বড়পুকুরিয়া খনিতে চুরি হয়েছে ৩ লাখ টন কয়লা!
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি পরিদর্শনের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টন কয়লা গায়েব হয়েছে। তবে স্থানীয় কয়লা ব্যবসায়ীদের দাবি, চুরি হওয়া কয়লার পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। তাদের দাবি, ২০০৫ সালে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরুর পর থেকেই সঠিক হিসাব না রাখায় কয়লায় ‘পুকুর চুরি’ ঘটেছে। তারা বলছেন, মোটামুটি হিসাবও যদি ধরা হয়, তাহলেও উত্তোলন করা কয়লা চুরির পরিমাণ দুদকের করা অভিযোগের চেয়েও অনেক বেশি। কারণ. এখানে চীনা টেকনিশিয়ানদের উৎপাদিত কয়লারই শুধু হিসাব রাখা হয়। এর বাইরে ডাস্ট কয়লা হিসেবে যে ক্ষুদ্রাকৃতির কয়লা পানি নষ্কাশন করে তোলা ও মজুত করা হয় সেগুলোর কোনও হিসাব রাখা হয় না। অথচ সেগুলো বিক্রি করা হয় এবং সে টাকার কোনও হদিস নথিতে থাকে না। সে কয়লার হিসাব করা হলে গায়েব হওয়া কয়লার পরিমাণ ৩ লাখ টনের কম হবে না বলেও ধারণা এসব ব্যবসায়ীর।
গত কয়েকদিনে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সচিব, পেট্রোবাংলা ও পিডিবি’র চেয়ারম্যান কয়লা খনি এলাকা ও কোল ইয়ার্ড (কয়লা মজুত রাখার জায়গা) পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে সবাই জানিয়েছেন কয়লা খনিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কয়লা গায়েব হয়েছে। এমনকি কয়লা দুর্নীতির ঘটনায় যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে সেখানেও এই পরিমাণ কয়লা চুরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবসায়ী, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ঠিকাদার ও স্থানীয় ডাস্ট ব্যবসায়ী সবাই দাবি করছেন, খনিতে কয়লা গায়েবের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রতি বছর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পানির সঙ্গে কয়লা উত্তোলিত হয়। এই কয়লা সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখা হয় কয়লা খনির ইয়ার্ডে। কিন্তু এই কয়লার কাগজে-কলমে কোনও হিসাব রাখা হয় না। তারা দাবি করেছেন, প্রতি বছর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে ১৬ থেকে ২০ হাজার টন কয়লা উত্তোলিত হয়ে আসছে। গত ৭/৮ বছর ধরে এই কয়লা স্থানীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব কয়লার হিসাব রাখা হয়নি। গোপনে এসব কয়লাও বিক্রি করে দিয়ে খনি কর্মকর্তারা অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীর দাবি, খনি থেকে যে কয়লা গায়েব হয়েছে তার পরিমাণ ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। তারা আরও দাবি করেছেন, খনির ইয়ার্ড থেকে যে কয়লা উধাও হয়েছে তার পরিমাণ কমপক্ষে ৩ লাখ টন, যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা গায়েবের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, খনি উন্নয়নের সময় ২০০১ সাল থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদিত কয়লা থেকে পার্শ্ববর্তী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করা হয়েছে। বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে ডিও’র মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন কয়লা বিক্রি করা হয়েছে। কয়লা খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ মেট্রিক টন কয়লা ব্যবহার করা হয়েছে। কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই পর্যন্ত কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুত দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন। কিন্তু বাস্তবে মজুত ছিল প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কয়লার ঘাটতি রয়েছে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা।
২৩ জুলাই সোমবার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকা পরিদর্শন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক বেনজীর আহম্মদও জানান, কাগজ-কলমে রয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। অথচ বাস্তবে রয়েছে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। ফলে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোনও হদিস নেই। কয়লা ব্যবসায়ী ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ঠিকাদাররা জানান, কয়লা খনির ভেতরে যেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয় সেখানে ভুগর্ভস্থের পানি চলে আসে। এসব পানি নিষ্কাশন করা হয় পাম্পের মাধ্যমে, যা গিয়ে পড়ে কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে। এসব