ঐতিহ্যের কাবাডি এখন বিলুপ্তির পথে
কাবাডি বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এই খেলাকে বিভিন্ন নাম দিয়ে খেলে থাকেন। বাংলাদেশে এই খেলা হাডুডু নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন নামে খেলে থাকে। কাবাডি যেহেতু আঞ্চলিক খেলা তাই তেমন নিয়ম-কানুন ছিল না। নানা জায়গায় আইন কানুনের সামান্য ব্যতিক্রমে এ খেলা অশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশের ফরিদপুরে কাবাডি খেলার প্রথম সূচনা হয় বলে জানা যায়। গ্রামাঞ্চলে আধুনিক খেলাধুলা প্রসারের পূর্বে এই হা-ডু-ডু ছিল চিত্তবিনোদনের অন্যতম উৎস। বিত্তবান ব্যক্তিরা এ খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বর্তমানে কাবাডি আন্তর্জাতিক ভাবেও খেলা হয়। এই খেলা সাধারণত কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সব ধরনের ছেলেরা খেলে থাকে। সাধারণত বিশেষ উৎসব বা পালা-পার্বনে বেশ আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে কাবাডি খেলার আয়োজন করা হয়। কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়েছে। পূর্বে কেবল মাত্র গ্রামে এই কাবাডি খেলার প্রচলন দেখা গেলেও বর্তমানে সব জায়গায় কাবাডি খেলা প্রচলিত হয়েছে।
গ্রামে ধুমধামের মাধ্যমে এ খেলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। গ্রামের প্রধান ব্যক্তি এমনকি জমিদার পর্যন্ত এ খেলা উপভোগ করতেন। বিজয়ী দলকে ষাড়, খাসি, বড় পিতলের কলসী কিংবা সোনারূপার পদক দেয়া হতো। এ জন্য ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজিয়ে প্রতিযোগিতার স্থানকে সরগরম করে রাখতো। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯ শতাব্দীতে কাবাডি খেলা হুটুটু, ছেড়গুড় বা ডুডুডু ইত্যাদি নামে প্রায় সর্বত্র খেলা হতো। শ্রীলংকায় গুডু, বাংলাদেশে হাডুডু, থাইল্যান্ডে যিকুব, পাকিস্তানে হাডুডু, ভারতে কাবাডি নামে খেলা হতো।ভারতীয় উপমহাদেশে কাবাডির উৎপত্তি হলেও সঠিকভাবে কার মাধ্যমে ঠিক কোন জয়গায় এর প্রচলন হয়েছে তা জানা যায় না। ভারতের মহারাষ্ট্রে ২০ শতকের প্রথম দশকে শ্রী দত্ত আর পারামজাশে এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে সাঁতারো জেলা ও এর আশেপাশে যামিনী নামে একটি পদ্ধতিতে যাতে একটি খেলোয়াড় আউট হলে আবার খেলায় ফিরে আসতে পারতো না। বরিশালে এ খেলা ছুকিতকিত নামে খেলা হত। পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় যে তিনি শৈশবে এই খেলাতে অংশ নিয়েছেন। ১৯১৬ সালে ডিএম কল্যাণ পারকার বোম্বাইতে আর্থ ক্রীড়া মন্ডল প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই মন্ডলে তিনি এ খেলার প্রচলন করেন। কে কে বান্দের গঠিত ভারতীয় শ্যাম সেবক মন্ডলে কাবাডি খেলার অনুশীলন করা হতো। ১৯৩২ সালে হাডুডু খেলার আইন প্রণীত হয়। ভারতীয় অলিম্পিক এসোসিয়েশনের পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় অলিম্পিক গেমস প্রতিযোগিতায় এ খেলাটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯২৩ সালে কলকাতার একজন খ্যাতনামা সমাজসেবী ও শিক্ষক ছাত্রচার্য নারায়ণ চন্দ্র ছাত্র সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং খেলাধুলা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে কলকাতা ও বাংলাতে হাডুডু খেলার প্রচলন করেন নারায়ণ চন্দ্রের উদ্যোগে কাবাডি খেলার মাধ্যমে দেশের তরুণদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা তৎকালীণ ব্রিটিশ সরকার সুনজরে দেখেনি। তাই ১৯৩১ সালে কাবাডি খেলা বন্ধ ও ছাত্র সমিতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তখন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। জেমস বুকাননও এই আদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে ছাত্র সমিতির সাথে সহযোগিতা করেন।
১৯৫০ সালে ভারতীয় জাতীয় কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। এরপর থেকে কাবাডি খেলার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। ১৯৫৩ সালে কাবাডি খেলার আইন কানুন প্রণীত ও ১৯৬০ এবং ১৯৬৬ সালে কাবাডি খেলার আইন সংশোধিত হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের দুজন কর্মকর্তা বাংলার আসানসোলে ভারতীয় জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা দেখতে যান।
দেশে ফিরে কাবাডি ফেডারেশন গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে এশিয়ান এ্যামেচার কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কাবাডি টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। ফিরতি টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিং এশিয়াডে কাবাডি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শুরু হয় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কাবাডি খেলা। কাবাডি ফেডারেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রিমিয়ার কাবাডি লীগ, ১ম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তঃজেলা, জাতীয় যুব ও জাতীয় স্কুল কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
খেলার নিয়মাবলী
মাঠঃ
কাবাডি খেলার বালকদের মাঠ লম্বায় ১২.৫০ মিটার চওড়ায় ১০ মিটার হয় এবং বালিকাদের কাবাডি খেলার মাঠ লম্বায় ১১ মিটার এবং চওড়ায় ৮ মিটার হয়। খেলার মাঠের ঠিক মাঝখানে একটি লাইন টানা থাকে যাকে মধ্যরেখা বা চড়াই লাইন বলে। এই মধ্য রেখার দুই দিকে দুই অর্ধে দুটি লাইন টানা হয় যাকে কোল লাইন বলে। মৃত বা আউট খেলোয়াড়দের জন্য মাঠের দুই পাশে ১ মিটার দূরে দুটি লাইন থাকে যাকে লবি বলা হয়।
সদস্যঃ
প্রতি দলে ১২ জন খেলোয়াড় অংশ নেয়। কিন্তু প্রতি দলের ৭ জন খেলোয়াড় একসাথে মাঠে নামে। বাকি ৫ জন অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে থাকে। খেলা চলাকালীন সর্বাধিক তিন জন খেলোয়াড় পরিবর্তন করা যাবে।
সময়ঃ
৫ মিনিট বিরতি সহ দুই অর্ধে পুরুষদের ২৫ মিনিট করে এবং মেয়েদের ২০ মিনিট করে খেলা হবে। খেলা শেষে যেই দল বেশি পয়েন্ট পাবে সাই দলই জয়ী হবে। দুদলের পয়েন্ট সমান হলে দুঅর্ধে আরও ৫ মিনিট করে খেলা হবে। এরপরেও যদি পয়েন্ট সমান থাকে তবে যে দল প্রথম পয়েন্ট অর্জন করেছিল সে দলই জয়ী হবে।
পয়েন্টঃ
যদি কোন খেলোয়াড় মাঠের বাহিরে চলে যায় তাহলে সে আউট হবে। এভাবে একটি দলের সবাই আউট হলে বিপক্ষ দল একটি লোনা(অতিরিক্ত ২ পয়েন্ট) পাবে। মধ্যরেখা থেকে দম নিয়ে বিপক্ষ দলের কোন খেলোয়াড়কে(একাধিক হতে পারে)স্পর্শ করে এক নিঃশাসে নিরাপদে নিজেদের কোর্টে ফিরে আসতে পারলে, যাদের কে স্পর্শ করবে সে বা তারা কয় জনই আউট হবে। এভাবে যতজন আউট হবে তাদের প্রত্যেকের জন্য এক পয়েন্ট পাওয়া যাবে।
সতর্কতাঃ
এক নিঃশাসে স্পষ্ট ভাবে পুণঃপুণঃ কাবাডি বলে ডাক দেওয়াকে “দম নেওয়া” বলে। এই দম মধ্যরেখা থেকে শুরু করতে হবে।বিপক্ষ কোর্টে একসাথে একাধিক আক্রমণকারী যেতে পারবে না। কোন আক্রমণকারী বিপক্ষ দলের কোর্টে দম হারালে এবং বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় তাকে স্পর্শ করতে পারলে সে আক্রমণকারী আউট বলে গণ্য হবে।