তিন বছরে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন তিন হাজার ৩৩৯ নারী। নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকায় দেশটিতে নারীদের পাঠায় না অধিকাংশ দেশ। কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি বছর বাড়ছে বাংলাদেশি নারী কর্মীর সংখ্যা। সৌদির ক্ষেত্রে কাজ করছে এক অলিখিত শর্ত- নারীদের না পাঠালে পুরুষ কর্মী নেওয়া হবে না। এ ছাড়া একজন নারী কর্মী পাঠিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি পায় দুই হাজার ডলার। একদিকে শর্ত, অন্যদিকে মুনাফ- এ দুই কারণে নিরাপত্তা না থাকা সত্ত্বেও শ্রমবাজার খোলা রাখার স্বার্থে নারীদের পাঠাচ্ছে বাংলাদেতিন বছরে নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন তিন হাজার ৩৩৯ নারী। নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকায় দেশটিতে নারীদের পাঠায় না অধিকাংশ দেশ। কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি বছর বাড়ছে বাংলাদেশি নারী কর্মীর সংখ্যা। সৌদির ক্ষেত্রে কাজ করছে এক অলিখিত শর্ত- নারীদের না পাঠালে পুরুষ কর্মী নেওয়া হবে না। এ ছাড়া একজন নারী কর্মী পাঠিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি পায় দুই হাজার ডলার। একদিকে শর্ত, অন্যদিকে মুনাফ- এ দুই কারণে নিরাপত্তা না থাকা সত্ত্বেও শ্রমবাজার খোলা রাখার স্বার্থে নারীদের পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। শ। জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। 

শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠায় না। ২০১১ সালে ফিলিপাইনের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দলের তদন্তে উঠে আসে, সৌদি আরবে প্রবাসী নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে তারা নারীদের পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৮ হাজার ২৫৫ বাংলাদেশি চাকরির জন্য বিদেশে গেছেন, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ৫ লাখ ৫১ হাজার জন গেছেন সৌদি আরবে। গত বছর ৮৩ হাজার নারী কর্মী দেশটিতে গেছেন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৮ হাজার। তার আগের বছর ছিল ২০ হাজার ৯৫২ জন। তিন বছরে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৯২ নারী সৌদি আরবে গেছেন। এর মধ্যে ফেরত এসেছেন ৩ হাজার ৩৩৯ জন। এ সংখ্যাকে বড় করে দেখতে রাজি নন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। তিনি বলেন, ‘৭ লাখ নারী কর্মী বিদেশে চাকরি করেছেন, নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসার সংখ্যা হাজারেরও কম। শতকরা হিসেবে এক শতাংশও নয়।’ মন্ত্রী জানান, নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ পেলে তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

প্রতিকার করা হয়। প্রয়োজনে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। নানা অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল সৌদি আরব। দেশটির শ্রমবাজার আশির দশক থেকে বাংলাদেশিদের অন্যতম প্রধান কর্মস্থল। অন্য কোনো দেশ থেকে না পেয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিনা খরচে নারী কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় দেশটি। সৌদির মনোভাব ছিল, নারী কর্মী পাঠালে পুরুষ কর্মী নেওয়া হবে। মাসিক মাত্র ৮০০ রিয়াল (১৬ হাজার টাকা) বেতনে ২০১৫ সালে গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ। সৌদি আরব পুরুষ কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, একজন নারী কর্মী পাঠালে সৌদি আরবের কাছ থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা পায় এজেন্সি। এর বিপরীতে পুরুষ কর্মীর ভিসাও পাওয়া যায়। একজন পুরুষ কর্মী পাঠিয়ে দুই-আড়াই লাখ টাকা লাভ হয় এজেন্সির। সব মিলিয়ে একজন নারী কর্মী পাঠাতে পারলে প্রায় ৪ লাখ টাকার ব্যবসা। এ কারণেই নারী কর্মী পাঠানো বছর বছর বাড়ছে। বিনা খরচে পাঠানোর কথা থাকলেও দালালরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক নারী কর্মীদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারী কর্মীরা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতেও উঠে এসেছে তারা বিদেশ যেতে দালালকে টাকা দিয়েছেন। এ অভিযোগের জবাবে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহেমদ বলেন, কর্মী এজেন্সির সিদ্ধান্তে যায় না। সরকার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দেওয়ায় কর্মীর ইচ্ছায় এজেন্সি তাকে পাঠায়। সেখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হলে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সম্প্রতি একাধিকবার বলেছেন, তারা অভিযোগ পান না। 

২০১৫ সালে নারী কর্মী পাঠানোর শুরুতে বিভিন্ন সংগঠন মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তখন মন্ত্রণালয় বলেছিল, নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস যে কাজে আসেনি তা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে ৩২৪ নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশটির রিয়াদ ও জেদ্দার সেফ হোমে আশ্রয় নেন, তাদের ফিরিয়ে আনে মন্ত্রণালয়। জেদ্দা সেফ হোমে ২০১৭ সালে আশ্রয় নেন ৯৫৩ নারী। তাদের মধ্যে ৯৫০ জন দেশে ফিরে আসেন। তিন বছরে এই সেফ হোমে আশ্রয় নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ৬৪৮ জন। রিয়াদ সেফ হোমে একই সময়ে আশ্রয় নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ৬৯১ জন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যে ৯০ শতাংশ নারী গৃহকর্মীই নির্যাতনের শিকার হন। কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না।গত জানুয়ারি মাসে দেশে ফেরা ৩২৪ নারীর মধ্যে ৩২ জনের সঙ্গে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কথা হয়। তাদের ২১ জন জানান, তারা কর্মস্থলে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাকিরা শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার। চারজন জানান, ঠিকঠাক বেতন ও খাবার দেওয়া হতো না। তবে সবার অভিযোগ, অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। কাজের চাপে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন- এমন আহত কর্মীও রয়েছেন। সম্প্রতি নির্যাতিত ২৪ নারী দেশে ফিরেছেন। তাদের অন্তত দু’জন ছিলেন ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা।  সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহও স্বীকার করেছেন নারীরা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার। তিনি বলেছেন, যারা সেফ হোমে এসেছেন, তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশি নারীদের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দূতাবাস কোনো পদক্ষেপ নেয় না- এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, যে কোনো বাংলাদেশি আইনি পদক্ষেপ নিতে চাইলে দূতাবাস তাকে সহায়তা করে। 

গত মাসের শেষ সপ্তাহে সৌদি আরব-ফেরত একজন নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যৌন নির্যাতনের কারণে তার যৌনাঙ্গে সংক্রমণ দেখা দেয়। ওই নারীকে চিকিৎসা সহায়তা দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যান। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কথা বলতে চান না। চলতি মাসের মাঝামাঝি আবার যোগাযোগ করা হলে জানান, একই পরিবারের তিনজন পুরুষ তাকে যৌন নির্যাতন করেছে। তারা সম্পর্কে ভাই ও ভাতিজা। মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন খুবই সাধারণ ঘটনা। তাদের কথায় রাজি না হলে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন সাতক্ষীরার এক নারী। তিনি এখনও সৌদি আরবের কারাগারে। তার ভাই দীর্ঘদিন মন্ত্রণালয়ে ঘুরেছেন বোনকে উদ্ধারের চেষ্টায়। মামলা চলমান থাকায় তাকে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। ইউনাইটেড ওভারসিজ নামের যে এজেন্সি ওই নারীকে পাঠিয়ে ছিল, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। ওই নারীর ভাই বলেছেন, ১৫ মাস ঘুরেও বোনকে ফিরে পাননি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তবে জেদ্দায় নিযুক্ত শ্রম কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামের দাবি, নির্যাতনের ঘটনা অতীতের তুলনায় কমে এসেছে।  গত ৯ জানুয়ারি দেশে ফেরেন হবিগঞ্জের কারুনা বেগম। তিনি জানান, ১৪ মাস সৌদি আরব ছিলেন। এ সময় তিনি দু’বার কাজ পরিবর্তন করেন। সব জায়গায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মালিকের মারধরে অতিষ্ঠ হয়ে সেফ হোমে আশ্রয় নেন তিনি। দেশে ফিরিয়ে আনার কারণ হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নথিতে স্বীকার করা হয়েছে, কারুনা বেগম মারধরের শিকার হয়েছেন। কারুনা বেগম জানান, তিনি একটি একান্নবর্তী পরিবারে কাজ করতেন। ভোর ৫টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত বিরামহীন কাজ করতে হতো। একটু দেরি হলেই মারধর করা হতো। অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেফ হোমে আশ্রয় নেন। একই অভিযোগ করেন কুমিল্লার সায়মন বেগম। প্রবাসী নারী কর্মীদের সংগঠন বমসার পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী নারী গৃহকর্মীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন খুবই সাধারণ ঘটনা। শুধু প্রতিশ্রুতিতে এ পরিস্থিতি পাল্টাবে না। এর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। নারীরা দেশে যোগাযোগ করতে পারেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক মোবাইল ফোন রাখার সুযোগ দিতে হবে। দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে। গৃহকর্তাকে বোঝাতে হবে, তার বাসায় কর্মরত কর্মীকে নির্যাতন করলে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। 

সূত্র: সমকাল

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn