বিদেশি সিরিয়ালের প্রভাবে বাড়ছে আত্মহত্যা
পারিবারিক কলহের জের, সংসারে অভাব-অনটন, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থ, পছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে না দেওয়া ও পরীক্ষায় ফেলসহ বিভিন্ন কারণে রাজশাহীতে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে গত ছয় মাসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১১০ জন। এ তথ্য গত বছরের জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। গলায় ফাঁস ও বিষপান করে আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে মহানগরীসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে তারা রামেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যাদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তবে এ মৃত্যুর তালিকায় ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীও রয়েছে। এ ছাড়াও ৪০ থেকে ৫০ বছরের ব্যক্তিও রয়েছেন এ মৃত্যুর তালিকায়। রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ ও বিষপানে ১০৫ জন মারা গেছেন। তবে বিষপানের তালিকায় যুক্ত রয়েছে টয়লেট পরিষ্কারক তরল পদার্থ পান ও ঘুমের ওষুধ সেবনকারীও। রামেক হাসপাতালের মৃত তালিকার রেজিস্ট্রার অনুযায়ী জুলাই মাসে ১১ জন, আগস্টে ২৮, সেপ্টেম্বরে ১৭, অক্টোবরে ২৩, নভেম্বরে ১৭ ও ডিসেম্বরে ৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেঘলা সরকার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পারিবারিক কলহের জের, সংসারে অভাব-অনটন, পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপন, প্রেমে ব্যর্থ, পছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে না দেওয়া ও পরীক্ষায় ফেলসহ বিভিন্ন কারণে অভিমান বা ক্ষোভ তাৎক্ষণিকভাবে অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত সৃষ্টি করায় তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অথচ কয়েক বছর আগেও আত্মহত্যার খবর খুব বেশি একটা শোনা যেত না। এজন্য বিদেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়াল অনেকাংশেই দায়ী। যেসব সিরিয়ালে মাদক ও অপসংস্কৃতি প্রচার করায় পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে দর্শকদের প্রভাবিত করা হয়। এসব সিরিয়ালের ভালো দিকটা গ্রহণ না করে বেশির ভাগই দর্শক খারাপটাই মস্তিষ্কে নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়। ঘটছে অপরাধ প্রবণতার হার।
কোনো কারণে সমস্যা সৃষ্টি হলে সেই সিরিয়ালগুলোর কাহিনীগুলো কল্পনায় চলে আসে। ভাবতে শুরু করে নিজেকে শেষ করে ঝামেলা চুকাতে। আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক বা সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি না থাকায় এ বিষয়ে জ্ঞানশূন্য বেশির ভাগ মানুষই। আত্মহত্যার কুফল বিষয়ে প্রতিটি ধর্মের শিক্ষাগুরুদের দায়িত্ববোধ থেকে আলোকপাতের প্রচলন না থাকায় ধর্মীয় বিধিও মানছেন না আত্মহরণকারীরা। যে কারণে আত্মহত্যার রোধে পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে জনপ্রতিনিধি ও সরকারকে। তাহলে অনেকাংশেই আত্মহত্যার হার কমে আসবে। ডা. মেঘলা সরকার আরো বলেন, ‘আত্মহত্যা করবে এমন সিমটম বুঝতে পারলে ওই ব্যক্তির পাশে পরিবার বা যে কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। এরপর আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে উদাহরণের মাধ্যমে বোঝাতে সক্ষম হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ওই ব্যক্তি আরো উদ্যমী হয়ে জীবনযাপনের পরিকল্পনা করবে। কিন্তু যখন কাউকেই পাশে পায় না তখন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। তবে আত্মহত্যার মতো ঘটনার জন্য শুধু যিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনিই দায়ী নন, এর জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোও দায়ী। আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনতে ব্যক্তির পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সরকারের ভূমিকা পালন আবশ্যক।’