নাহার মনিকা::

আমার অর্ধেক পূরণ হওয়া শখের নাম সত্যি আর মিথ্যা, আসল দুধের বদলে ঘোলে মেটানো সাধ। এক সন্ধ্যায় যখন এ দু’টোকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম, মনে আছে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে রিক্সা থেমেছিল। আমার কোলের ওপরে রাখা কাঁচের বৈয়াম, আব্বা নেমে দু’হাতে আগলে ধরেছিল। রিক্সাওয়ালা ঐদিন কেন জানি আগমন বার্তা ঘোষণার মত করে বেল বাজালো। ছোট ভাই তার চুল ঝাঁকিয়ে লাফাতে লাফাতে নেমে এসে আমাদেরকে সঙ্গ দিয়ে দোতলায় উঠলো। আম্মাও আঁচলে হাত মুছে হাসিমুখে এগিয়ে এসেছে।
আমাদের শখ পূরণের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। 
-‘এহ্ কাছিম? –আম্মার চেহারা ঝটিতি কালো হয়ে গেল। লাল সোনালী মাছেদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কোলা ব্যাঙ এর মাপে দুটো কচ্ছপ দেখে তার শ্যামবর্ণ চেহারা বিকৃত কুঞ্চনে ছেয়ে গিয়েছিল। 
কচ্ছপ পুষবো আমি নিজেও আগে কখনো ভাবিনি। অথচ দেখতে দেখতে পনেরো বৎসর হয়ে গেল। আব্বার মত পোশাকি ভাষায় যদি বলি তো বলবো যে এতগুলো বছরে কত ঘাত, প্রতিঘাত এসেছে, চলে গিয়েছে, কিছু কিছু তো এদেরকে ঘিরেই হলো, কিন্তু সত্যি-মিথ্যা ওরা আছে আমার ঘরে, বিছানার পাশে আমার পড়ার টেবিল, জানালা ঘেষে টেবিলের এক কোনায় সেই কাঁচের বৈয়ামে, কালচে সবুজ প্যাপিরাসের মত ছাপ পিঠে নিয়ে, চার হাত পা ছড়িয়ে বাড়িয়ে, গলা লম্বা করে, গুটিয়ে একেবারে নাই হয়ে গিয়ে একটুও বেশী জায়গা দখল না করে, আছে ওরা। 
আমার অর্ধেক শখের তবু স্থান সংকুলান হয়েছিল ভেবে ভালো লাগে। সে তুলনায় আব্বার সাধ কিচ্ছুমাত্র পূরণ হয়নি, অথচ কত দীর্ঘ বিচিত্র তালিকা ছিল তার। আঙ্গুর ফলের গাছ লাগানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে আব্বা মারা গিয়েছিল। অসুখ যখন দিগ্বিদিক রাজ্য জয়ের বাসনায় শরীর উজাড় করে দিচ্ছে, তার মনে তখনো সুস্থ্য হয়ে ঘরে ফিরবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা! হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রথমদিকেও ভালো করে কথাবার্তা বলতো, পরে কথা জড়িয়ে গেলে ফার্মেসী’র প্যাডের টুকরো কাগজে লিখে লিখে দিতো, একবার লিখলো ‘কোথায় ভালো আঙ্গুরের গাছ পাওয়া যায় তোর চাচাকে খোঁজ নিতে বল, ভালো হয়ে আখাউড়ার জমিতে গিয়ে আঙ্গুর চাষ করবো। ভাইনফিল্ড বানাবো, খুব লাভজনক ব্যবসা’। কাগজের এককোনায় কালো কালিতে থোকা থোকা আঙ্গুর ফলের ছবি। আব্বাকে বলা বারণ যে আম্মা আর চাচা মিলে আখাউড়ার জমি বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে। চিকিৎসার সাধ্যাতীত খরচে কিছু ত্রাণ দরকার হয়ে পড়েছে। 
আব্বার হাতের লেখার সুনাম ছিল, তার চিরলপাতার মত হস্তাক্ষর ধীরে ধীরে কাঁপা কাঁপা হচ্ছিল আর শেষের দিকে কণ্ঠস্বরের মতই জড়িয়ে বাঁকা হয়ে যেতো। 
তখন আমার অনার্স থার্ড ইয়ার। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে আমি সোজা হাসপাতালে যেতাম। আব্বাকে বালিশ উঁচু করে শুইয়ে আমি সামনে চেয়ার টেনে বসতাম। স্বপ্নে আব্বার আঙ্গুর বাগান প্রসারিত হচ্ছিল, প্রতিদিন টনকে টন টাটকা আঙ্গুর তুলতাম আমরা। আত্মীয় স্বজন সবাইকে কাজে লাগিয়ে দিতাম। ভাইনফিল্ড এত বড় হচ্ছিল যে আম্মা আর ভাইকে রেখে দূরে বসবাসের উপায় রইল না। আমরা সবাই মিলে আখাউড়া চলে গেলাম। সেখানে ব্রিটিশ আমলে চা বাগানে যেসব বাংলো বাড়ি ছিল, সেই আদলে একটা বাংলো বানালো আব্বা। আঙ্গুরলতা দিয়ে ঘেরা সেই বাড়িতে সারাক্ষণ পাকা আঙ্গুরের মদলস ঘ্রাণ। তারপর তখন অত আঙ্গুর দিয়ে কি করবো? আমি তো ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ করে ফেলবো। আব্বা আমাকে আঙ্গুর বাগানের ম্যানেজার বানিয়ে দিলো। এবার আমাদের ব্যবসা বাড়ানোর পালা। আমরা আঙ্গুরের জুস ফ্যাক্টরী বসালাম। তার আগে আব্বা আর আমি জার্মানী গেলাম, মেশিনারিজ কিনতে। অনেকগুলো ভাইনইয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কি বিশাল আর সুবিন্যস্ত সব আঙ্গুরের বাগান! 
