দুর্নীতি মামলার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। বুধবার বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে খালেদা বলেন, ‘দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সগৌরবে জানাতে চাই যে, আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি, কোনো দুর্নীতি করেনি।’ এই সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া ২০৩৩ শব্দের একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। তবে তিনি তার আগেরকার বড় সংবাদ সম্মেলনের মতো এদিনও গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি। ১৯৯৩ সালে কুয়েত থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজা ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রায় ১০ বছর পর ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রায়ের দিন ঠিক হয় গত ২৫ জানুয়ারি। পুরান ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করবেন। রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। খোদ খালেদা জিয়া আদালত এবং দলীয় কর্মসূচিতে সাজার আশঙ্কার কথা বলেছেন। তার দাবি, সরকার তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করে রাজনীতিতে বেকায়দায় ফেলতে চায়। বিদেশ থেকে আসা টাকায় ট্রাস্টের নামে কোথায় এতিমখানা তৈরি হয়েছে, সেটি জানাতে পারেননি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।  তবে রায়ের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের একটি টাকাও আত্মসাৎ হয়নি। ‘আমার আইনজীবীরা আদালতে তা প্রমাণ করেছেন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জিয়া অরফানেজের একটি টাকাও তছরুপ হয়নি। সমস্ত টাকা প্রতিষ্ঠানের নামেই ব্যাংকে জমা আছে। এখন সুদাসলে সেই টাকা বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে।’

খালেদা জিয়া বলেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কুয়েতের তৎকালীন আমিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। আর জিয়াউর রহমানের নাম স্বরণীয় করে রাখতে এই টাকা দেন তিনি। সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে এই টাকা নিয়ে আসা হয়। বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘এই অর্থের বিলিবন্টন, তহবিল পরিচালনা অর্থাৎ জিয়া অরফানেজের সঙ্গে কখনও কোনোভাবেই জড়িত ছিলাম না।’ ‘তাছাড়া এই অর্থ সরকারি অর্থ নয় এবং ট্রাস্টটিও প্রাইভেট ট্রাস্ট। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এ মিথ্যা মামলায় আমাকে জড়িত করা হয়েছে।’ এই মামলায় ন্যায়বিচার হলে কিছুই হবে না মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমি বেকসুর খালাস পাব। আর যদি শাসক মহলকে ‍তুষ্ট করার জন্য কোনো রায় হয়, তাহলে তা কলঙ্কের ইতিহাস হয়ে থাকবে।’ বাংলাদেশের মানুষ অন্যায়কারী কাউকেই ক্ষমা করে না, করবে না-এই কথাটির স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে আসা অর্থ আত্মসাতের মামলা করার সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশে ন্যুনতম আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে এই জালিয়াতিপূর্ণ মামলা যারা দায়ের করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়া উচিত। যারা এই মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে তাদেরও সাজা হওয়া উচিত।’ খালেদা জিয়ার দাবি, তিনি প্রহসনের নির্বাচনের বদলে সত্যিকারের নির্বাচনে দেশবাসীর প্রত্যাশার পক্ষে আন্দোলন করছেন বলেই তার ওপর জুলুম, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে।

ন্যয়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা
নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও এই মামলায় সাজার আশঙ্কার কথা এই সংবাদ সম্মেলনেও তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) চাপের মুখে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করার পর আদালত শাসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করতে সফল হবে কি না তা নিয়ে সকলেরই সন্দেহ আছে।’ ‘আদালত রায় দেয়ার বহু আগে থেকেই শাসক মহল চিৎকার করে বলে বেড়াচ্ছে আমার জেল হবে। যেন বিচারক নন, ক্ষমতাসীনরাই রায় ঠিক করে দিচ্ছে।’ ‘আমাকে রাজনীতির ময়দান ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতেই একদলীয় শাসন কায়েম ও খালি মাঠে গোল দেয়ার খায়েশ পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না।’ খালেদা জিয়া বলেন, ‘স্বৈরশাসক আইউব খান (পাকিস্তান আমলে) এক সময় মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে এদেশের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের ‘এবডো’ অর্থাৎ নির্বাচন ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী, সেই ‘এবডো’ টেকে নাই। গণঅভ্যুত্থানে আইউবের পতন ঘটেছিল।’

নিরাপত্তার কড়াকড়ি ও ধরপাকরের সমালোচনা
গত ২৫ জানুয়ারি রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ৩০ জানুয়ারি বিএনপির নেতা-কর্মীরা হাইকোর্টের সামনে প্রিজন ভ্যান ভাঙচুর করে দুই জন নেতাকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় উত্তাপ আরও বাড়ে। পরে অবশ্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে অনুপ্রবেশকারীদের কাজ বলে পিছুটান দেয়ার মাধ্যমে রক্ষণাত্মক অবস্থানে যান। তবে সেই ঘটনার পর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত এক হাজার ১০০ জনকে গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান দিয়েছে বিএনপি। রায়ের আগের দিন ‍বুধবার সারাদেশে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও কয়েকশ বলেও জানিয়েছে দলটি। আবার মঙ্গলবার এক আদেশে রাজধানীতে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মিছিল-সমাবেশ বা জমায়েত হওয়া নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ। জেলা শহরেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা যেন জমায়েত হতে না পারে সে জন্য নজর রাখার নির্দেশনা গেছে পুলিশ সদরদপ্তরের পক্ষ থেকে। পুলিশের এই অবস্থানের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই রায়কে কেন্দ্র করে শাসন মহল আমাদের চেয়েও বেশি অস্থির ও ভীতু হয়ে জনগণের চলাচলের অধিকার প্রতিবাদের অধিকার, সভা মিছিলের সাংবিধানিক অধিকার প্রশাসনিক নির্দেশে বন্ধ করা হচ্ছে।’ ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের ভয়ে ভীতু হয়ে এই হীন পথ খুঁজেছে সরকার। সারাদেশে তারা বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছে। জনগণের প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে তারা এতটাই ভয় পায়!’।

‘তত্ত্বাবধায়কের আমলে দেশ ছেড়ে যাইনি বলে মামলা’
খালেদা জিয়ার অভিযোগ, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকতে তাকে বিদেশে চলে যেতে বলা হয়েছিল। সেই কথায় রাজি না হওয়ায় তার ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। ‘আমাকে এক বছর নয় দিন কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। আমার দুই সন্তানকেও কারারুদ্ধ করে নির্যাতন করেছিল। সেই অবৈধ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল।’ সেই ‘অবৈধ’ সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাসহ তাদের দলের নেতা-কর্মীদের হাজার হাজার মামলা তুলে নিয়েছে। আর আমিসহ আমাদের নেতা-কর্মীদের সেই সব মামলায় হেনস্তা করা হচ্ছে। যোগ হয়েছে হাজারো নতুন নতুন মিথ্যা মামলা।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn