ছাতকের নৌপথে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়
বার্তা ডেস্ক : নয় মাস গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর ঈদ সামনে রেখে আবারও মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে সিলেট অঞ্চলের চাঁদাবাজরা। এরই ইঙ্গিত মিলছে সুনামগঞ্জের ছাতক-কোম্পানীগঞ্জ নৌপথ থেকে। প্রতিদিনই এ নৌপথের ৬-৮টি স্থান থেকে ৪-৫ লাখ টাকার মতো চাঁদাবাজি হচ্ছে পাথর-বালু ও চুনাপাথরবাহী বার্জ-কার্গো ও নৌকা থেকে। ছাতকের সুরমা নদীতে এভাবে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ), ছাতক পৌরসভা এবং শাহজালাল সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন নামে। অথচ বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব কোনো ঘাটই নেই। শাহজালাল সমিতিসহ চাঁদা আদায়কারী বিভিন্ন সংগঠনেরও কোনো বৈধতা নেই। এসব চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছেন পৌরসভার কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
চাঁদাবাজি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ ১৪ মে রাতে ছাতক শহরের নদীতে চাঁদাবাজি নিয়ে ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এতে গুলি লেগে মারা যান সাহাবুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় ব্যবসায়ীসহ আসামি করা হয়েছে চারশ’রও বেশি ব্যক্তিকে। এ পর্যন্ত পুলিশ গ্রেফতার করেছে ২৮ জনকে। আবার অনেকে জামিনও নিয়েছে। গতকাল ছাতক থানা পুলিশ নৌপথে চাঁদাবাজির অভিযোগে ফিরোজ নামের একজনকে গ্রেফতার করেছে। এর আগে মানিক মিয়া ও মোজাহিদ নামের দু’জনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ফিরোজের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ইন্সপেক্টর আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, নৌপথে চাঁদাবাজদের রুখতে পুলিশ হার্ড লাইনে রয়েছে।
গত বছরের ১৬ আগস্ট দৈনিক সমকালে ‘সিলেট অঞ্চলের নৌপথে প্রতিদিন ২০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়। ওই সময় কয়েকজন চাঁদাবাজকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার ৯ মাস পর সম্প্রতি আবারও একাধিক স্থানে চাঁদাবাজির কারণে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এরই মধ্যে পাথর ব্যবসায়ী সমিতি, শাহপরাণ ইঞ্জিন নৌকা মালিক সমিতি ও একতা বালু উত্তোলন এবং সরবরাহকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতিসহ পাঁচটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়েছে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় এমপি, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা আলাদাভাবে বৈঠকও করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবেদা আফসারি বলেন, উপজেলা প্রশাসন চাঁদাবাজদের ব্যাপারে সোচ্চার। ব্যবসায়ী ও ইজারাদারদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈধ ইজারাদারদের প্রতি ইজারার হার সংবলিত চার্ট টানানোর নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে চাঁদা তুলছে তারা বৈঠকে আসেনি। পুলিশকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জের সুরমা, চেলা এবং পিয়াইন নদী পথে বালু, পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা নিতে আসে বাল্ক্কহেড, বার্জ, কার্গো ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ শতাধিক বিভিন্ন ধরনের নৌযান। বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের যান চলাচল আরও বেড়ে যায়। এসব নৌযান ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর সংগ্রহ করে। এ ছাড়া ভারত থেকে চুনাপাথর, বোল্ডার-সিঙ্গেল আমদানি করেও ছাতক নৌ-বন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাম্পিং করা হয়। এসব স্থানের ব্যবসায়ীদের নৌযানকে ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী নৌপথের ইছাকলস, চেলা নদীর মুখ, থানাঘাট, চাঁদনীঘাট, পেপারমিল ঘাট, নোয়ারাইঘাট ও বারকাপন এলাকায় চাঁদা দিতে হয়। যাদের চাঁদা আদায়ের বৈধতা রয়েছে তারাও অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করছেন টোল আদায়ের নামে। প্রতিদিন শ’খানেক ছোট-বড় নৌযানকে ঘাটে ঘাটে এ কারণে গড়ে চার হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে।