আমরা তখন একসঙ্গে দেখা একটা সিনেমা নিয়ে গল্প করি। এ ওয়াক ইন দ্য ক্লাউড- যুদ্ধ ফেরত নায়ক পথের মধ্যে নায়িকার দেখা পায়, নায়িকা আগের প্রেমিক দিয়ে প্রতারিত, এবং অন্তস্বত্তা। নায়ক তার প্রেমিকের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে সত্যিকারের প্রেমে পড়ে যায়। ঐ যে বলে না, ইউ ফেইক ইট, আন্টিল ইউ মেইক ইট, তেমন। নায়িকার বাবার বিরাট আঙ্গুর বাগান। পা দিয়ে আঙ্গুর থেতলানোর একটা মজার দৃশ্য মনে করিয়ে আমি আব্বার ঠোঁটের কোনে একটু হাসি এনে দেই। 
আর নিজে, এইবার আব্বার স্বপ্নের মধ্যে সশরীরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে আমার। মন চায় আমার জন্যও ওই রকম যুদ্ধ ফেরত কেউ আসুক। হেলাফেলার স্মার্টনেস নিয়ে সে আমাদের বসার ঘরে বসে চা নাস্তা খাবে। আম্মা যাকে দেখে মাথায় ঘোমটা টানা ভুলে যাবে। আমি চাইবো সে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাক, দূরে কোথাও মেঘের নীচে পাহাড়ের কোলে। আর সে থেকে যেতে চাইবে আমাদের আঙ্গুর বাগানে। আমার সত্যি –মিথ্যার সঙ্গে যার পর নাই ভাব হবে তার। 
আব্বার সঙ্গে দেখা স্বপ্ন আর তার অসুস্থ্য শরীরের ব্যথা হরণের সাময়িক টোটকা চিরকুটগুলো আমার হাতব্যাগের ভেতরের পকেট ঠাসা ছিল। পরে গুনে দেখেছি, সাতচল্লিশটা। শেষের দিকে প্রায় মাস দেড়েক আব্বা জ্ঞানশূণ্য অবস্থায় ছিল। এন্ড ‘দ্য হোপ হাই আপ’ নিয়ে থাকা বাপ আমার দ্বিতীয় কেমোথেরাপি’র পর কোমায় চলে যাবার আগের সন্ধ্যায় কোন মতে আধা ঢোক পানি গিলতে পারলো। তার চোখের মণি ছাই বর্ণ ধারণ করলো, আর ত্বক অ-মাজা তামার বাটির মত দেখালো, ব্যথার কষ্ট যখন আর কহতব্য না থেকে আব্বাকে নিস্তেজ বানিয়ে রাখলো, তখন আমি হাসপাতালের বাইরে এসে কাছাকাছি দোকানগুলোতে আঙ্গুরের গাছ না হোক, নিদেনপক্ষে জুস পাওয়া যায় কিনা, খুঁজেছিলাম। ধুলিময় কালচে সন্ধ্যায় ইতস্তত রিক্সা, গাড়ির সমাগম ডিঙ্গিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে কতকিছুর দোকান। আম, কমলা এমনকি ফিকে গোলাপী রঙ্গের পেয়ারার জুসও কোন কোন দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু আঙ্গুরের জুস না। 
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে আঙ্গুর চাষের প্রতিযোগিতায় নামতে ইচ্ছুক আমার আব্বা মারা গেছে আজকে নয় বৎসর। 
আমার বয়সের কাছাকাছি তার প্রখর যৌবনের একটা বাঁধাই করা ফটো আছে আমাদের বাসায়। উলটে আঁচড়ানো চুল, কোট টাই আর টাটকা চোখের চাউনির সঙ্গে হাসপাতালের মৃত্যুশয্যার মানুষটার কোন মিল নেই। সব মানুষ নিশ্চয়ই মৃত্যুকালে নিজের চেহারার সঙ্গে এত দূরত্ব তৈরী করে না। আব্বার স্বাভাবিক চেহারা মিলিয়ে গিয়ে স্মৃতিতে পোড়া মুখ কিভাবে যেন পোক্ত হয়ে যায়, ভালো লাগে না আমার। জোর করে আগেকার, আরো আগেকার, তার চেয়েও আগেকার সুখের সময়ে ফেরত যেতে চাই। বালিশে মাথাগুজে শুয়ে থাকি, ঘুম আসে না। মাথা উঁচিয়ে চুলের ফাঁক দিয়ে দেখি বৈয়ামের ভেতর সত্যি আর মিথ্যা কিট কিট করে মানিপ্ল্যান্টের শেকড় খাচ্ছে। ওদের মার্বেল চোখ জ্বলজ্বলে। চুলের গোছার ফাঁক দিয়ে ওদেরকে দেখি, স্থির তাকিয়ে আছে। কার চোখ বেশী স্থির, সত্যি নাকি মিথ্যার? 
