যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের জবাবদিহিতা সংক্রান্ত দফতর থেকে (ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট’স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস)গত সপ্তাহে থেকে ‘জলবায়ু পরিবর্তন: বৈশ্বিক অভিবাসনের সম্ভাব্য প্রভাব চিহ্নিতকরণে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্থার ভূমিকা’ (ক্লাইমেট চেঞ্জ: একটিভিটস অব সিলেক্টেড এজেন্সি টু অ্যাড্রেস পোটেনশিয়াল ইমপ্যাক্ট অন গ্লোবাল মাইগ্রেশন) শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অভিবাসন বাস্তবতাকে কী করে বদলে দিচ্ছে প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে। বদলে যাওয়া অভিবাসন বাস্তবতার প্রভাব শনাক্তে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন ভূমিকার পর্যালোচনা করা হয়েছে এতে। প্রতিবেদনে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মোকাবেলার প্রস্তুতি প্রসঙ্গ।
সুনির্দিষ্ট সময় পর পর প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতায় বদলে যায় জলবায়ু। মানুষ সৃষ্ট কারণেই এই স্বাভাবিক বদলের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে, বিশ্ব বহুদিন থেকে এক আকষ্মিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্তি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণায়নের কারণে গলছে হিমবাহের বরফ, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, স্থানচ্যুত হচ্ছে মানু্ষ। অভিবাসী কিংবা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা। এরইমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই সামনের কাতারে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাবদিহিতা সংক্রান্ত দফতর (ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট’স অ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস) থেকে গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও খরা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ওই প্রতিবেদনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য। ওই মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরির্তনের কারণে কৃষি ও মৎস চাষের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করায় মানুষ নিজেদের এলাকা ছেড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবাস গড়ছে। অথচ ওই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবেলা করছে। প্রায়শই ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকা কিংবা নদীর কাছাকাছি অঞ্চল । ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে গেছে হাজার হাজার বাড়ি ও ফসল। ২০১৭ সাল ঘূর্ণিঝড় মোরার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দুই লাখ মানুষ।
প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানানো হয়েছে, পরিবেশের উষ্ণতা বাড়লে এই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ আরও বাড়বে । এতে বাড়ি, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৭.৫ শতাংশ ভূখণ্ড পানিতে তলিয়ে যাবে। বৃষ্টিপাতের পরিমান পরিবর্তন হলে খরা আরও বেড়ে যাবে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা আরও বেশি হুমকিতে পড়বে। দক্ষিণ –পশ্চিমাঞ্চলে লবনাক্ত পানি বেড়ে গেলে ফসল উৎপাদনও ব্যহত হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন এখন বেঁচে থাকার সাধারণ কৌশল। যেমন অনেক কৃষক এখন লবণাক্ত পানির প্রভাবে নিজেদের চাষাবাদের কৌশল পাল্টেছেন। কেউ এখন লবণ সহিষ্ণু ধান উৎপাদন করছেন, আবার কেউ ফসল ফলানো বাদ দিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। আর অনেকে গ্রাম ছেড়েছেন। জীবিকার আশায় পাড়ি জমিয়েছেন শহরে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট আর সাসেস্ক সেন্টার ফর মাইগ্রেশন রিসার্চ নামের দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিবাসনের এই ধারা ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে পারে। ‘বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন’ (ক্লাইমেট চেঞ্জ রিলেটেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ) শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৯৬ লাখ অভিবাসী তৈরি হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অভিবাসী বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ দারিদ্র বাড়াতে পারে।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্বন নির্গমন কমানো এবং এই গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩ দশমিক ৬ ফারেনহাইট) ‘বেশ নিচে’ রাখার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালে প্যারিসে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের নীতিমালা তৈরি করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিন বছর পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পোল্যান্ডে সম্মিলিত হয়ে ও ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আইপিসিসি তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ এ সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। তবে আইপিসিসির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতেই কার্বন নিঃসরণ সীমিত করতে হবে আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হারে। প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেন, প্যারিস চুক্তিতে বিভিন্ন দেশের সরকার যেই পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য।