রোদে পোড়া শরীর এখন নায়িকাদের রূপে বিলীন
একাদশ জাতীয় সংসদে ৪৩টি সংরক্ষিত নারী আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন এক হাজার ৫১০ জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রুপালি পর্দার একাধিক তারকা। তাতেই হতাশা দেখা দিয়েছে সক্রিয় ও সরাসরিদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নারী নেত্রীদের মাঝে। তবে তারকাদের আসার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঝে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণকারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, তারকাদের মধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী, চিত্রনায়িকা মৌসুমী, সুজাতা, ফাল্গুনী হামিদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, অঞ্জনা, দিলারা, অরুণা বিশ্বাস, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, শাহনূর, অপু বিশ্বাস, তারিন জাহান, জ্যোতিকা জ্যোতি ও চিত্রনায়িকা নূতন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, তারকা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেদিক থেকে সংসদ সদস্য হতে চাওয়া অন্যায়ের কিছু নয়। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেই ভাবনা থেকেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কেউ কেউ এবার সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হতে পারেন, তবে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী নারী নেত্রীরা মনে করছেন, দলীয় আদর্শ ধারণ করে যেসব নেত্রী দীর্ঘদিন দলের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তারাই সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের দাবিদার। কিন্তু এবারই সর্বোচ্চসংখ্যক রুপালি জগতের তারকা মনোনয়ন কিনেছেন। তাদের মধ্যে তিন-চারজন ছাড়া অন্যরা রাজনীতির মাঠে কখনোই ছিলেন না।
দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিন। ব্যক্তিগত ফেসবুক পাতায় এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতি থেকে মনে হয় বিদায় নিতে হবে, নায়ক-নায়িকাদের ভিড়ে আমাদের আর দেখা পাওয়া কঠিন। আন্দোলন-সংগ্রামের রোদে পোড়া শরীর এখন দেখতে কিছুটা ভালো হলেও নায়িকাদের রূপে বিলীন। ক্ষমতায় থাকতে এত লোক, বিরোধী দলে থাকতে তো দেখিনি। মেয়েদের রাজনীতিতে কেবলই জ্বালা, নায়িকা জ্বালা, আবার মেয়ে হওয়ায় পুরুষের চাইতে বেশি কাজ করলেও সাধারণ আসনে মনোনয়ন দেয়া যাবে না। সরকারি দলের চাইতে বিরোধী দলেই তো ভালো ছিলাম, নিজেদের দল নিজেদের ছিল। এখন মহাবিপদ, আমাদের দল ছিনতাই করছে নায়িকা হাইব্রিড বিএনপি থেকে আমদানিকারীরা।’ তারকাদের মনোনয়ন প্রত্যাশী হওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। তিনি বলেন, ‘এবারে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকরা অংশ নিয়েছিলেন। তিনি (শেখ হাসিনা) এমন এক ব্যক্তিত্বের মানুষ, এমন মায়াময় এক চরিত্র উনার ছায়ায় সবাই আসতে চান। সেই প্রেক্ষিতেই সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা মনোনয়ন কিনেছেন, এটা তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ যে তারা রাজনীতি করতে চান। সংসদ সদস্য হতে চাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা তো দোষের কিছু নয়, বরং আওয়ামী লীগের প্লাটফর্মের অনেক শিল্পী কলাকুশলীর আসাকে আমি পজেটিভলি দেখি।’
সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘সংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের সম্পৃক্তার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। তারা বিভিন্ন সময়ই আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখন তারা এমপি হতে চাচ্ছেন- এটাতো অন্যায় না। বিগত দিনগুলোতেও তাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। আশা করি এবারও যোগ্য, যারা দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে।’ তারকাদের মনোনয়ন সংগ্রহের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জাতীয় মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। তিনি বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য দিক হল আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটা দিক হলো রাজনীতির মাধ্যমে অতিদ্রুত উপরে উঠা যায়, সামজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি করা যায়, এটাও একটা কারণ হতে পারে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাও অনেক পাওয়া যায়- এটাও একটা কারণ হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকই আছেন দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি করছেন, তাদের আগ্রহ রয়েছে। এটার পজেটিভ কিছু দিক আছে, আবার কিছু সুবিধাবাদী দিকও আছে। তারা (নারী নেত্রীরা) তো বলতেই পারে উড়ে এসে কেন? তাদের তো সরাসরি নির্বাচিত হতে হবে না। এখানে দুর্বলতার যে জায়গাটা সকলকে লক্ষ্য করা দরকার তা হলো, তারা আসছেন এটা যেমন বিষয়, এদের তো নির্বাচিত হতে হবে না, মনোনীত হবেন। মনোনয়ন পেলেই তো বিজয় সুনিশ্চিত। আমরা মনে করি সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার।’ সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিতরণ চলাকালে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, ‘ত্যাগী ও যাদের দলের জন্য অবদান আছে মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পাশাপাশি যারা এবারের নির্বাচনী প্রচারেও কাজ করেছেন তারাও মনোনয়নের জন্য বিবেচিত হবেন। একই সঙ্গে অভিনেত্রীদেরও কেউ কেউ এ মনোনয়ন পেতে পারেন।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া সব সময় একটাই, সেটা হচ্ছে যোগ্যতা। এলাকায় প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, যে কর্মকাণ্ড করার জন্য মনোনয়ন চেয়েছেন সেটা করার দক্ষতা-সক্ষমতা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।‘ তিনি বলেন, ‘সব ধরনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যেন হয় সেটা আমরা দেখব। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পাশাপাশি পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অঙ্গন থেকেও বিবেচনা করা হবে।’