আব্বা ছেলেমেয়ের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে ভালোবাসতো। সন্ধ্যাবেলা বসার ঘরে সোফায় আধশোয়া হয়ে আমাদের দুই ভাইবোনকে ডেকে উপদেশমূলক কথাবার্তা বিতরণ করা তার নেশা ছিল। শোবার ঘরে আম্মা সে সময়টায় কপাল ঢেকে কান বাইরে রেখে ঘোমটা দিয়ে গুন গুন করে হয় কোরান শরীফ, নইলে কাসাসুল আম্বিয়া নয়তো মাকসুদুল মোমেনিন পড়তো, আমরা তখন আব্বার কুঁজো হয়ে আসা পিঠ আর স্যান্ডো গেঞ্জি উপচিয়ে বুকের খাঁচা দেখতাম, কথা বলার উত্তেজনায় তার শ্বাস ঘন হয়ে আসতো। আমার মনে হতো বাংলাদেশের সব বেসরকারী কলেজের যুক্তিবিদ্যা’র শিক্ষকের চেহারা এই রকম। বাড়িতে বইপত্র থাকে, নিজেরা মাথাগুজে পড়ে আর তাদের স্ত্রী কড়া রকমের ধর্ম কর্ম ক’রে অবসরে রান্নাবান্না করে। 
একটু বড়, মানে ক্লাশ নাইন টেনে ওঠার পরে অবশ্য আব্বার শিশুতোষ কথাগুলো মনে ধরতো – -‘কোন কিছুর রহস্য ভেদ হয়ে গেলে আর ভয় থাকে না, সাপের কথাই ধর, তুমি যখন জানবা যে সাপ আসলে মানুষকে ভয় পায় তখন কি আর তুমি সাপ ভয় পাবা? নিজেকে সবসময় আপডেটেট রাখবা, দেখবা ভয় ডর খতম’। 
আমি নাকি সুরে বলতাম-‘ আমি তখনো সাপ ভয় পাবো আব্বা, সাপের নাম শুনলেও ভয় লাগে’। 
-‘সবাইকে সবকিছু বুঝাইতে যাওয়া বোকামী,’ আব্বার স্বচ্ছ স্ফটিক চোখে তখন ব্যর্থতা, হতাশার মিশ্র এক রং খেলে যেতো, -‘সৃষ্টিকর্তার ডিপার্টমেন্টগুলি যে আস্তে আস্তে রিপ্লেস হয়ে যাইতেছে এইটা তোদের আম্মাকে বুঝানো সম্ভব না, কিন্তু তুই বুঝতে চেষ্টা কর। আগে মানুষ মনসা দেবীর পুজা দিতো, বৃষ্টি না হইলে আল্লা মেঘ দে পানি দে করতো, এখন দেখ কার্বলিক এসিড বাজারে আসাতে মনসা দেবীর কথা আর মানুষ তেমন মনে করে না। আর মেঘ বৃষ্টির জন্য তো আবহাওয়া অফিস আছেই’। 
আব্বা ছোটবেলায় বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিনে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মাটির ছোট্ট কলসিতে ফুল পাতা গুজে সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে পানি আর চাল ডাল মেগে বৃষ্টি আনয়নের কাহিনীকে প্রায় রূপকথার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বর্ণনা করতো। 
যে মানুষ এত যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারে, সেই লোক কেন আম্মার কথায় প্রতিবাদ করে না, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না। 
-‘আশা, আর উচ্চাশা মানুষকে বাঁচায়া রাখে, কিপ ইওর হেড এন্ড হোপ হাই আপ,’ -তার বক্তৃতার উপসংহার প্রায়ই এই বাক্য দিয়ে শেষ হলে আমিও আমার পিতার মতো মাথা নেড়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে সায় দিতাম। 
জানি না আব্বা আমার মাথা নেড়ে সায় দেয়া আর আমার মনের ভেতরের ভাবনার তফাৎ বুঝতে পারতো কিনা। 
আব্বার গাছপালা ভালোবাসার মত আমারও খানিকটা সারমেয় প্রীতি ছিল। মৃত্যুশয্যায় বসে দেখা তার স্বপ্নের আঙ্গুর বাগানে আমি আবারো কুকুর পুষতে চেয়েছিলাম। 
নানান কিসিমের কুকুরের ছবি আর নাম ধাম সহ আমার একটা বই ছিল, ছবিগুলো একসময় আর বইয়ের পাতায় স্থির থাকতে চায় নি। তুল তুলে নরম লোমশ একটা পুডলের জন্য হাত নিশপিশ করতো। 
সকালের নাস্তার রুটি রাস্তার কুকুরকে খাইয়ে মনে মনে ভাবতাম একদিন টাকা হলে কুকুরদের জন্য বড় বিশালাকার হোসপাইপ দিয়ে সবকটাকে গোসল করাবো, শ্যাম্পু ঘষে। দু’ একটা কুকুর শ্যাম্পুর ফ্যানা গায়ে মেখে ছুটে বেড়িয়ে যাবে আর আমি পেছন পেছন দৌড়ে মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়ালে চলমান ট্র্যাফিক থেমে যাবে। অথচ আম্মার দু’চোখের যম হলো কুকুর। একদিন আটার রুটির টুকরা আমার মুঠিতে পেয়ে সে কি মার মারলো! রুটি বেলার বেলনি ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন আমার বয়স কিন্তু চৌদ্দ ছাড়িয়ে গেছে। 
আমার জীবনের বাইশ বাইশটা বর্ষা ঋতুর সাক্ষী আব্বা তখন জোড়া কচ্ছপ কিনে দিয়ে শখ আধাআধি পূরণ করলো, আর সেই আধাআধি আজ পর্যন্ত আমাকে পুরোটা আক্রান্ত করে রেখেছে। 
সন্তানকে শাস্তি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার একটা রেওয়াজ আছে বোধহয়- আম্মার দেয়া মারের প্রায়শ্চিত্ত করতে আব্বা সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে, শুধু আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখিয়ে আনলো। ওহ বলা হয়নি আব্বা খুব সিনেমা দেখতো, সিনেমা হলে গিয়ে খুব কম। বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি’র ফেষ্টিভাল, কালচালার সেন্টারের প্রদশর্নীতে বাংলা হিন্দি, ইংরেজী সিনেমা যতগুলো পারা যায় দেখতো আব্বা। আমাকে নিয়ে সেদিন প্রথম, সিনেমার নাম ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার। আব্বা বললো- খুব ভালো সিনেমা। নায়িকার নাম মেরিল ষ্ট্রীপ, আর নায়কের নাম ডাষ্টিন হফম্যান। আমি সেই প্রথম নায়িকা ছেড়ে নায়কের প্রেমে পড়ে গেলাম। মনে হলো আমিই যেন স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছি আর সে আমার শিশুপুত্রকে দেখভাল করছে। মেরিল ষ্ট্রিপের ওপরে ভয়ানক রাগ হয়েছিল, এমন করে কেউ স্বামী সন্তান ছেড়ে যায়? আর বাচ্চাটা একটা সাক্ষাত দেবশিশু। পাষাণী কোথাকার! 
আব্বা তখন সংসারে মা না থাকলে বাচ্চা মানুষ করা কত কঠিন ইত্যাদি প্রথাগত বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপে নিজে নিজেই রাগ সঙ্গীতের মত বেজে চলেছে। 
আর আমি রিক্সার দুলুনিতে ডাষ্টিন হফম্যানের কথা ভাবতে ভাবতে কাঁটাবনের পোষা পশু পাখির দোকানগুলিতে শিকের ফাঁক গলে কুকুরছানার কান, খাঁচার ভেতরে রঙ্গিন পাখি এইসব দেখি। 
আমার বেখেয়াল আব্বার মনোযোগ পায়। কিশোরী কন্যার পশুপ্রীতি নিধন করা উচিৎ না এই ভেবে হয়তো আব্বা তার মত বদলালো, বললো- ‘ কুকুরতো পালতে পারবি না। মাছ নাইলে পাখি এই দুইটার মধ্যে একটা ঠিক কর’। 
বাসায় ফিরলে সবশুনে আট বছরের ভাই ‘ফিশ ফিশ’ বলে হৈ হৈ করে উঠলো। আব্বা আর ভাই মিলে যখন এক ধারসে ফিস ফিস করে, তখন আমার বেজার মনের দিক নিশানা দ্রুতগতিতে একটা লোমশ ছোট আল্লাদী কুকুরের দিকে ছুটে যায়। মাছ, পাখি এসবের কথা শুনে প্রানী পোষার শখের পারদ হঠাৎ করে নেমে গেল, খুব আটপৌরে সাধ হয়ে গেল, দিলেও চলে, না হলেও হয়। মনে হলো আমার না, অন্য আর কারো শখের কিছু কেনা হবে। 
তবু একদিন আব্বা কিছু না বলে কয়ে নিয়ে গেলো। কাঁটাবনের দোকানগুলো থেকে লোকজন কত কিছু কিনছে। আমার কেন যেন কোন মাছ পছন্দ হচ্ছে না। এ দোকান সে দোকান ঘুরে দেখতেই ভালো লাগছিল। গোল্ড ফিস, মার্লে, র‌্যাম্বোশার্ক এসব নাম শুনে বিকারহীন বন্দী রঙ্গিন মাছেদের দেখছিলাম, । হঠাৎ পাশে মাটির গামলায় ছোট ছোট কচ্ছপ দেখে আমি স্থির দাঁড়িয়ে পড়ি। মনে হলো, এরা স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নেয়া নিরীহ কেউ। কারুর ব্যক্তিগত জায়গা দখল করবে না। সম্মোহিতের মত আকর্ষণ বোধ করলাম। 
আব্বা আমাকে টেনে সরাতে পারে না। কুকুরের বদলে জোড়া কচ্ছপ। যা চাই, তা না পেলেও নিজের জন্য কিছু নিয়ে বাসায় ফিরলাম। 
ভাই দুই চারদিন হৈ হল্লা করলো, ওদের নাম দিলো- ‘হাবিল কাবিল’। আম্মা ভীষণ রেগে গেল- ‘হাবিল কাবিল হইল আদম আঃ এর সন্তান, কাছিমের এই নাম রাখলে তোদের দোজকেও জাগা হবে না’। 
ভাই কচ্ছপ ভালোবাসে কিন্তু আম্মাকে ভয় পায়। সে নাম উঠিয়ে নিলো। 
আমি তারপর ওদের নাম দিলাম সত্যি আর মিথ্যা, আব্বা বললো- ‘ভালো হইছে, নিরপেক্ষ হইছে’। 
কচ্ছপ দুটো আসার পরে আব্বা সাহসী হয়ে উঠেছে মনে হয়। প্রায়ই সন্ধ্যেবেলা আমার ঘরে চেয়ার টেনে সত্যি মিথ্যার সামনে বসে কথা বলে। ওরা ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় কথা গিলছে। 
আম্মা শুরু থেকে একগুয়ে- কাছিম বাসায় রাখলে নামাজ রোজা কিচ্ছু হবে না। 
-এই মছলা কই পাইলা? তুমি মৌলানা?- আব্বা বেমানান ধমকে উঠলে, আশ্চর্য হই। আম্মা তারপর থেকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। আমাকে, বা কচ্ছপ দুটোকে কিছু বলে করে না, কিন্তু আমি তার থেকে সভয়ে দূরে থাকি। 
আমার ঘর থেকে কেউ বের হলে আম্মা তার গায়ে ‘কাছিম কাছিম’ গন্ধ পায়। তার ছোটবেলার হাটের কথা মনে পড়ে। বাড়ি থেকে একটু হাটলে দূরে নদীর ঘাট। আম্মা আর তার বান্ধবীরা খেয়া নৌকা পার হয়ে গঞ্জের হাট পেরিয়ে স্কুলে যেতো। কত শত দোকান, খোলা আনাজপাতি। এর মধ্যে এক কোনায় কাছিমের মাংসের দোকান। খোলা চাটাইয়ের ওপরে লাল লাল মাংশ, অদ্ভুত গা গুলানো গন্ধ সেগুলোর। আম্মা আর তার বান্ধবীরা ওড়নায় নাক চেপে ওইটুক জায়গা পার হতো দ্রুত। এইসব গল্প আম্মা নাক কুচকে বলতো, মনে হতো এখনো চারপাশের বাতাসে সেই গন্ধ কাঠফাটা গরমে অগভীর পানিতে মহিষের মত গা এলিয়ে দিয়ে আছে। 
আর ঘাটের ঢালের দিকে হাটলে যে মেথর পট্টি ছিল সেখান দিয়ে কালে ভদ্রে গেছে তারা। ও খোদা সে দৃশ্য আম্মা জীবনে ভুলবে কি করে? কতগুলো কালো কুচ্ছিত শুকর তাদের ছানাপোনা সমেত কাদার মধ্যে গাদাগাদি করতো, আর কী অসহনীয় গন্ধ! আম্মা শুওরের নামও মাথায় আনতে চায় না। গন্ধ বিষয়ে তার অতি সংবেদনশীল নাসিকা দেখে কুকুরের ঘ্রানশক্তির কথা মনে আসে। কিন্তু সে কথা বলার মত পারস্পরিক নৈকট্য আমাদের মধ্যে দিন দিন কমে আসছে। আমার সঙ্গে আম্মার কথপোকথন ঘুরে ফিরে কচ্ছপের তিক্ততায় চলে আসে। হিন্দুদের ভগবানকে আমি ঘরে ঢুকিয়েছি। 
-‘তুমি এইসব ফালতু জিনিষ কোথায় পাইছো’- ইদানিং মানে কচ্ছপ প্রসঙ্গে আব্বার অনেক কাজের মধ্যে একটা হলো কোন না কোনভাবে আম্মাকে ভুল প্রমাণ করা। 
– সজল বলছে। ওদের ভগবান বিষ্ণু শরীরের উপরের অংশ মানুষের এবং নিচের অংশ কাছিমের রূপ ধারণ করে। কাছিমের চাইরটা হাত না?’ 