পানির সঙ্গে ক্ষুদ্রাকৃতির কয়লা আসে যা ওই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে জমা হয়। পরবর্তীতে ঠিকাদারের মাধ্যমে জমা হওয়া ক্ষুদ্রাকৃতির (ডাস্ট) কয়লা বের করে রোদে শুকিয়ে পাঠানো হয় কোল ইয়ার্ডে। কিন্তু এসব কয়লা কোল ইয়ার্ডে গেলেও কাগজ-কলমে কোনও হিসাব রাখা হয় না। হিসাব রাখা হয় শুধুমাত্র চীনা টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে উৎপাদিত কয়লার। কয়লা খনি চালু হওয়ার সময় থেকে কয়লা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ফুলবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা মশিউর রহমান বুলবুল। উপজেলার নিমতলা এলাকায় ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়া সড়কের পাশেই তার কার্যালয়। তিনি জানান, ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে বছরে ১৬ থেকে ২০ হাজার টন কয়লা উত্তোলন করা হয়, যা পরবর্তীতে মূল কয়লার সঙ্গে যোগ করা হয়। কিন্তু এর কোনও হিসাব রাখা হয় না। সেই হিসেবে খনি থেকে তোলা মূল কয়লার পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার কথা। তাতে করে সিস্টেম লসে কম নয়, আরও বেশি কয়লা যোগ হওয়ার কথা। এতেই বোঝা যায়, ১ লাখ ৪৪ হাজার টন নয়, আরও বেশি কয়লা এখান থেকে গায়েব হয়েছে। এটি পুরোপুরি দুর্নীতির কারণে হয়েছে। কয়লা চুরি হয়েছে। তদন্ত করলে এই বিষয়টি বের হয়ে আসবে।’ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের সাবেক ঠিকাদার ছিলেন বর্তমান কয়লা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিজান। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির গেটের সামনেই তার কার্যালয়। তিনি জানান, ‘ক্যামিকেল ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কয়লা ধরা হয়। এটি উদ্বৃত্ত ও বাড়তি কয়লা, যার কোনও হিসাব রাখা হয় না। হিসাব রাখা হয় শুধু চীনাদের কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে আসা কয়লার, যা মিটারের মাধ্যমে ওজন করে হিসাব রাখা হয়। কিন্তু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের এসব কয়লার কোনও হিসাব রাখা হয় না। অথচ নিয়ম অনুযায়ী এসব কয়লা কাগজ-কলমে যোগ হওয়ার কথা।’নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের এক ঠিকাদার জানান, ২ বছরের জন্য এই প্ল্যান্টে জমাকৃত কয়লা উত্তোলন ও শুকিয়ে কোল ইয়ার্ডে পাঠানার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। চলতি বছরে ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছে স্থানীয় ভুট্টু নামের এক ব্যক্তিকে। গত বছরে এখান থেকে ১৬ হাজার টন কয়লা পাওয়া গেছে যা কোল ইয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। বড়পুকুরিয়া বাজারের উত্তর দিকে অফিস রয়েছে কয়লার ডাস্ট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, ‘গত প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর ধরে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে কয়লা ধরা হচ্ছে। প্রতি বছর এখান থেকে ১৬ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে কোল ইয়ার্ডে পাঠানো হয়। হিসাব অনুযায়ী এটিও উৎপাদনের অংশ এবং তা হিসাবের খাতায় যোগ হওয়ার কথা। কিন্তু তা কখনোই করা হয় না। এসব উৎপাদিত কয়লা অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। যার অর্থ এই কয়লার দাম রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না হয়ে চলে যায় অসৎ কর্মকর্তাদের পকেটে।’ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি বছর এখান থেকে ১৬ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলিত হয়। গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরে এই কয়লা উৎপাদিত হচ্ছে। যাতে করে এই সময়টায় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টন কয়লা উৎপাদিত হয়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে কয়লা খনির ভেতরে প্রবেশ করতে চাওয়া হলেও প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, হঠাৎ করে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদকে প্রত্যাহার, কোম্পানী সচিব ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কাশেম প্রধানীয়াকে বদলি ও দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এই ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বাদী হয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গত ২৪ জুলাই মঙ্গলবার রাতে পার্বতীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চুরি হয়ে যাওয়ায় কয়লা সংকটে বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র।