‘কেন কথা রাখলে না সুন্দরী?’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমজাদ হোসেন। মলিন মুখ, ছলছল চোখ। কিছুক্ষণ পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন। এরই মধ্যে ময়নাতদন্ত করার জন্য উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা এবং ওয়ার্ডবয়রা তার কাছে থেকে এটা-সেটা জেনে নিচ্ছেন। কখনও প্রশ্ন করছেন, কেন বিষ খেলো? বিষ কি খেয়েছে, না নিজে খুন করে বিষ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন?এ চিত্র গত বুধবারের (১১ এপ্রিল)। মাগুরার আমজাদ হোসেনের স্ত্রী সুন্দরী খাতুন গত ৩০ মার্চ বিষ খেয়েছিলেন। এরপর ১০ দিন তিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর ১০ এপ্রিল ঢাকা মেকিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। দুজনে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। চার বছরের সংসারে তাদের আছে এক সন্তান। এরই মধ্যে অনেক বার উচ্চারিত প্রশ্নই আরেকবার করা হয় আমজাদ হোসেনকে: কেন তার স্ত্রী সুন্দরী বিষ খেয়েছিলেন? নিজেকে কিছু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন (৩০ মার্চ) বিকাল বেলায় আমরা বাড়িতে ছিলাম। আমার ছেলেটা একটা গেঞ্জি পরতে চাইছে। সাদা রঙের গেঞ্জিটা নতুন। আমার স্ত্রী (সুন্ দরী খাতুন) বলেছে যে, এটা এখন তোমাকে পরতে দেবো না। কয়দিন পরে পহেলা বৈশাখ তখন পরবে। আমার ছেলেটা খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি বলেছি, কাঁদছে যখন, তখন দিয়ে যাও। এটা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এরপর সে রাগ করে ওদের বাড়িতে চলে গেছে। আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ি পাশাপাশিই। সেই বাড়িতে যাওয়ার পর ওর মা-বোনেরা যা-ই হোক ওর পক্ষ নেয়নি। তারা ওকে বুঝিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর সে ফিরে এসে রাগ করে বিষ খেয়ে ফেলেছে।’ আমজাদ হোসেন বলেন, “বিষটা খাওয়ার পরই সে বুঝতে পারে যে সে ভুল করেছে। তখন আমাকে বলে যে, ‘এটা আমি কী করলাম? আমি কেন বিষ খেলাম?’ যেখানেই দরকার নিয়ে গেছি। মাগুরা হাসপাতালে ওয়াশ করে বিষটা বের করেছে। এরপরও লাংসে এটা চলে গেছে।”
স্ত্রীকে বাঁচাতে তিনটি হাসপাতাল ঘুরেছেন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিষ খাওয়ার পর আমি সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। মাগুরাতে তিন দিন হাসপাতালে ছিলাম। এমননিতে শারীরিকভাবে ভালো, কিন্তু তার ফুসফুসে ঘা হয়েছে। বড় ডাক্তার বললেন যে, আপনি রক্ত পরীক্ষা করেন। রক্ত পরীক্ষা করে বললেন যে, ক্রিটেনিন তো বেড়ে গেছে। আপনি ডায়ালায়সিস করেন। ওর ক্রিটেনিন ছিল ছয় পয়েন্ট সাত। ডায়ালায়সিস করে ক্রিটেনিন দুইয়ে নেমে এসেছে। এরপর ডাক্তার বলেছেন যে স্বাভাবিক। আমি প্রথমে ওকে মাগুরা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। এরপর ফরিদপুর হাসপাতালে নিয়ে গেছি। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। গত ৩০ মার্চ সে বিষ খেয়েছিল। ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর গতকাল ১০ এপ্রিল মারা গেল। এখন লাশ পেলে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কবর দেবো। তিনি বলেন, ‘গতকাল মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) খুবই শ্বাসকষ্ট হয়েছে। আমরা এরপর অক্সিজেন লাগালাম। দেখলাম যে ও তখন স্বাভাবিক হলো। তখন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে ওকে ভাত খাওয়ালাম। বলল যে, ‘আমার জন্য মাছ নিয়ে আসো।’ এরপর মাছ এনে ওকে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ালাম। ভাত খাওয়ার পর স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পরে প্রচুর শ্বাসকষ্ট। অক্সিজেন দিয়ে কাজ হচ্ছে না। এরপর ডাক্তার আলাদা মেশিন কিনে আনতে বললেন, ওটা এনে দিলাম। এরপরও স্বাভাবিক হচ্ছে না। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন, এনে দিলাম। ডাক্তার বললেন যে, এই ওষুধেও যখন কাজ হচ্ছে না তখন আইসিইউতে নিতে হবে। আমি বললাম যে তাহলে আইসিইউ লিখে দেন। ডাক্তার আইসিইউ লিখে দিয়েছে নিয়ে যাওয়া হয়নি এর আগেই মারা গেছে।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমজাদ বলেন, “মা-বাবার এক মেয়ে ছিল তো, খুবই অভিমানী ছিল। আমরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম। কোনোদিন তেমন কোনও ঝগড়াঝাটি হয়নি। ও কোনোদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। আমিও করিনি। আমাদের চার বছরের সংসার। এক ছেলে আয়মান, ওর বয়স তিন বছর। ’তিনি বলেন, ‘গতকাল খুব কান্নাকাটি করছিল যে, ‘আমি এই যে কাজটা করেছি, এটা আমার করা ঠিক হয়নি। অনেকের সংসারে অনেক ঝামেলা থাকে। আমি কেন এটা করলাম। দোষ আমার। আমার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি। আল্লাহ তুমি আমাকে ভালো করে দাও। আমি নিয়মিত নামাজ-রোজা করবো। আমি ভালো হয়ে থাকবো।’ এমন কথাও বলেছে। ”সুন্দরীর স্মৃতিচারণ করে আমজাদ বলেন, ‘ও তো বলেছিল— একসাথে থাকবো সারাজীবন! কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখলো না। মানুষ তো বিষ খেয়ে মরে যায়। এটা দেখে ও বলতো, মানুষ কেন বিষ খায়? আমি কোনোদিন বিষ খাবো না। এমন কথা বলতো। কিন্তু সে এমন করলো, আমি কী বলবো? ’ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতাও। এ প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে দিতো। ডেইলি তিন থেকে চার হাজার টাকার রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়েছে। এখানকার মেডিক্যাল অফিসাররা রক্ত পরীক্ষা করতে দেন, স্লিপ লিখে দেন, স্লিপের উল্টো দিকে কোথায় টেস্ট করাতে হবে তা লেখা থাকে। ওই জায়গা থেকেই টেস্ট করাতে হয়। অন্য জায়গা থেকে টেস্ট করালে তা নিবে না। প্রত্যেকটা রক্ত পরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হয়। এটা একটা সরকারি হাসপাতাল, কিন্তু খুবই দুর্নীতি। ট্রলিম্যান যে ট্রলিটা ঠেলে দেবে এটার জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়। প্রত্যেকটা জিনিস ব্যবহার করার জন্য টাকা দেওয়া লাগে। এখানে ওর পিছনে অনেক টাকা খরচ হলো, কিন্তু ওকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারলাম না।’ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘মানুষ ভুল করে যখন রাগ হয়, তখন বুঝতে পারে না যে কত বড় ভুল করেছি! এটা আসলে কেন করলো কী বলবো!’