১৮ কর্পোরেশনের ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশনগুলোর দায়দেনা ও লোকসানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনই বিষয়টিকে জোরালোভাবে দেখা হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, এসব সংস্থার লোকসান অব্যাহতভাবে বাড়ছে। তারা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করে না। এদের রাজস্ব দায়বদ্ধতা লাখ লাখ কোটি টাকা। এসব সংস্থাকে কীভাবে লাভজনক করা যায়, সে বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। তিনি বলেন, এ খাতে এত বেশি লোকসান না দিলে টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেত। কোন প্রতিষ্ঠানের কত লোকসান : অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮ কোম্পানির ঋণ ৩৯ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ১১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা, চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন ৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ৪ হাজার ৪৫৫ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলা ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন ৮৮৫ কোটি, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ৩ হাজার ৫৭৬ কোটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৭৩ কোটি, বিবিসি ৪৮৫ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ২৪৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।
তবে যেসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে ঋণখেলাপি এগুলো হল- বিজেএমসি ৩৭ কোটি টাকা, বিটিএমসি ২২ কোটি, বিএডিসি ২১ কোটি, টিসিবি ১১ কোটি, বিএসইসি এবং বিটিবি ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠান মিলে লোকসানের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। জানতে চাইলে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আ শ ম ইমদাদুদ দস্তগীর রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ ঋণ একদিনের নয়। অনেক বছরে এটি জমা হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ বছর ধরে চিনি শিল্পের খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অর্থ সংকটে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতনও দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার মতে, আর্থিক অবস্থা খারাপের কারণেই ঋণ বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। প্রস্তাবিত বাজেটে এ শিল্প সুরক্ষায় কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আশা করি, এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি শিল্প কর্পোরেশন লোকসান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভাব, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও অধিক উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, কোম্পানি লাভজনক হওয়ার জন্য উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার। ব্যবস্থাপনায় সংকট থাকলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পরও কোম্পানি লাভজনক হতে পারবে না।
তিনি বলেন, কোনো কোম্পানির হিসাবেও ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু কোম্পানি লিস্টেড হলে তার হিসাব স্বচ্ছ থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, এ ধরনের কর্পোরেশনের ব্যাপারে মানুষের আস্থা নেই। ফলে আস্থা পুনরুদ্ধার ছাড়া কোম্পানি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংস্থাটি মনে করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক করতে সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে হবে। অন্যদিকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন গঠনের পর এ পর্যন্ত ৭৭টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তবে এর মধ্যে ৩১টিই বন্ধ। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিল, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার, সাত রং টেক্সটাইল মিলস, মেটালেক্স কর্পোরেশন, ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ মুন্সীগঞ্জ, ফিরোজ আটা ও ডাল মিলস, বিজি বাংলা রাইস মিলস, কর্নফ্লাওয়ার মিলস, দোশা এক্সট্রাকশন, আশরাফিয়া অয়েল মিল, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ খুলনা, বাওয়া জুট মিল, ঈগল বক্স অ্যান্ড কার্টুন, স্কুইব বাংলাদেশ লিমিটেড, কোহিনুর ব্যাটারি মেনুফ্যাকচারিং, ফিশ এক্সপোর্ট বাজুয়া এবং ম্যানগ্রোভ টেনিন অন্যতম।
প্রাইভেটাইজেশন কমিশন তার মেয়াদের শেষদিকে এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বেশকিছু কারণে প্রতিষ্ঠান লোকসান হয়। এর মধ্যে রয়েছে- আগের দায়, ব্যাংক ঋণের ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ, শিল্প খাতে সরকারের প্রণোদনার অভাব, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, দক্ষ জনশক্তির অভাব, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় পার্থক্য, সিবিএর অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, কখনও কাঁচামালের স্বল্পতা এবং বিএমআরই করার মতো মূলধন না থাকা। এরপর প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ভেঙে অনেক আগেই বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।