মিজান-মোয়াজ্জেম
বিশ্বকাপের উন্মাদনা আছে, রাজনীতির মাঠে নীরবতা চলছে। কিন্তু আলোচনায় আছে পুলিশ বাহিনী। এই শৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন কর্মকর্তা গণমাধ্যমের শিরোনাম। একজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ওসি, আরেকজন ডিআইজি। ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়েছেন। তার হদিস পাচ্ছে না তারই বাহিনী। নারী নির্যাতন, নারীঘটিত কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের ‘অবৈধ সম্পদ’ অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন দুদকের পরিচালক এনামুল বাছির। এবার সেই বাছিরকেই ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে তার পক্ষে রিপোর্ট করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন মিজান। রিপোর্ট পক্ষে না আসায় ঘুষ দেওয়ার প্রমাণ গণমাধ্যমের সামনে হাজির করেছেন মিজান নিজেই।
দুর্নীতি দমন কমিশন বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। দেখা যাক পুরো অ্যাকশন নিতে কতদিন লাগে। কিন্তু মিজান ও মোয়াজ্জেম আমাদের ভিন্ন ভাবনায় ফেলে দেয়। আমরা তো মনে করি, এই দু’জনের কাণ্ডই পুলিশ বাহিনীর পুরোটা নয়। ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে একটি মোটামুটি পর্যায়ে রাখা বড় কৃতিত্বই বলতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনেও বাংলাদেশের পুলিশের সাম্প্রতিক সাফল্য প্রশংসিত। তাহলে তার দু’জন কর্মীর অপকর্মের দায়ভার বাহিনী নেবে কেন? মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, পুলিশ চাইলে কোনও আসামিই পালিয়ে থাকতে পারে না, ধরা তাকে দিতেই হবে। মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়া এখন সবার প্রত্যাশা। অন্যদিকে, মিজানের মতো কর্মকর্তা বাহিনীর বোঝা–এটা দ্রুত বুঝে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়াই যৌক্তিক। পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন চলছে। বাহিনী কর্তাদের মর্যাদাও বেড়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬-এ সরকার গঠন করে এই বাহিনীর সংস্কারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় অনেক সুপারিশও রাখা হয়েছিল। ইউএনডিপি’র পুলিশ সংস্কার প্রকল্প থেকেও অনেক সুপারিশ এসেছে।
ফেনীর সোনাগাজী থানাটি মডেল থানা। সেই মডেল থানার ওসির কাণ্ড যদি এমন হয়, হত্যাকে আত্মহত্যা বলার চেষ্টা করেন, ভিকটিমের বক্তব্য রেকর্ড করে সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল করেন। এসব নানা কারণে ‘থানা সংস্কৃতি’ এক আতঙ্ক মানুষের কাছে। আবার এ কথাও সত্য, এই থানাই মানুষের দোরগোড়ায় সাধারণকে রাষ্ট্রের পক্ষে ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রথম প্রতিষ্ঠান। তাহলে সমস্যা কোথায়? থানাকে, থানার কর্মীদের মানুষের হয়ে ওঠার বড় অন্তরায় রাজনৈতিকভাবে এর ব্যবহার এবং কিছু কিছু কর্মকর্তার অসদাচরণ। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সব আমলেই। সেটি কীভাবে কবে বন্ধ হবে, তা অনিশ্চিত। মানুষ পুলিশ থেকে সেবা আর নিরাপত্তা চায়। পুলিশের কাজ মানুষকে সেবা দেওয়া, তাদের সহযোগিতা করা, সাধারণ মানুষের নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। মানবাধিকারের যে সাধারণ ধারণা আছে, পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া তা কখনো অর্জিত হবে না।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমাজে পুলিশের ভূমিকা উন্নয়নমূলক, যদিও আমরা তা করতে পারিনি কোনোদিন। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে যেসব কমিশন হয়েছে, কমিটি হয়েছে, তারা বারবার একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চেয়েছে, এই বাহিনীর দক্ষতা, আধুনিকায়ন আর ভাবমূর্তির ওপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে। একথা আমাদের রাজনীতিকরাও স্বীকার করেন, গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশ কোনও ব্যক্তি-বিশেষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারে না। তার দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে, কিন্তু বাস্তবতা তেমনটা নয়।
জনবহুল দেশে, মানুষের নিরাপত্তা বিধানের কাজটি খুব সহজ নয়। বিশেষ করে সমাজে যখন অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে। কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। এই বাহিনীর অনেক সদস্যকেই কাজ করতে হয়, অন্য অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে। লোকবলের সংকটে তাদের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত খাটতে হয়, সে তুলনায় বেতনভাতা কম, নেই প্রয়োজনীয় উপকরণ, আধুনিক সব ব্যবস্থা। বর্তমান সরকারের গত দশ বছরে বাহিনীর প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধি ঘটেছে, বাহিনীর সদস্যদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিও হয়েছে। কিন্তু এরপরও একটি বড় সংকটের জায়গা রয়ে গেছে, আর তা হলো সাধারণভাবে মানুষের প্রতি পুলিশের আচরণ এবং তা বহুলাংশেই নিবর্তনমূলক।
আসলে এই বাহিনীকে দেখতে হবে একটি বিশেষ পেশাদার বাহিনী হিসেবে, যারা সদা সজাগ মানুষের নিরাপত্তা বিধানে, মানুষের সমস্যায় প্রথম নির্ভরতার জায়গা হিসেবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক করতে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া, এমন একটি জনবহুল দেশে পুলিশের পক্ষে আগামী দিনগুলোয় কাজ করা খুব সহজ হবে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ভাবতে হবে, তারা সমাজের সাধারণ মানুষেরই অংশ। প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে সাধারণকে শক্তি দেখানোতে কোনও বীরত্ব নেই। রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীক না হয়ে পুলিশ হোক সামাজিক সেবা দিতে সক্ষম সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক বাহিনী। লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা