গোলাম মওলা সিরাজ, কুড়িগ্রাম।।

জালাল উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে নেমে ভারতের সাহেবগঞ্জে ২৮ দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। এলাকা হানাদারমুক্ত পর্যন্ত রণক্ষেত্রে ছিলেন এ যোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু তার দুঃখের অবসান হয়নি। ৩০ বছর বাঁশঝাড়-জঙ্গলে অন্যের জমির উপর জীর্ণ খুপড়িতে পরিবার নিয়ে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানালেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী-পাথরডুবি সড়কের সদর ইউনিয়নের কামাত আঙ্গারিয়া গ্রাম। সড়কের পশ্চিমে বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁশঝাড়-জঙ্গল। বাঁশঝাড়ের ভেতর দিনের বেলা হাঁটলেও শরীর কাঁটা দেয়। ওই বাঁশঝাড়ের ভিতর পায়ে হেটে কিছুদূর এগিয়ে দেখা গেল কঙ্কালসার মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বাঁশ কেটে খুঁটি করছেন।

বাঁশ কাটার প্রসঙ্গ উঠতেই বলেন, ‘ঘর ভেঙে পড়ে। বাঁশ খুজি আনলাম। খুঁটি দেব।’ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন-এমন প্রশ্ন না করতেই বলেন, ‘তখন এইচএসসি পাশ করেছি। যুদ্ধ শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন। শুনে মনস্থির করে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে ২৮দিন গেরিলা ট্রেনিং দিলাম। এসে বাগভাঙ্গারে যুদ্ধ শুরু করি। ক্যাপ্টেন ছিলেন মেজর নওয়াজেশ। কোম্পানি কমান্ডার আরব আলী। একাত্তরের ১৪ নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী হানাদার মুক্ত হয়। সেদিনো রণক্ষেত্রে ছিলাম। গাদাগাদি চার দিকে চারটা খুপড়ি ঘর। তিনটি টিনের একচালা, একটি খড়ের। সব কয়টি খুপরির বেড়া পুরোনো টিন ও পাটখড়ির। পাটখড়ির জীর্ণ বেড়া ভেঙে যাওয়ায় কাগজ ও ছেড়া কাপড় দিয়ে আচ্ছাদনের চেষ্টা করেছে।’

বাঁশঝাড়টি স্থানীয় আবুল হোসেন মাস্টারের। প্রায় ৩১ বছর যাবৎ জায়গাটুকু চেয়ে নিয়ে বাঁশঝাড়ের ভিতর বসবাস করে আসছেন জালাল উদ্দিন। আবুল হোসেন মাস্টার বলেন, ‘জালাল মিয়ার বাড়িতে গেলে কষ্ট হয়। এত কষ্ট করে মানুষ থাকে আমার জানা ছিল না। শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা চাকরি করার যোগ্য। ঘরের একপাশে বিছানা; অপরপাশে মাটিতে খড় বিছিয়ে গরু দুইটা রাখে। পাশের ঘরে থাকে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। চুলার ছোট্ট পাতিলে রান্না বসিয়েছেন জালালের স্ত্রী জুলেখা বেগম।’

জঙ্গলের ভিতর থাকতে ভয় হয় কিনা জানতে জালাল উদ্দিন বলেন, ‘জমি নাই, মানুষে থাকবার দিছে। জঙ্গলত ঘর। বেড়া দিব্যার পাইনা। বাঁশের আড়ার সোগ পোকা বিছনাত ওডে। ঝড়ি আসলে পোকামাকড়ের যন্ত্রণায় থাকা যায় না। একদিন কালাসাপ বিছনাত উঠছে।’

তিন মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে জেসমিন দুই বছর আগে এসএসসি পাশের পর মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে। সুস্থ হওয়ার পর ঢাকায় পোশাক কারখানায় কর্মরত স্থানীয় এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। কিছুদিন পর আবারো তার পাগলামি বেড়ে যায়। বর্তমানে মেয়েটি অসুস্থ থাকলেও তার চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

ছেলে জিয়াউল হক তিলাই উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেণি ও মেয়ে জয়নব ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে নুপুর কামাত আঙ্গারিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণির ছাত্রী। জিয়াউল বলেন, ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা। ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু যখন না খেয়ে স্কুলে যাই, খাতা-কলম কিনবার পাইনা। বাবা আব্দার পূরণ করতে পারে না। তখন মনে হয় যুদ্ধ করে বাবার কী লাভ হয়েছে। প্রথম তিনশ থেকে শুরু করে বর্তমানে ৮ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছে জালাল। এ টাকায় সন্তানদের পড়ালেখা, সংসার খরচ হয় না। সম্প্রতি সরকারের অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি তৈরির প্রকল্পে নিজ নামে জমি না থাকায় বাড়ি পাননি।’

জালাল বলেন, ‘সরকার বাড়ি দিচ্ছে শুনে কমান্ডারের সাথে দেখা করে বলি। কিন্তু তিনি প্রথমে পাত্তাই দিলেন না। পরে বললেন তোর জমি নাই এজন্য বাড়ির নাম দেয়া হয় নাই। এত কষ্ট আর ভালো লাগে না। পরে উপজেলা প্রশাসন বরাবর খাস জমি চেয়ে আবেদন করেন তিনি। সে আবেদনেও উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।’

ভুরুঙ্গামারী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জালালের মত মুক্তিযোদ্ধা এভাবে দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত থাকবে এটা লজ্জাজনক। বাড়ির বিষয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নামে ৮শতক জমি থাকলে তার উপর বাড়ি করার বিধান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে তার নামে কোন জমি নেই। এজন্য সম্ভব হয়নি।’

ভুরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা জালারের নামে জমি না থাকায় তাকে সরকারি বরাদ্দের ঘর দেয়া যায়নি। তিনি খাস জমি চেয়ে আবেদন করেছেন। এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn