাত্রসমাজ তার প্রাপ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর এ কারণে ছাত্ররাজনীতি অছাত্রদের হাতে চলে গেছে। বড় ছাত্র সংগঠনগুলোতে কমিটি বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসায়ই নয়, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত অছাত্ররা টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, তদবির বাণিজ্যসহ লোভ-লালসার নানা অনৈতিক পথে জড়িয়ে গেছে। মাঝখানে কলঙ্কিত হচ্ছে অতীতের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য। একেকটি ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলায় জেলায় নিয়মিত সম্মেলন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নবীনবরণ উৎসব হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা। ভর্তি পরীক্ষায় ফরম পূরণসহ সার্বিক সহযোগিতার বদলে ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যের অভিযোগ সর্বত্র। নিয়মিত ছাত্রদের মধ্য থেকে নিয়মিত সম্মেলনের ভিতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও জেলাগুলোতে নেতৃত্ব তৈরি করা হচ্ছে না বলেই এ অবস্থা। বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়, একবার কমিটি নিয়ে আর সম্মেলন দূরে থাক, পূর্ণাঙ্গ নতুন কমিটি হয় না। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের আধিপত্যের জন্য ওপর থেকে মনমতো নেতা নির্বাচন করে নিয়ে যেতে সব ধরনের ভূমিকা রাখেন। এতে করে ছাত্ররাজনীতির নিজস্ব অহমের জায়গা ভেঙে গেছে। শিক্ষাঙ্গনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাংগঠনিক তত্পরতা জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে আর নেই।
কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ প্রতিদিনে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানেও ডাকসু নির্বাচনের যে তাগিদ তিনি দিয়েছেন সেটি উল্লেখ করেছিলাম। তিনিও ষাট দশকের কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে উঠে এসেছিলেন। তিনিও গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ভিপি এবং জিএস ছিলেন। আমাদের জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাই করেননি; কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যের পথ ধরে হেঁটে উঠে এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মরহুম অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ড. এমাজউদ্দীন আহমদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু রাজনীতিই নয়, ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন জাতীয় জীবনে সব ক্ষেত্রে দক্ষ নেতৃত্ব, দক্ষ ও শিক্ষিত, অভিজ্ঞ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এসেছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি না হওয়ায় রাজনীতিতে গভীর নেতৃত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। ’ তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছেন। এই সংকট জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ গোটা বাংলাদেশেই সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তি ও ভবিষ্যৎ অন্ধকার থেকে রাজনীতিকে রক্ষা করার গভীর তাগিদ অনুভব করে সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ তার ডাকসুর রানিংমেট ডা. মোস্তাক হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে হাই কোর্টে ডাকসু নির্বাচন চেয়ে রিট করেছেন। মহামান্য হাই কোর্ট সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাসচিব, ঢাবি উপাচার্যসহ চারজনকে এক মাসের মধ্যে জবাব দিতে বলেছেন— কেন ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না? কেন ২৬ বছর ডাকসু নির্বাচন অবৈধভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই কৈফিয়ৎ তলব শুধু ডাকসুর জন্যই নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রবল ঝাঁকুনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্রের সংগ্রামে প্রতিটি মশাল প্রজ্বলনে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ডাকসুসহ ছাত্রসমাজের ভূমিকা ঐতিহাসিক। ইতিহাসের এই শক্তিকে স্তব্ধ করা মানে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই ভঙ্গুর করে দেওয়া। সুলতান মনসুর ষাটের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন স্কুলজীবনে। সিলেটের দুটি কলেজের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসুর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আজকের জাতীয় রাজনীতিতে ষাটের গৌরবময় অতীত নিয়ে এখনো যারা পদচারণা করছেন, এখনো যারা বিবেকের তাড়নায় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও কথা বলছেন তাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, ডাকসু ও ছাত্ররাজনীতি যাদের গৌরবের মুকুট পরিয়ে তৈরি করেছে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আমির