মানাস আইল্যান্ডের বন্দীশিবিরে এক বাংলাদেশির জীবন
মানাস আইল্যান্ড। পাপুয়া নিউগিনির ছোট্ট এক দ্বীপ। গত চার বছর ধরে এই দ্বীপের এক শিবিরে প্রায় বন্দী জীবন রাসেল মাহমুদের। শুধু তিনি নন, তার সঙ্গে আছেন আরও ৭০ জন বাংলাদেশি। আছেন আরও নানা দেশের মানুষ। ইরানি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, সোমালি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। যেভাবে রাসেল মাহমুদ বাংলাদেশের বগুড়া থেকে পাপুয়া নিউগিনির মানাস আইল্যান্ডের এই জীবনে এসে পড়লেন, সেই কাহিনি অনেক দীর্ঘ এবং ভয়ংকর। কিন্তু তারপরও তিনি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান না। মানাস আইল্যান্ডে শরণার্থীদের জন্য তৈরি এক শিবির থেকে তিনি ফোন করেছিলেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের দফতরে। তাঁর একটাই আকুতি, যেন তাদের অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় দেয়া হয়।
“আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না। যদি আমাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আমি আত্মহত্যাই করবো।” এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রাসেল মাহমুদ বর্ণনা করেছেন কিভাবে তার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন এরকম দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। রাসেলের বাড়ি বাংলাদেশের বগুড়ায়। সেখানে তাঁর বাবা-মা এবং এক ছোট ভাই আছেন। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। এরপর কনস্ট্রাকশন খাতে ছোটখাট সাপ্লায়ারের ব্যবসা করতেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো কোন দেশে যাবেন।“অস্ট্রেলিয়ায় বা কানাডায় যেতে চেয়েছিলাম উন্নত জীবনের আশায়।”“আমি ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার একটা উপায় আছে। অনেকেই যাচ্ছে। আমিও সেভাবে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।” যে পথে তিনি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাকে দুঃসাহসিকই বলতে হবে।
দুঃসাহসিক যাত্রা:
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রাসেল মাহমুদ বাংলাদেশ থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া যান। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর যোগাযোগ হয় মানব-পাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে। তাদের অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। তাদেরকে দিতে হয় ৭ হাজার মার্কিন ডলার। এই অর্থ তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। একটি উপকুলীয় এলাকা থেকে নৌকায় করে তারা প্রথমে ইন্দোনেশিয়া রওনা হন। প্রায় ১৮ ঘন্টা নৌকায় ছিলেন। সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন অনেক রোহিঙ্গা, সোমালি, ইরানি। তাদের নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকুলে পৌঁছায়। মেডান শহরে তাদের একটি বাড়িতে রাখা হয় এক সপ্তাহ। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় জাকার্তায়।জাকার্তা থেকে তাদের বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় সুরাবায়া শহরে। সেখান থেকে আবারও নৌকায়। এবারের গন্তব্য অস্ট্রেলিয়ার উপকুল। নৌকায় ছিল প্রায় একশো মানুষ। মাঝারি সাইজের নৌকা। ঘুমাতে হতো নৌকার পাটাতনে। নয়দিন নয়রাত সাগরে ছিলেন।
একদিন সাগরের মাঝখানে দূর থেকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনির একটি জাহাজ। রাসেল মাহমুদ এবং তাদের সঙ্গীরা ছিলেন উল্লসিত। এবার তাদের নিশ্চয় উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হবে অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তাদের ভাগ্য ছিল খারাপ। অস্ট্রেলিয়ান নেভির শিপে উঠার পর তিনদিন বাদে আমাদের ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নিয়ে যায়। অনেক বড় দ্বীপ। একশ ফুট উঁচু। এয়ারপোর্ট আছে। দ্বীপ বড় বড় লাল কাঁকড়া আছে।” “সেখানে আমাদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখে। কয়েকদিন থাকার পর আমরা যখন স্বাভাবিক হলাম, তখন আমাদের বললো তোমাদের আশ্রয় দেয়া হবে না।”
