শামীমার আত্মহননঃ চলছে আলোচনা-সমালোচনা
ইয়াকুব শাহরিয়ার- দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দরগাপাশা ইউনিয়নে আক্তাপাড়া নয়াহাটি গ্রামের হতদরিদ্র পিতৃহীন শামীমা বেগম (১৬)। গত বুধবার সকালে আত্মহত্যা করেছে সে। মেয়েটির বাবা মৃত আমিরুল ইসলাম ওরফে আল ইসলাম। মা জাহানারা বেগম একজন গৃহকর্মী। মানুষের বাসায় বা প্রতিদিন রোজের মূল্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। প্রেমের কারণে লোক লজ্জার ভয়ে জাহানারা বেগমের মেয়েটি বুধবার সকাল ৯টায় নিজের ঘরে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। শামীমা বেগমের আত্মহত্যা নিয়ে আক্তাপাড়া গ্রামে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কেনো মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে ? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী এই গ্রামে অবস্থান করেন এই প্রতিবেদক। এবং তদন্তে বেরিয়ে আসে এক হৃদয় বিদারক কাহিনী। স্থানীয় একাধিক লোকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, একই গ্রামের প্রতিবেশি আছকন্দর আলীর ছেলে ও সাবেক ইউপি সদস্য ছালেক মিয়ার ভাই শাহীন আলম (২৫) নামের যুবকের সাথে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নিহত শামীমার। প্রেমের এই সম্পর্ক সবকিছু ছাপিয়ে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। গ্রামের এক কোণে আলাদা বাড়ি হওয়ায় শামীমাদের বাড়িতে গোপনে রাতে যাতায়াত করত শাহিন। একাধিকবার তাকে ধাওয়া করে ধরতে না পারায় মেয়েকে শাসন করেন মেয়ের মা জাহানারা। ছেলের ভাই সাবেক ইউপি সদস্য ছালেক মিয়ার কাছে একাধিকবার বিচার দিলে পাল্টা গঞ্জনা আর অবজ্ঞার স্বীকার হতে হয় তাদের। ঘটনার দিন রাতেও (বুধবার) অন্যান্য সময়ের মতো গোপনে শামীমার ঘরে ঢুকে প্রেমিক শাহিন। মা ও আত্মীয় স্বজন মিলে শাহিনকে শামীমার ঘর থেকে আটক করেন। আটকের পর ঘরের ভিতর বেঁধে রেখেছিলেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল সকালে শাহিনকে গ্রামের মুরব্বিদের সামনে হাজির করবেন বলে। শামীমার মনে আশার সঞ্চার হয়, অপমানিত হয়ে হলেও শাহিন আলমের সাথে তার বিয়ে হবে।
কিন্তু শামীমার সেই আশায় বাঁধ সাধে শামীমাদের প্রতিবেশি হাছন আলী নামের উশৃঙ্খল এক যুবক। হাছন আলী তছকির আলীর ছেলে। আটককৃত শাহিন আলমের পক্ষ ধরে হাছন আলী ভোরে দেশিয় অস্ত্র (রামদা) নিয়ে অসহায় পরিবারের উপর হামলা করে জোরপূর্বক শাহিন আলমকে ছাড়িয়ে নেয় এবং পুকুর সাঁতরে পালিয়ে যায়। তাদের ধরতে ও গ্রামের মুরব্বিদের বিষয়টি জানাতে সকালে যখন শামীমার মা ও আত্মীয় স্বজন দৌঁড়ঝাঁপ করছিলেন তখন খালি ঘরে একাই শামীমা অবস্থান করছিলো। বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হওয়ায় ও প্রেমিক শাহিন আলম পালিয়ে যাওয়ায় লজ্জায় ও ক্ষোভে সকাল ৮ টায় নিজ বসতঘরে আত্মহনন করে শামীমা। এই ধারণা করেন স্থানীয়রা। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তে পাঠায়। ময়না তদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার শামীমার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করলে পারিবারিকভাবে দাফন করা হয়। এলাকাবাসী চান, শামীমার লাশ দাফনের মধ্য দিয়েই যেনো শামীমার মৃত্যুর জন্য দায়ীরা পার পেয়ে না যায়। অথবা গ্রাম্য শালিসের নামে প্রহসন করেই যেনো শামীমাদের চিরমুক্তি দেয়া না হয়। একটি হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েকে প্রলোভন দেখিয়ে ক্রমান্বয়ে একাধিকবার মেলামেশা, ভাই সাবেক ইউপি সদস্যের কাছে একাধিকবার বিচার দিয়ে বিচার না পাওয়া, পাশের বাড়ির হাছন আলী কর্তৃক রামদা দেখিয়ে আটককৃত অভিযুক্ত শাহিন আলমকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াই শামীমাকে মৃত্যুর দিকে এগুতে প্রলুব্ধ করেছে। স্থানীয়রা মনে করেন, হাছন আলী যদি এমন কাজ না করতো তাহলে আসামী শাহিন তাদের হাতে আটক থাকতো। ঘটনার পরদিন সকালে মুরব্বিরা মিলে সমাধানের দিকে যেতেন অথবা শামীমাকে শাহিন আলমের সাথে বিয়ে দিতেন। সামাজিকভাবে সমাধান না হলে পুলিশে দেয়া যেত। কিন্তু তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তাই লোক লজ্জায় হয়তো এই পথ বেছে নিয়েছে হতভাগী শামীমা। শামীমার মৃত্যুর ঘটনায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন মেয়ের মা জাহানারা বেগম। তিনি মেয়ের শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে হত্যা করাসহ সব কিছুর বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন,‘আমার মেয়ের মৃত্যুর কারণ হাছন আলী ও শাহিন আলম। হাছন আলী কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে হামলা করে আসামীকে ছাড়িয়ে নেওয়ায় রাগে লজ্জায় আমার মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। আমি শাহীন আলম ও হাছন আলীর সমান বিচার চাই।’
অভিযুক্ত হাছন আলী বলেন, ‘আমার উপর আনিত অভিযোগ মিথ্যা। শাহিন আমার বাপ না ভাই লাগে যে, আমি তাকে ছাড়িয়ে আনতে যাবো?’ প্রমাণ আছে বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ভাই আপনার লেখালেখি করার কি দরকার? আপনার সাথে আমার এক পরিচিত বর্তমান মেম্বার দেখা করবেন, খরচের টাকা দেবেন, দয়া করে এসব বাদ দিয়ে দেন। কথা রেকর্ড হচ্ছেÑ এমন কথা বললে সংযোগ কেটে দেন তিনি।’ অভিযুক্ত শাহিন আলমের বড় ভাই প্রাক্তন ইউপি সদস্য ছালেক উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই অনেক আগেই আমাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমার ভাই শাহিন আলম প্রকৃতপক্ষে অপরাধী হয়ে থাকলে আমি চাই প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হোক।’ দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরি বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধিন আছে। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মামলার কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’