সজল মামা প্রসঙ্গে আব্বার কণ্ঠ ম্রিয়মান শোনায়। সজল আম্মার চাচাতো ভাই সাত্তার মামার বন্ধু, ভার্সিটির ইংরেজী সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট, পারিবারিক কি সব ব্যবসা আছে, মামার চাকরী বাকরী করার প্রয়োজন পড়ে না। তার এই প্রয়োজন না পরা আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত সমীহ আদায় করে নেয়। কি অদ্ভুত! এমনও মানুষ থাকে যার চাকরী করার দরকার নাই! সজল মামা বাসায় এলে আমরা তাই প্রয়োজনের বেশী পরিচ্ছন্ন, বিনয়ী, যদিও সে আমাদের বাসায় আসতে আসতে রোজকার ঘরের লোক। তার পড়াশোনা পরিধি এত বিরাট যে আব্বাও কালেভদ্রে শজারুর মত আটকা পড়ে। 
মিরপুরে নিজের বাড়িতে সজল মামা আমাদেরকে মামা নিমন্ত্রণ করেছিল। আব্বা আম্মা না না করলে সজল মামা তখন হাত জোর করেছিল- ‘আপনেদের বাসায় খাইতে খাইতে বড় হইলাম আর আমার বাসায় একদিন আসবেন না তা কি কইরা হয়?’ তার বোনদের দু’জনেই অষ্ট্রেলিয়া থাকে, আম্মা গলে পানি হয়েছিল। সজল মামা রান্না করেনি, হোটেলের কাচ্চি, ভালো ভালো মিষ্টি আর দই এসব এনে খাইয়েছে। আমার বাইরের খাওয়া খুব ভালো লাগে, আর ভাইয়ের তো কথাই নাই। আব্বাও খুব মাথা নেড়ে নেড়ে খেলো, আম্মা শুধু- এত পয়সা খরচের কি দরকার, ওর আব্বার গ্যাসের প্রব্লেম এইসব দরকারী কথা বার্তা টেনে নিয়ে যেতে থাকলো। 
খাওয়ার পরে সাত্তার মামা আমাকে বললো- ‘চল তোরে একটা ঘর দেখাই’। 
দোতলায় ডানদিকে দরজার কাছে স্তুপাকার খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা। ভেতরে ঢুকলে বইয়ের দেয়াল। বিছানার একপাশে বইয়ের পাহাড়। এখানে সজল মামা তার ল্যাকপ্যাকে শরীর বড় টি-শার্টে ঢেকে হাঁটু ভেঙ্গে দ বানিয়ে চেয়ারে বসে টি’এস এলিয়ট পড়ে। তখন তাকে বয়সের চেয়ে বয়স্ক দেখায়। ঘরটায় ভ্যাপ্সা গন্ধ। আরো বড় বড় জানালা থাকলে ভালো হতো। সেই প্রথম আমি টের পাই সূর্যের আলোর জন্য আমার তীব্র আকুতি আছে। 
দুই মামা বিছানায় এলিয়ে নিচু অথচ উত্তেজক কণ্ঠে কি নিয়ে যেন কথা বলে। 
আমি পা টিপে টিপে পত্রিকা নিয়ে চেয়ারে বসলে সজল মামা ঘুরে দেখে, তার মুখের ভাবে একটু আগের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস 
-সামনের বছর তুই কলেজে পড়বি, না? এই বয়সে প্রেমের উপন্যাস ভালোই লাগবো, তয় ট্র্যাশ পড়িস না। ক্ল্যাসিক পড়। আনা কারেনিনা, ইংরাজিটা বুঝতে কষ্ট হইলে, নে, অনুবাদ পড়’। 
বাড়িয়ে দেয়া ধোয়াটে কালো মলাটের বাঁধাই বই আমার হাতেই ধরা থাকে। এত বইয়ের ভীড়ে ক্ষুদে অক্ষরের একটি গ্রন্থে সেই মুহূর্তে মনসংযোগ সহজ ঠেকে না। সজল মামা হঠাৎ অস্থিরমতী, হালকা লাফে তাকের ওপরের বই ঘাটাঘাটি করে। সাত্তার মামার দিকে ফিরে – অসহিষ্ণু গলায় বলে- ‘বইনেগো খালি এক প্যাচাল, দ্যাশে একলা থাইকা কি করবি? আইসা পড়! আইসা পড় কইলেই আসা যায় ক’তো? 