“আমাদের বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া সরকারের নীতি বদলে গেছে। ১৯শে জুলাই এর আগে যারা এসেছে, তাদের অস্ট্রেলিয়া আশ্রয় দিয়েছে। ১৯শে জুলাইর পর থেকে এরা আর শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে না।”
বন্দী শিবিরের জীবন:
ক্রিসমাস দ্বীপ থেকে একদিন তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক দূরে পাপুয়া নিউ গিনির এক ছোট্ট দ্বীপ মানাস আইল্যান্ডে। সেখানেই গত চার বছর ধরে তাদের বন্দী জীবন। মানাস দ্বীপে অস্ট্রেলিয়া এই শিবির তৈরি করেছে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে এমন আশ্রয় প্রার্থীদের আটকে রাখার জন্য। অস্ট্রেলিয়ার নেভি বা কোস্টগার্ড নৌকায় করে তাদের দেশে যাওয়ার চেষ্টার সময় লোকজনকে আটক করে এখানে নিয়ে আসে। এরপর এখান থেকে তাদেরকে যার যার দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার এই কার্যক্রমের তীব্র সমালোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তরফ থেকে। কিভাবে এই দ্বীপে গত চার বছর কাটিয়েছেন রাসেল মাহমুদ? “আমাদের ক্যাম্পে সবই আছে। থাকার জায়গা। খাবার জায়গা। দুই হাজার সিকিউরিটি গার্ড পাহারা দেয় এই ক্যাম্প। প্রায় এক হাজার মানুষ এখানে আটকে রাখা হয়েছে।” গত চার বছর ধরে ক্যাম্পে রাসেল মাহমুদের জীবন একই রুটিনে বাঁধা। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা। এরপর সবাইকে জিমন্যাশিয়ামে গিয়ে একটু শরীর চর্চা করতে হয়। সেখান থেকে ফিরে গোসল করে যেতে হয় ক্লাশে। সেখানে তাদের ইংরেজী শেখানো হয়। ফিরে এসে দুপুরের খাবার। বিকেলে একটু ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা। ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া। ভালো আচরণের জন্য তাদেরকে পয়েন্ট দেয়া হয়। সেই পয়েন্ট দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারেন। ক্যাম্পের ভেতর বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। টিভি, সিনেমা দেখতে পারেন। কিন্তু তারপরও ভালো নেই রাসেল মাহমুদ এবং তাঁর সঙ্গীরা। “আমাদের বলছে দেশে ফিরে যাও। নইলে আমরা তোমাদের জোর করে ফেরত পাঠাবো।”
“সবসময় টেনশনে আছি। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নাই। যদি ডিপোর্ট করে দেশি গিয়ে কি করবো। অনেক মানসিক চাপ প্রয়োগ করছে। আমাদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। স্বাস্থ্যহানি হয়েছে।” রাসেল জানান, মানাস দ্বীপের বন্দী শিবিরে এখন যে এক হাজারের মধ্যে বন্দী আছেন, তাদের মধ্যে ২০৫ জনের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে ৫০ জনের মতো বাংলাদেশি আছেন। তবে ২০ জন বাংলাদেশির আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত হয়েছে। রাসেল এখন কি করবেন? তিনি কি দেশে ফিরে যেতে চান? mযখন টেলিফোনে বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়, তখন তারা দেশে ফিরে যেতে বলেন। “আমি কিভাবে যাবো। ১২ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য। এখন কোন মুখে দেশে ফিরে যাবো? কিভাবে তাদের মুখ দেখাবো। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না।” তাহলে আপনি এখন কি করবেন? “আত্মহত্যা ছাড়া আর উপায় নেই। শুধু আমি না, আমার সঙ্গে যারা আছে, তাদেরও একই চিন্তা। আপনি লিখে রাখেন, আমি রাসেল মাহমুদ, যদি আমাকে দেশে ফেরত পাঠায়, আমি আত্মহত্যাই করবো।”