শীর্ষপর্যায়ে সমন্বয়হীনতা বিএনপির তৃণমূলে হতাশা ক্ষোভ
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলের চার সংসদ সদস্যের শপথ নেওয়া, আবার দলীয় মহাসচিবের না নেওয়া এবং এসব বিষয়ে অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিস্ময় প্রকাশ নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকেই বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থাকলেও তাঁর মুক্তির দাবিতে সারা দেশে কোনো কর্মসূচি নেই। আবার যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার কথা বলা হচ্ছিল এত দিন তা নিয়েও কেন্দ্র থেকে আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। সে অবস্থায় হঠাৎ বিএনপির চার সংসদ সদস্যের শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এতে দলের চরম ক্ষতি হয়েছে। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কোনো কোনো নেতাকর্মী অবশ্য মনে করে, দল সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তবে স্থায়ী কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার মত নেওয়া হলে বিষয়টি নিয়ে এত প্রশ্ন উঠত না। একক সিদ্ধান্তের কারণে দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা কারো কারো। কেউ কেউ মনে করে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীর শপথ না নেওয়ায় ক্ষতি কিছুটা কম হবে। তবে বগুড়ার বিএনপি নেতারা উল্টো ফখরুলের ওপর ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, যেখানে সংসদে দলের প্রতনিধিত্ব থাকছেই সেখানে মির্জা ফখরুল শপথ না নেওয়ায় দলের একটি ‘নিশ্চিত’ আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রামে চাপা ক্ষোভ-হতাশা : নূপুর দেব জানান, দলের চার সংসদ সদস্য শপথ নেওয়ায় চট্টগ্রাম বিএনপির প্রায় সবার মাঝে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি এবং আওতাধীন বিভিন্ন কমিটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল চার এমপি শপথ নেওয়ার পর চট্টগ্রামে দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা অনেক নেতাও হতভম্ব হয়ে পড়েন। কয়েকজনের সঙ্গে গত রবিবার যোগাযোগ করা হলে তাঁরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নগর ও জেলার অনেক নেতা এ বিষয়ে মন্তব্যে তাঁদের নাম প্রকাশ না করতেও অনুরোধ করেন। তবে বেশির ভাগ নেতারই অভিন্ন বক্তব্য—একক সিদ্ধান্তে দলীয় এমপিরা শপথ নেওয়ার দল বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবার মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
কয়েকজন নেতা অবশ্য বলেন, দলের সিদ্ধান্ত ভালো হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ান গত রবিবার দুপুরে বলেন, ‘আমাদের চার এমপির শপথ নিয়ে দলের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও দল ও হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছে।’ অন্যদিকে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘চার এমপি শপথ নেওয়ায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ। যেখানে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই ভোট হয়ে গেছে, বিএনপির আপসহীন নেত্রী খালেদার জিয়ার নেতৃত্বে দল কোনো সময় আপস করেনি, সেখানে হঠাৎ করে আমাদের চার-পাঁচজন এমপির শপথগ্রহণ তৃণমূল নেতাকর্মীরা মেনে নেয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাবন্দি রেখে দলীয় এমপিদের শপথ তৃণমূল গ্রহণ করেনি।’ নাজিম উদ্দিন আরো বলেন, ‘এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের হতে পারে না।’ উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আহমেদ হাসনাত বলেন, ‘আমি মনে করি, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চার এমপির শপথের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা তৃণমূল মেনে নিয়েছে। শীর্ষপর্যায়ে কী হচ্ছে তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এখানে ক্ষোভ প্রকাশের কিছু আছে বলে মনে করি না।’
রাজশাহীতে দুই রকম মত : রাজশাহী থেকে রফিকুল ইসলাম জানান, রাজশাহী বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ চার এমপির শপথকে সঠিক বলে মনে করছে। আবার কেউ কেউ মির্জা ফখরুলের অবস্থানকেও সঠিক মনে করছে। তবে অনেকের দাবি, দল সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এ কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও এসব নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আশরাফুল কবির বুলু বলেন, ‘বিএনপির বর্তমান অবস্থান নিয়ে দুর্গাপুরের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো আলোচনা দেখছি না। এসব নিয়ে কারো তেমন আগ্রহও নাই। দল সঠিকভাবে পরিচালনা হলে হয়তো সবাই আবার দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মনোযোগী হবে।’ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, ‘চার এমপির শপথের বিষয়টি নিয়ে প্রথমে একটু ভুল-বোঝাবুঝি ছিল। তবে যেহেতু তাঁরা বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তেই তাঁরা এটি করেছেন, সেহেতু তিনি যেটা ভালো মনে করেছেন সেটিই করেছেন। তবে এই চার এমপি এখন যদি সংসদে গিয়ে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সোচ্চার হতে পারেন, তাহলে যেটুকু হতাশা ছিল তা হয়তো কেটে যাবে।’ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে রাতের আঁধারেই ভোট হয়ে গেছে। তার পরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বিএনপি জোটের কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের ওপর অবশ্যই এলাকার জগণের চাপ আছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে দলীয় ফোরামে কখনো মুখ খোলার সুযোগ পেলে সেখানেই আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব।’ মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘যে চার এমপি শপথ নিয়েছেন, নিশ্চয় দলের সিদ্ধান্তেই নিয়েছেন। পাশাপাশি দলের মহাসচিব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটিও সঠিক আছে। তবে যাঁরা শপথ নিয়েছেন তাঁরা যে পদত্যাগ করতে পারবেন না তা নয়।’
কিশোরগঞ্জে নেতাকর্মীরা বিভ্রান্তিতে : শফিক আদনান জানান, বিএনপির বর্তমান রাজনীতি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। দলের হাইকমান্ড থেকেও এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। ফলে তৃণমূলে বিভ্রান্তি আছে। হতাশায়ও ভুগছে অনেকে। জেলা বিএনপির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আর রাজনীতির মধ্যে নেই। যে রাজনীতি বুঝি না, যা মাথায় ঢুকে না তা আর করতে চাই না। আপতত ব্যবসায় মন দিয়েছি। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, আর না। যখন বিএনপির রাজনীতি স্পষ্ট হবে তখন আবার মাঠে দেখতে পাবেন।’ জেলা বিএনপির সাবেক এক যুগ্ম সম্পাদক বলেন, নির্বাচন থেকে শুরু করে পরবর্তী বিষয়সহ প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তহীনতা মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের হতাশ ও ব্যথিত করেছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো দল যখন চতুর্মুখী চাপে থাকে, দলীয় প্রধান কারাগারে থাকে, তখন নেতাকর্মীরা হতাশায় ভুগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপির জনভিত্তি রয়েছে।’ বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে হাইকমান্ড থেকে কোনো বার্তা আমরা পাইনি।’ গত নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী রেজাউল করিম খান চুন্নু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মহল চাইছিল বিএনপির যে কটি আসন পেয়েছে, তা নিয়েই যেন সংসদে যায়। সেখানে তারা চেয়ারপারসনের মুক্তি ও সরকারের সমালোচানা করুক। এতে তারেক রহমানের সায় ও নির্দেশ ছিল। দলও শেষ পর্যন্ত সেইভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বগুড়ায় ক্ষোভ ফখরুলের ওপর : লিমন বাসার জানান, বিএনপির তৃণমূলের একাধিক নেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বগুড়া থেকে বিপুল ভোটে জিতলেন, অথচ শপথ নিলেন না। তাঁর শপথ না নেওয়ার খেসারত এখন এই এলাকার মানুষকে দিতে হবে। নিশ্চিত আসনটি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।