সজল মামা উসখুস করে এটা ওটা ঘাটে। 
– সাত্তার তুইও চল, একসাথে যাই। 
– ব্যাটা, কইলেই যাওয়া যায়!’ মামা তখন মাথার নীচে দু হাতের পাতা রেখে আধখানা শরীর ঝুলিয়ে বিছানায় শোয়। 
টেবিলের ওপর একটা মোটা খাতার পাতায় পাতায় পেপার কাটিং, ফটো আঠা দিয়ে সাঁটা। সজল মামা উদ্ভাসিত হেসে আমার মামার দিকে ফেরে- ‘দেখ, কই হাত দিছে! 
মামা ভ্রু একটু কুচকে আবার সোজা হয়ে আসে। খাতাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে আমাকে পাতা উলটে দেখায়। খাতা ভর্তি সুদশর্ন পুরুষের ছবি, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি থেকে যত্নে কাটা, নিচে হাতে লেখা ক্যাপশন। 
কোন এর নায়কের প্রোফাইলের নিচে গাঢ় মার্কারে লেখা ‘ বিশ্বের সুন্দরতম পুরুষ’। 
দুই মামা মিলে ভাত ঘুমের বিকল্পে খাটের ওপর গড়াগড়ি দিয়ে হাসে। দমক থামলে সজল মামা আমাকে ডাকে, –‘ শোন বিয়া করলে এমুন সুন্দর ছেলে দেইখা করিস’। 
সিনেমা দেখলে তখনো আমার কেবল নায়িকাদের কথা মনে থাকে। 
একটু বাদে সজল মামা আবার তাদের কথপোকথনে ফেরত যায়-‘ আর দেশে থাকুমই বা ক্যামনে? দেখস না কি হাল!’ 
সাত্তার মামাও কেন – ‘আমারও তো’ বলে আমি বুঝতে পারি না। 
কিছুদিনের মধ্যে সজল মামার আগেই সাত্তার মামা মেলবোর্ণ পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর, আম্মা বলে, ওরা আমাদেরকে ভুলে গেছে। 
*** 
খাবার দিলে একজন একটু কম খায়, সেটা সত্যি কি মিথ্যা বুঝতে পারিনা। ওদেরকে মোটা তাজা করে দেখতে ইচ্ছে করে কতটুক বাড়ে। ওরা অনেকদিন বাঁচবে, আমি জানি। আব্বা মরে গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকবো- বাপ বেটির আবেগী কথাবার্তায় আম্মা একদিন ঝপ করে বলে ফেললো- ‘তোর কাছিম তো তুই মরলেও বাইচা থাকবো’। 
কোনদিন বাইরে না গিয়ে একটাও বই পত্র না পড়ে আম্মা এমন ভবিষ্যতবানী কোথায় শিখলো! 
এক একদিন নিঝুম রাতে কিট কিট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, আবছা আলোয় দেখি সত্য মিথ্যা মাথা বের করে দু’জনে পরস্পরের কাঁধের ওপরে দৃষ্টি মেলে শব্দটা করছে। ওদের ভাষায় কথা বলছে? লাইট জ্বালালে আবারো আগের নির্বিকার ভঙ্গিমায় ফেরত যায়। ওরা কি অন্ধকারের প্রাণী? 
কেন যেন মনে হয় ওরা আমাকে খুব ভালো করে চেনে। আমি ঘরে ঢুকলে গলা ভেতরে ঢুকিয়ে আত্মগোপন না করে জ্বলজ্বলে মার্বেলের মত চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকায়। 
দু’জোড়া চোখ, চারটা চোখের মণি। পাশাপাশি দুটো মাথা, আগ্রহী, উন্মুখ। 
আম্মা ভাইকে আখাউড়া স্কুলে ভর্তি করে দিতে গেছে, চাচার বাড়িতে থেকে পড়বে। আমার পরীক্ষার পর ঢাকায় থাকার পাট চুকিয়ে ফেলতে হবে। 
খালি বাসা পেয়ে চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসে কথা বলা আরম্ভ করলাম। জীবনের কঠিন জটিলতার শোলক ভাঙ্গানো প্রশ্ন না, সোজা সাপটা খেলা খেলা ধরনের কথাবার্তা। 
-‘আচ্ছা, বল আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস হবে, নাকি হবে না?’ 