হোসেন আমু, হাসানুল হক ইনু, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ শহীদুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, জিয়াউদ্দিন বাবলু অন্যতম। তাদের পথ ধরেই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির যৌবনকালে ডাকসু, রাকসু, চাকসু, বাকসু, জাকসু ও ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যাদের জন্ম দিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, ফজলে হোসেন বাদশা, জাহাঙ্গীর কবির রানা, আবদুল মান্নান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, বাহালুল মজনুন চুন্নু, ডা. মোস্তফা জালাল মহীউদ্দীন, খ. ম. জাহাঙ্গীর, ফজলুর রহমান, মুকুল বোস, শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, আমানউল্লাহ আমান, শিরীন আখতার, ডা. মোস্তাক হোসেন, খায়রুল কবীর খোকন, হাবিবুর রহমান হাবিব, রিজভী আহমেদ, নাজমুল হক প্রধান, এনামুল হক শামীমসহ অনেকের নাম নিতে হয়।
’৬৯-এর ডাকসু জিএস নাজিম কারমান চৌধুরী সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন মেধাবী ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। রাকসুর দুবারের নির্বাচিত জিএস রুহুল কুদ্দুস বাবু এখন হাই কোর্টের বিচারপতি। বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এবং ওবায়দুল হাসান শাহীন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের নেতা ছিলেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচিত জিএস ছিলেন এনায়েতুর রহিম। স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদী সংগঠক মাহবুব উজ জামান আইটি খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদও ছিলেন এক সময়ের ছাত্রনেতা। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ডাকসুতে ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রশাসনে একজন সৎ, দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সব আমলে দায়িত্ব পালন করে এলেও আপাদমস্তক একজন কবি। বর্তমান আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক রাকসুতে ছাত্রলীগ নির্বাচিত নেতা ছিলেন। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনে সততা, দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এককথায় ছাত্ররাজনীতির আলোর পথ ধরে জাতীয়, স্থানীয় রাজনীতিই নয়; সমাজের সর্বক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন কিন্তু ছাত্র রাজনীতি মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়েছে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে। জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বে সংকট সৃষ্টি হওয়ার কারণে ছাত্ররাজনীতি মনেপ্রাণে পছন্দ করতেন না, দূরে দূরে থাকতেন এসব আমলা অবসরে গিয়ে এবং ব্যবসায়ী ঠিকাদাররা, অবসরপ্রাপ্ত আমলারা সেই সুযোগ নিচ্ছেন। ভোগ-বিলাস, আরাম, আয়েশের জীবন কাটিয়ে শেষ জীবনে রাজনৈতিক কর্তৃত্বটাও হাতের মুঠোয় পুরছেন। বড় বড় দলের মনোনয়ন নিতে যাচ্ছেন যখন যারা ক্ষমতায় তাদের আনুগত্য অর্জন করে। অথচ ছাত্রজীবনে তারা ওই দলের আদর্শকে কখনো গ্রহণ করেননি। এই দৈন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের। একুশের প্রথম প্রহর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দায়িত্ব ডাকসুর ওপর অর্পিত হয়। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও মননশীলতার যে বিকাশ ঘটিয়ে আসছিল সেটি ২৭ বছর ধরে বন্ধ। অথচ নিয়মিত ২৭ বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রসংসদ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফি দিয়ে আসতে হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাসকে এক সময় শান্তি নিকেতনের সঙ্গে তুলনা করা হতো। প্রকৃতির নৈর্সগিক দৃশ্য, সবুজ ঘাস ও বৃক্ষশোভিত প্যারিস রোডের মোহমায়ায় আচ্ছন্ন জ্ঞানের মন্দির ছিল পরিপাটি, সাজানো। বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক মিজান উদ্দিনের প্রশাসন যত্রতত্র দোকানপাট ও ভবন নির্মাণ করে ক্যাম্পাসকে শ্রীহীন করেছেন। ঢাকায় জমি কেনা ও গেস্ট হাউস নির্মাণে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। উচ্চ আদালত দুদককে তা তদন্ত করতে বলেছে। ছাত্রসংসদ থাকলে এই অনিয়ম হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে সিনেটে পাঁচজন করে ছাত্র প্রতিনিধি ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতেন।
সবদিক থেকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যে তাগিদ দিয়েছেন সুলতান মনসুর ও ডা. মোস্তাক যে আকুতি নিয়ে রিট করেছেন তা রাজনৈতিক শক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণেই হয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন প্রশ্নে যেন বোধহীন, অনুভূতিহীন হয়ে আছেন। সময়ের দাবি এখন ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন।