কেন বিক্ষোভে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের উবার চালকেরা?
যাত্রীর কাছ পাওয়া টাকার একটা বড় অংশ নিয়ে যাচ্ছে রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো। উবারের মালিক কিনছেন কোটি কোটি টাকার বিলাসবহুল বাড়ি। আর যারা উবার অথবা অন্য কোনও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের অ্যাপস-এ যাত্রী পরিবহনের কাজ করছেন, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানগুলোর শোষণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ চলছে।
৮ মে মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছেন উবার (uber) ও লিফট (Lyft) অ্যাপের চালকেরা। মার্কিন পুঁজি বাজারে উবারের তালিকাভুক্তির একদিন আগে এই জোরালো বিক্ষোভের ডাক এসেছে। বিভিন্ন মেয়াদে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলস, নিউ ইয়র্ক, স্যান ফ্রান্সিসকো, স্যান ডিয়েগো, ফিলাডেলফিয়াসহ বহু শহরে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও বিভিন্ন শহরে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আয় কমার অভিযোগ অস্বীকার করে এসব রাইডশেয়ার প্রতিষ্ঠানের দাবি, চালকদের জন্য নানা ধরনের সেবা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শেয়ার বিক্রি সামনে রেখে প্রকাশ করা উবারের আর্থিক তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ রাইড প্রতি আয়ের ২১ শতাংশ কেটে নেয় কোম্পানিটি। তবে চালকদের অ্যাপের স্ক্রিনশটের তথ্য বলছে, কোনও কোনও ট্রিপ থেকে ৩০ শতাংশেরও কম ভাড়া নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় তাদের।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ চার মাসের হিসাবে উবার প্লাটফর্মে প্রায় ২৯ লাখ চালক ছিলেন। এরমধ্যে কেবল স্যান ফ্রান্সিসকোতেই রয়েছে সচল ৫০ হাজার চালক। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এই সপ্তাহে পাবলিক কোম্পানি হিসিবে যাত্রা শুরু করার আগ মুহূর্তে উবার চালকদের মধ্যে অস্থিরতা ও ক্ষোভ জোরালো হয়েছে। চালকদের দাবি, কোম্পানির লভ্যাংশ ফুলে ফেঁপে উঠলেও তাদের আর্থিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এদিকে বাজারে উবারের মূল্য প্রায় ৯ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে উঠেছে। উবারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান লিফট পাবলিক কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্চে। ট্যাক্স দেওয়ার আগে কোম্পানিটি ঘণ্টায় ৮ দশমিক ৫৫ ডলার পারিশ্রমিক দিতো চালকদের। এই পারিশ্রমিকের পরিমাণ ক্যালিফোর্নিয়ার সর্বনিম্ন ঘণ্টাপ্রতি মজুরি ১১ ডলার থেকে কম হলেও কেন্দ্রীয় ঘণ্টাপ্রতি গড় মজুরি সাত দশমিক ২৫ ডলার থেকে বেশি। নিউ ইয়র্কে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন আয় ১৭ ডলারে উন্নিত করতে বাধ্য করার পর উবার সেখানে নতুন চালক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে ঘণ্টাপ্রতি ১৫ ডলার আয় করার সুযোগ পায় চালকেরা। স্যান ফ্রান্সিসকোতে এই আইন কার্যকর হয়নি।
শেয়ার বিক্রি সামনে রেখে বিশ্বজুড়ে নির্বাচিত প্রায় ১১ লাখ চালককে প্রায় ৩০ কোটি ডলার বোনাস দেওয়ার পরিকল্পনা করছে উবার। কোম্পানিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই বোনাসের মাধ্যমে কোম্পানির সফলতার সঙ্গে চালকদের সম্পৃক্ততার স্বীকৃতি দেওয়া হবে। চালকেরা বলছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও ট্রিপ প্রতি উবার নিজেদের কমিশন বাড়িয়েছে। স্যান ফ্রান্সিসকোতে উবার সদর দফতরের বাইরে প্রায় দুই তিনশো চালক জড়ো হয়। ছোট একটি ব্যান্ড দল সেখানে স্লোগান তোলে- ঐক্যবদ্ধ চালকদের কখনোই হারানো যাবে না। ওপরে হেলিকপ্টারসহ পুলিশের শক্ত উপস্থিতি ছিল সেসময়, ছিল সংবাদকর্মীদের আনাগোনাও। পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো উবার আর লিফট চালকদের হাতে ধরা প্লাকার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। আয়োজকেরা মেগাফোন ব্যবহার করে উবারবিরোধী বক্তব্য রাখছিলেন। তার বলছিলেন- আজ যাদি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি তাদের সঙ্গে কথা না বলে, তাহলে তারা পিছু হটবে না।
লস অ্যাঞ্জেলসে ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দেয় রাইডশেয়ার-চালকদের সংগঠন রাইডশেয়ার চালক ঐক্য। তাদের ডাকে প্রায় চার হাজার ৩০০ রাইডশেয়ার চালক শহরের বিমানবন্দরের বাইরে জড়ো হয়ে দিনভর বিক্ষোভ করেন। পার্ট টাইম লিফটচালক রাইডশেয়ার চালক ঐক্যের সংগঠক নিকোল মুরে বলেন, ‘আমরা সবাই ভেবেছিলাম- উবার যখন শেয়ার ছাড়া শুরু করবে, তখন এটা কী ধরনের কোম্পানি, তা সবাইকে জানানোর জন্য ভালো সময় হবে। আর আমরা জানি এর মধ্য দিয়ে চালকদের স্বর জোরালো করা যাবে। আর একারণে এই সময়টাকে সংগঠিত হওয়ার জন্য বেছে নিয়েছি।’
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান দিয়েগোতে উবার এবং লিফট চালকেরা ২৪ ঘণ্টা ধর্মঘট করছেন। স্যান দিয়েগো বিমানবন্দরের বাইরে বিক্ষোভ করেন তারা। সকাল এগারোটা থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ বিকেল পর্যন্ত চলে। স্যান দিয়েগোতে রাইডশেয়ার চালক ঐক্যের সংগঠক ও কলেজ শিক্ষার্থী টিনা গিভেনস বলেন, ‘দেশের প্রায় প্রতিটি শ্রমিক ইউনিয়নই আমাদের সমর্থন করছে।’ ছেড়ে দেওয়ার আগে একবছর উবার চালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাকে আমার গাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে, কারণ গাড়িভাড়া দিয়ে আমি আমার জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে পারছিলাম না। তাছাড়াও আমার বেশ কিছু অনিরাপদ অভিজ্ঞতাও রয়েছে।’ স্যান ফ্রান্সিসকোতে উবার সদর দফতরের সামনে মিছিল আয়োজন করে গিগ ওয়ার্কাস রাইজিং নামে একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের সংগঠক ও পূর্ণকালীন উবার ও লিফট চালক স্টিভ গ্রেগ বলেন, এই ধরনের কর্পোরেশনের মাধ্যমে কর্মীরা শোষিত হচ্ছে আর সরকার আমাদের সুরক্ষায় কোনও কিছুই করছে না’। উবার সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভরত অ্যালেক্স নামে একচালক বলেন, যে শহরে তিনি কাজ করেন, সেখানে থাকার মতো টাকা উপার্জন করতে পারেন না তিনি। একারণে প্রতিদিন তাকে সাগর পাড়ি দিয়ে রিচমন্ড থেকে আসতে হয়। স্ত্রী এবং ছয় বছরের ছেলের দেখাশোনা করতে তাকে সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রতিদিন প্রায় ১৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয়।
উবারের ট্রিপপ্রতি ভাড়ার একটি তালিকা হাতে ধরে রেখেছিলেন তিনি। তাতে তিনি দাবি করেন, পুরনো ভাড়ার হার ছিল মাইলপ্রতি দশমিক ৯৯ ডলার আর এখন তা দশমিক ৬৮ ডলার। এদিকে উবার কর্তৃপক্ষের দাবি, চালকেরা ঘণ্টাপ্রতি গড়ে ১৮ দশমিক ৬৫ ডলার আয় করে থাকেন। তবে স্বতন্ত্র জরিপকারীদের হিসাবে দেখা গেছে ঘণ্টাপ্রতি চালকদের গড় আয় ৮ ডলারের কাছাকাছি। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে নির্বাহীরা কত অর্থ পাবেন তা নিয়ে স্যানফ্রান্সিসকোর অনেক চালকই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ২০১৮ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোতে উবারের প্রধান নির্বাহী দারা খোসরো শাহীর ১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার মূল্যের বাড়ি কেনা খবর প্রকাশ পায়। সেদিকে ইঙ্গিত করে দুই বছর ধরে উবার চালানো আন্নেত্তে রিবেরো নামে এক ব্যক্তির হাতে ধরা প্লাকার্ডে লেখা ছিল, ‘দারা, আমি ভাড়া দিতে পারি না, তোমার ১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ম্যানসনের খবর কী?’ শেয়ার বিক্রির শুরুর দিনেই নিজের শেয়ার বিক্রি করে খোসরো শাহী প্রায় ৯০ লাখ ডলার আয় করতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বিরেবো বলেন, অনেক চালকই এখন গাড়িতে ঘুমাতে বাধ্য হন। তিনি আরও বলেন, দিন দিন পরিস্থিতি শুধু খারাপই হচ্ছে। আমার আশঙ্কা আমাদের বহু চালক কাজ করা বন্ধ করে দেবে, কারণ আমরা খুব কমই মজুরি পাই।
কাছাকাছি ছিলেন মোহাম্মদ নামে সাবেক এক উবার চালক। তার হাতে থাকা প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘ঐক্যবদ্ধ চালকেরা কখনোই পরাজিত হবে না।’ ছয় বছর কাজ করার পর ওই অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে তিনি দেখতে পান দৈনিক ১০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একসময় ৫০০ ডলার আয় হলেও পরবর্তীতে একই পরিমাণ গাড়ি চালালেও আয়ের পরিমাণ দাড়ায় দেড়শ’ ডলার। দীর্ঘদিন গাড়ি চালানোর প্রভাব শরীরের ওপরে পড়ে এখন আর আয় করার মতো অবস্থায় নেই তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখন আমার পিঠে ব্যাথার সমস্যা হয়, এর কোনও মূল্য নেই। তারা আরও বেশি টাকা বানাতে থাকবে আর চালকেরা তার কোনও ভাগ পাবে না।’
বোস্টন, নিউ ইয়র্ক, মিন্নেপোলিস, স্টামফোর্ড, কানেক্টিকাটসহ যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি শহরের চালকদের বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়েছে। রাইডশেয়ার প্রতিষ্ঠান লিফটের এক প্রতিনিধি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের কাছে দাবি করেন, গত দুই বছরে লিফট চালকদের ঘণ্টা প্রতি আয় বেড়েছে। লিফট প্লাটফর্ম থেকে তারা একহাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ আয় করেছে। ৭৫ শতাংশেরও বেশি চালক তাদের নিজস্ব কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে ১০ ঘণ্টারও কম গাড়ি চালিয়েছেন। গড়ে লিফট চালকেরা প্রতিঘণ্টায় ২০ ডলারের বেশি আয় করেছেন। আমরা জানি, সবাই সমান আয় করতে পারে না। অতিরিক্ত আয় লাখ লাখ মানুষের জন্য বড় ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায়। আর আমরা আমাদের চালকদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য সবসময়ই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উবারের এক প্রতিনিধি বলেন, চালকেরা আমাদের সার্ভিসের প্রাণ। তাদের ছাড়া আমরা সফল হতে পারবো না। আর হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন উবারে কাজ করতে আসে এমন লক্ষ্য নিয়ে যাতে সড়ক এবং সড়কের বাইরে তাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আরও উন্নত হয়। এর মাধ্যমে ধারাবাহিক আয়, জোরালো ইন্সুরেন্স সুরক্ষা বা চালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য চার বছরমেয়াদি ডিগ্রির মাধ্যমে আমরা চালকদের অভিজ্ঞতা উন্নত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।