ওদের ড্যাবড্যাবে মার্বেল নড়ে চড়ে না। 
-‘ ভাই কি আখাউড়া থাকতে পছন্দ করছে? সবাইকে ছেড়ে? হ্যা, নাকি না?’ 
স্থির, পলকহীন মার্বেল কি একটু বিষণ্ণ হয়ে ওঠে! 
সেদিন শাড়ি পরেছি, সেফটিপিন আটকে যথাসম্ভব ফর্মাল লুক এনেছি চেহারায়। হাতে ফাইলবন্দী সার্টিফিকেট, প্রশংসাপত্র। সত্যি আর মিথ্যা’র সামনে বসলাম। 
-‘বল চাকরী পাবো কি পাবো না…’ 
আমাকে অত্যাশ্চর্য করে দিয়ে একজন তার মাথা ঢুকিয়ে নিলো, আর অন্যজন স্থির চেয়ে থাকলো, তার দিব্যি স্মিত হাসি। 
আতান্তরে পড়ে গেলাম। কোনটা মিথ্যা, কোনটা সত্য? আমি তো আলাদা করে ওদেরকে নাম দিই নি। চিহ্নও রাখি নি কিছু? ঝটপট নেইল পালিশের ঢাকনা খুলে উঁচু থেকে না লুকোনো কচ্ছপের গায়ে একফোটা ঢেলে দিলাম। লাল একটা টিপ পরানো হয়ে গেল। আজকে থেকে এর নাম সত্যি। 
সত্যি সত্যি আমার চাকরী দরকার। এর আগে টিউশানি, স্কুলের পার্টটাইম এসব করেছি। চাকরী ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি একের পর এক। ভাইকে আখাউড়া রেখে এসে আম্মা এই বাসা ছেড়ে দিতে চায়। আমার মাষ্টার্স না হওয়া অব্ধি দূরে, সাভারের আরো ভেতরের দিকে কোথাও একরুমের টিনশেডে থাকার প্ল্যান করেছে। তার গয়না বিক্রির টাকায় নাকি ওইটুকু চালানো যাবে। 
চাকরী দেনেওয়ালাদের এই গল্প বলতে গিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখি। 
আব্বা তার সান্ধ্যকালীন বক্তৃতায় বলতো- ‘সুখী হইতে চাইলে নীচের দিকে তাকাবা। দেখবা তোমার জুতা নাই কিন্তু কত মানুষ আছে, যাদের পা’ ই নাই। জুতা না থাকার দুঃখ ভুলতে পারবা’। 
আব্বা হয়তো জানতোই না যে নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করা সোজা কাজ, কিন্তু সচেতনভাবে নেমে যেতে হলে, যে যায় সে-ই শুধু বোঝে। আমাদের আলোছায়া খেলা বাসা থেকে সাভারের তস্য মফস্বলী টিন শেডে উঠে যাওয়ার কাঠিন্য টের পাওয়ার আগে আব্বা চলে গেল। 
এত বছর পরে আব্বার মেয়ে হিসেবে আমার মাথা কি রকম ‘হাই আপ’ হয়েছে জানি না। যে চাকরীটা জুটিয়েছি তা নামেই অফিস ম্যানেজার আসলে রিসেপশনিষ্ট কাম সেক্রেটারী। তবে পুরাতন এন জি ও বলে বেতন, অন্যান্য সুবিধাদি ভালো, এম এ পাশ মেয়ের জন্য আব্বার হোপ নিশ্চয়ই আরো বেশী থাকতো, কে জানে হয়তো আধ শোয়া থেকে উঠে বসে আরো লম্বা বক্তব্য দিতো। তবু, চাকরী পেয়ে আপাতত আখাউড়া যাওয়া ঠেকানো গেছে। ভাইকে ফেরত আনবো। আম্মা এখন আগের থেকে বেশী বেশী বের হয়। ‘মুখ গুজে বসে থাকার দিন তো সব সময় থাকে না’- একদিন বলল। 
আরো একটা বড় ঘটনা- একদিন বাসায় ফিরে দেখি আমার ঘরের দরজা খোলা, আম্মা বসে বসে ঘর মুছছে। একটা আতংক আমাকে ঝাঁকি মেরে স্থির করে দেয়! নাহ, সত্যি মিথ্যা টেবিলের ওপরে আছে। বৈয়াম যথাস্থানে। আম্মা ঘেমে ওঠা কপাল তুলে হাসে –‘ তোর কাছিম দুইটারে একদিন ডইলা গোসল দে। 
আনা কারেনিনা বইটা আমার পড়া হয়নি। আব্বার আঙ্গুর বাগানে স্বপ্নের যে ছেলেটা থাকতে চেয়েছিল তাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু মুখটা পরিস্কার মনে করতে পারি। এমন কারুর দেখা পাবো কি? সত্যি মিথ্যাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn