বিনামূল্যের বই- তিনশ’ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে জটিলতা
প্রাথমিকের প্রায় ১১ কোটি বইয়ের টেন্ডার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বইয়ের প্রতি ফর্মার জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু টেন্ডারে অংশ নেয়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এবার বইয়ের দাম হাঁকিয়েছে ২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ৯৩ পয়সা পর্যন্ত। গড়ে ২ টাকা ৭৫ পয়সা প্রতি ফর্মার দাম পড়েছে। এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো টেন্ডার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি হওয়ায় রি-টেন্ডার করতে চায়। অন্যদিকে অক্টোবরের মধ্যে বই দিতে হলে এ টেন্ডার বহাল রেখে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার দাবি জানিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এনসিটিবির সূত্রে জানা গেছে, গত বছর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকের বই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম দামে ১ টাকা ৯৫ পয়সায় ছাপায়। প্রাথমিকে প্রতি বই গড়ে ১২ দশমিক ৬৮ ফর্মা। সে হিসেবে প্রতি বইয়ের দাম পরে ২৪ টাকা ৬৪ পয়সা। এবার সেই বই গড়ে ২ টাকা ৭৫ পয়সা দরে টেন্ডার করা হয়েছে। এতে প্রতি বইয়ের দাম পড়বে ৩৪ টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি বই গত বছরের চেয়ে ১০ টাকার বেশি দাম পড়ছে। এতে প্রায় ১১ কোটি বইয়ের জন্য ১১১ কোটি টাকা বেশি বেশি খরচ পড়বে। প্রাক্কলিত দর ৩৫৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বর্তমান টেন্ডারে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের দর অনুযায়ী কাজ করতে হলে সরকারের অতিরিক্ত আরো ১১১ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে।
এ জটিলতার মধ্যে গত সোমবার মূল্যায়ন কমিটির বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। বৈঠকে ৫ জনের মধ্যে ২জন রি-টেন্ডারের বিপক্ষে মত দিলেও বাকিরা নীরব ছিল। এ অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ফের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ জটিলতা দূর করতে এবার শিক্ষামন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছে এনসিটিবি। সংস্থাটির চেয়ারম্যানসহ একটি গ্রুপ দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে হটিয়ে ভারতের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে তৎপরতা শুরু করেছেন বলে জোর অভিযোগ উঠেছে। এজন্য এ গ্রুপটি রি-টেন্ডারের পক্ষ মত না দিলেও নীরব থেকেছেন। মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা চেয়ারম্যানের এ অপতৎপরতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন। তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুরো জটিলতার বিষয়টি অবহিত করবেন বলে জানিয়েছেন।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন-১) নেছার আহমদ বলেন, পিপিআরের (সরকারি ক্রয়নীতি) বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। সরকারের টাকা সাশ্রয় এবং নির্ধারিত সময়ে বই পৌঁছানো দুটিকে একসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সব মিলিয়ে সঠিক সমাধানের পথ বের করতে আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই বছর ধরে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দামে বইয়ের কাজ করলেও এবার বেশি দামে অংশ নেয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি, বইয়ের মূল কাঁচামাল কাগজ, আর্ট পেপার ও কালির দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। এ ছাড়াও নির্বাচনী বছর হওয়ায় পোস্টার, লিফলেট ছাপানোর চাপ থাকবে। এতে কাগজের দাম গত বছরের চেয়ে এবার টন প্রতি বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এটি দিন দিন আরো বাড়বে। গত ডিসেম্বরে প্রক্কালিত দরের সঙ্গে বর্তমান বাজার কোনোভাবে মিলবে না। কারণ, চার মাসে ডলারের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা। আর সিরিয়ায় আমেরিকা, বৃটেন ও ফ্রান্সের হামলার পর আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের প্রচুর কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এ সুযোগে পেপার মিলগুলো কাগজের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ দাম চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। চেয়ারম্যান ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার তৎপরতা চালালেও ভারতে কাগজের প্রচণ্ড সংকট চলছে বলে জানা গেছে। দেশের একটি বড় কোম্পানি ভারতে কাগজ রপ্তানি করছে। এছাড়া ভারত ২০১৬ সালে বই দিতে দিতে মার্চ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এ অবস্থায় ভারতকে বই না দেয়ার পক্ষে মূল্যায়ন কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিকের বই ৮০ গ্রাম জিএসএম কাগজে ছাপানো হয়। আর এ বইয়ের কাগজের ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) ৮৫ গ্রাম। প্রাথমিকের বইয়ে রি-সাইক্লিং পেপারে ছাপানো যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বাড়ায় বেড়েছে কাগজের দাম ও আর্ট পেপারের দামও। গত বছর এনসিটিবি ৬০ গ্রাম জিএসএমের এক টন কাগজ কিনেছিল ৬১ থেকে ৬৩ হাজার টাকায়। বর্তমানে এই কাগজের বাজার মূল্য সাড়ে ৯৫ হাজার টাকা। আর ৮০ জিএসএম কাগজের দাম এক লাখের বেশি। আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার প্রাক্কলিত বাজার দর গত ডিসেম্বরে নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ডলারের দাম বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজ ও আর্ট পেপারের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। যে কারণে ঠিকাদাররা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি দরে বই ছাপার টেন্ডার জমা দিয়েছেন। আর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলিত দরের বিষয়টি নিয়ম অনুযায়ী জানায়নি। এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর প্রতি ফর্মা এক টাকা ৯৫ পয়সায় ছাপিয়েছে ঠিকাদাররা। এবার প্রাক্কলিত বাজার দর নির্ধারণ করা হয়েছে দুই টাকা ২৫ পয়সা। আর ঠিকাদাররা দর দিয়েছে দুই টাকা ৬৩ পয়সা থেকে দুই টাকা ৯৩ পয়সা। গত ১২ই এপ্রিল দরপত্র খোলা হয়েছে। পরবর্তী ২৮ দিনের মধ্যে বই ছাপার জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে এনসিটিবিকে চুক্তি করতে হবে। কিন্তু প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি দর দেয়ায় বই ছাপা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে এনসিটিবির কাছে তিনটি পথ আছে। এক. পিপিপি’র ৯৮ ধারার ২৫ এ বলা আছে প্রাক্কলিত বাজার দরের চেয়ে বর্তমান বাজার দরে বেশি সেক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। দুই. রি-টেন্ডার আহ্বান করা। তিন. নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা। এনসিটিবির কর্মকর্তারা প্রথমটির পক্ষে। নতুন করে বা রি-টেন্ডার করলে আরো ঝামেলা বাড়ছে। বিশেষ করে নতুন করে টেন্ডার দিতে হলে দরপত্রে অংশ নেয়া ঠিকাদারদের অন্তত ৪২ দিন সময় দিতে হবে। এরপর আরো ২৮ দিনের প্রক্রিয়া। নির্বাচনী বছর হওয়ায় সরকারের অক্টোবরের মধ্যে শতভাগ বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো নিয়ে চরম শঙ্কা দেখা যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ সফল প্রজেক্ট নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাই না বলে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে। তাই যে কোনো মূল্যে সরকারের শেষ বছর বইয়ের কাজ যথাসময়ে আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য একটি মূল্যায়ন কমিটি আছে। তারাই বিষয়টি দেখছে। এ ব্যাপারে আমি কোনো ধরনের মধ্যস্থতা করতে চাই না। কমিটি যেভাবে সুপারিশ করবে সেভাবেই হবে। এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান মানবজমিনকে বলেন, এনসিটিবির গত বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি দামে কাগজ কিনেছে। আর টেন্ডার গড়ে ৩৬ শতাংশ দাম বেড়েছে। এটি খুবই যুক্তি সঙ্গত। তারপরও সরকার যদি রি-টেন্ডার করে এটাকে সাধুবাদ জানাবো। তবে এখানে ৪৫ দিন এবং আরো ২৮ দিনের সময়ের ব্যাপার আছে। এতে যদি কোনো ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয় এর দায়-দায়িত্ব এনসিটিবিকে নিতে হবে। তিনি বলেন, যেদিন টেন্ডার ওপেন হয়, সেদিন ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা। আজ সেই ডলারের দাম ৮৬ টাকার বেশি। এ ডলারের দাম বাড়া মানে বাংলাদেশি টাকায় ১ টাকা ৬১ পয়সার হেরফের হওয়া। এ বিষয়গুলো এনসিটিবিকে বুঝতে হবে।