২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছাতক নদীবন্দর এলাকা ঘোষণার পর ইজারা শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। এ সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট থেকে এটি দুই কোটি দুই হাজার টাকায় ইজারা নেয় মেসার্স কালু মিয়া এন্টারপ্রাইজ। নৌযানের ধরন ও আকার অনুযায়ী ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে টোল আদায়ের কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি আদায় করছে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। ছাতক পৌরসভার পক্ষ থেকে দুই ধরনের টোল আদায় করার কথা। প্রতিটি নৌযানকে নদীর ঘাট ব্যবহারে ৩৫০ টাকা ও পৌরসভার ট্যাক্স হিসেবে ৪০০ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু ট্যাক্স আদায়কারীরা আদায় করছেন পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা। বিষয়টি স্বীকার করে পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, এখন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায় করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে নজরদারিও করা হবে। এদিকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাপস চৌধুরীসহ ৯ কাউন্সিলর ও তিন সাধারণ লোক নিয়ে গত এপ্রিল মাসে গড়ে ওঠা শাহজালাল পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি নামের একটি নতুন সংগঠন বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছে পাথর ব্যবসায়ী ও নৌযান শ্রমিকদের ওপর। পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জসিম উদ্দিন সুমেন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তাদের সঙ্গে ছাতক পৌরসভার ৯ কাউন্সিলর রয়েছেন জানিয়ে সুমেন বলেন, উড়াইল সমিতির মাধ্যমে তারা তাদের সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। সদস্য ছাড়া কারও নৌযান থেকে টাকা আদায় করা হয় না। নতুন সংগঠন করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ছাতকে বিভিন্ন পাথর ব্যবসায়ী সমিতি রয়েছে। ব্যবসা করার জন্য তারা নতুন সংগঠন করেছেন।
ছাতক বাজার একতা বালু উত্তোলন ও সরবরাহকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, নৌপথে অতিরিক্ত ও অবৈধ চাঁদা আদায় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয় না। বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান (রিভার পোর্ট) জানিয়েছেন, অতিরিক্ত হারে টাকা তোলার কথা নয়। তবে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সংঘর্ষের নেপথ্য কথা :১৪ মে রাতে ছাতক শহরে নৌপথে চাঁদাবাজি-সংক্রান্ত ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় হত্যাসহ তিনটি মামলা হয়। এসআই দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে ৯৮ জনের নাম উল্লেখ করে দুইশ’র বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিস্ম্ফোরক মামলা করেছেন। এসআই পলাশ সরকার বাদী হয়ে পৌরসভার ৯ কাউন্সিলরসহ ৯৫ জনের নাম উলেল্গখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আড়াই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশকে হেনস্তা করার মামলা করেছেন। এ ছাড়া নিহত ঠেলা চালকের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উলেল্গখ করে হত্যা মামলা করেন। রহিম আলী নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ, এ ঘটনায় পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী ও সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম আহমদ চৌধুরীর সংশ্নিষ্টতা রয়েছে।
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র আবুল কালাম জানান, তাদের পারিবারিক সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে একটি পক্ষ এসব অপপ্রচার করছে। তাদের অবস্থান সবসময়ই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। এদিকে তিনটি মামলার মূল আসামিদের তালিকায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। ব্যবসায়ীদের আসামি করে মামলা করা নিয়ে নানা প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। কারও কারও মতে, নৌপথে চাঁদাবাজদের রুখতে আন্দোলনকারীদের অনেককেই সুযোগ বুঝে আসামি করা হয়েছে। তবে থানার ইন্সপেক্টর আমিনুল ইসলাম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, সব ব্যবসায়ী ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তদন্ত করেই সংশ্নিষ্টদের আসামি করা হয়েছে। খবর : দৈনিক সমকাল