নিজের কিডনী দিয়েও স্বামীকে বাঁচাতে পারলেন না স্ত্রী!
স্বামীকে বাঁচাতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্ত্রী নিজের দেহ থেকে একটি কিডনী স্বামীকে উপহার দিয়ে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরও না ফেরার দেশে চলে গেলেন বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ঘাসিগাঁও গ্রামের আতিকুর রহমান (৫০)।গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি….রাজিউন)। আতিকুর রহমান দীর্ঘদিন পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিআরব গিয়েছিলেন নিজের পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। দেশে স্ত্রী ও চার কন্যার ভরনপোষনের জন্য প্রবাস থেকে নিয়মিত টাকা পাঠালে বেশ ভালই ছিল তার পরিবার এবং অনেকটা সুখেই ছিল তারা। আর বছর তিনেক পূর্বে বড় মেয়েকে পাত্রস্থ করায় কিছুটা দুঃচিন্তা মুক্তও ছিলেন আতিকুর রহমান। কিন্তু সেই সুখ তার কপালে বেশী দিন স্থায়ী হতে না হতেই সৌদিআরবে অবস্থানকালে ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীরে প্রচন্ড জ্বর আসে।পরদিন তিনি সৌদি কিং আব্দুল আজিজ হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানান এবং ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা প্রদান করা হলে তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসাধিন অবস্থায় তার দুটি কিডনীই বিকল হয়ে পড়লে তাকে ডায়ালাইসি দেওয়া হয়।
ঐ হাসপাতালে তিনি ১ মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি দেশে ফিরে আসলে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধিন অবস্থায় তাকে সপ্তাহে ৩ বার ডায়ালাইসি দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় তাকে বাঁচাতে কিডনী সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এসময় আতিকুর রহমানের স্ত্রী বিলকিছ বেগম (৪০) নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বামীর জীবন বাঁচাতে নিজের একটি কিডনী হাসি মুখে উপহার দেন। হাসপাতালে প্রায় ৪ মাস চিকিৎসাধিন থাকার পর ওই বছরের ৪ জুন ঐ হাসপাতালেই অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি কিডনী ট্রান্সফার করা হয়। কিডনী ট্রান্সফারের পর ঐ হাসপাতালের কে.টি আইসিইউ’তে আরো ২ মাস চিকিৎসাধিন ছিলেন তিনি। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক হলে হাসাপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে আতিকুর রহমান বাড়িতে চলে আসেন। চিকিৎসা ব্যয় করতে তার বাড়ীতে থাকা একটি ভিটে ছাড়া সবই বিক্রি করে যখন প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান হয়নি তখন আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিবর্গ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
কিডনী সংযোজনের কিছুদিন পর কিডনীতের ভাইরাস আক্রান্ত হলে সংযোজনকৃত কিডনীর ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা কমে আসতে থাকে। এমতাবস্থায় আতিকুর রহমানের গোটা পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। যেখানে কলেজ ও স্কুলগামী তিন কন্যা যথাক্রমে কলছুমা আক্তার (১৯) ইভা আক্তার (৯) ও শুভা আক্তার (৬) এর লেখাপড়া কিংবা দু’বেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়া অনেক কঠিন, সেই মূহুর্তে ব্যয়বহুল চিকিৎসা আতিকুর রহমানের পরিবারের জন্য অনেকটাই বিশাল কঠিন হয়ে পড়ে। স্বামীর জন্য স্ত্রীর ভালবাসার এই দৃষ্টান্তকে একটু সহানুভূতি আর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সমাজের সকল হৃদয়বানদের প্রতি আকুতি জানিয়ে বিশ্বনাথ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে সোসাল মিডিয়ায় একটি মানবিক আবেদন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এই আহবানে সাড়া দিয়ে আতিকুর রহমানের চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন হৃদয়বান ব্যক্তিরা।
ফলে চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনীর ভাইরাস দূর করা সম্ভব হয়। এরপর তিনি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে উঠেন। হাসি আনন্দ ফিরে আসে পরিবারে এবং ২য় কন্যাকে নিজ হাতে পাত্রস্থ করেন তিনি। সম্প্রতি তিনি গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে সপ্তাহ খানেক পূর্বে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। কিন্ত ধীরে ধীরে তার শারিরিক অবস্থা অবনতি হতে থাকে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় বুধবার (২৩ জানুয়ারী) সকাল ১০ টায় তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। এদিকে, বুধবার বাদ মাগরিব আতিকুর রহমানের জানাযার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানের মরহুমের দাফন সম্পন্ন করা হয়। জানাযার নামাজের ইমামতি করেন জামেয়া ইসলামিয়া আব্বাসিয়া কৌড়িয়া ইসলামাবাদ মাদ্রাসার মুহতামিম হাফিজ মাওলানা মুহসিন আহমদ। জানায়ায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকবৃন্দ সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহন করেন।