পাকিস্তানের বাংলাদেশপ্রীতি ও ভিন্ন ভাবনা
জুয়েল রাজ — ইদানীং একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ার মতো। জানি না অনেকেই লক্ষ্য করেছেন কি না। বাংলাদেশের সব বিষয়েই পাকিস্তান খুব প্রশংসা করে। ব্যাপারটা আমার দৃষ্টিগোচর হয় মূলত কিছু ইউটিউবারদের মাধ্যমে। যারা ইউটিউবে বাংলাদেশের গান-মডেল এদের নিয়ে রিভিউ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি কিছু রোড শো গেইম করে থাকে, যেখানে কিছু সেট প্রশ্ন থাকে। যার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর থাকে বাংলাদেশের পক্ষে! আর খটকা সেখানেই। বাংলাদেশের মানুষ যতটুকু উর্দু জানে বা বুঝে, বাংলা ভাষা তার সিকি ভাগও পাকিস্তানের জনগণ বুঝে না। একটা দেশের ভাষা না জেনে না বুঝে সেই দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কতটুকু বুঝা যায় এইটা আমার কাছে বিশাল প্রশ্নবোধক? যেমন সেখানকার মেয়েদের প্রশ্ন করা হয় পাকিস্তানের বাইরে অপশন দিলে ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান কোন দেশের ছেলেদের বিয়ে করবে। ৯৯.৯৯ ভাগই উত্তর দেয় বাংলাদেশ! একই ব্যাপার ছেলেদের ক্ষেত্রেও তারা ও বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েদের কথা বলে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ও একই অবস্থা! পাকিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন টকশোর অংশবিশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অথবা ইউটিউবে দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও পাকিস্তানের পশ্চাতপদতা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হয়, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেটা তারা করতেই পারে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম যে রোড গেমগুলো খেলছে, সেখানে বাংলাদেশের ইউটিউবারদের নাম বলে, যাদের সাথে যৌথভাবে তারা এই শোগুলো করে থাকে। আর ভিন্ন ভাবনাটি সেখানেই।
বাংলাদেশের এই ইউটিউবাররা কারা যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে, তাদের উদ্দেশ্যই বা কি? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরবর্তী সময়ে একটা প্রজন্মকে মিথ্যাচার করে করে পাকিস্তান বন্ধু এবং ভারত চিরশত্রু হিসাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের ষড়যন্ত্রে দুই দেশ পৃথক হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকে গণ্ডগোলের বছর বলে, স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে সমর্থন দেয়া, মেরি মি আফ্রিদি প্ল্যাকার্ড হাতে তরুণীর উচ্ছ্বাসের মতো বিষয় বাংলাদেশে ঘটেছে। এর কারণও আছে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এই কাজটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। জাতিসত্তার চেয়ে ধর্মীয়স্বত্তাকে ব্যবহার করে, ইতিহাস বিকৃত করে একটি বিভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রটি। যার ফলশ্রুতিতে এখনো মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ সংখ্যা, বীরাঙ্গনা নিয়ে এই মাটিরই কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করে, অভিযুক্তদের ধর্মীয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চর্চা করে। আমাদের ও পরের প্রজন্ম, যাদের আমরা অনলাইন বা ডিজিটাল প্রজন্ম বলি, সেই চিত্রটা অনেকটাই ভিন্ন। কারণ তথ্যের সহজলভ্যতা, চাইলেই জানার সুযোগ থাকা, দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা, সঠিক ইতিহাসের চর্চা সব মিলিয়ে পাকিস্তানপ্রীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেকটাই। এখন খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন না বলে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমকে সমর্থনকারীর সংখ্যা হাতে গোনা।
তখন অনলাইনকেই বেছে নেয়া হয়েছে এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক নার্সিং হিসাবে। যাতে করে পাকিস্তান সম্পর্কে যে ঘৃণা পোষে মানুষ সেটি যেন কমে আসে। কারণ একটি দেশের সাধারণ মানুষ যখন অন্য দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, উন্নয়ন সব কিছুতেই প্রশংসা করে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রগলভ হয় বা এক ধরণের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে যায়। ঘৃণার বিষয়টা সেখানে থাকে না। পাকিস্তান ও পাকিস্তানিদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি বন্ধুর সম্পর্ক? পাকিস্তানি জনগণ বাংলাদেশকে কোন দৃষ্টিতে দেখে, বাংলাদেশ সম্পর্কে দেশটির জনগণ কতটুকু জানে, এই বিষয়টি নিয়ে আদৌ কি আমরা কখনো ভেবেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যতদূর জানি, কিংবা ইংল্যান্ডে থাকার সুবাদে বহু পাকিস্তানি নাগরিকের সাথে কথা হয়েছে, যারা ৭১ সালে বাংলাদেশের সাথে কি বর্বর আচরণ করেছে পাকিস্তান, তার কিছুই জানে না। তাদেরকে সেই ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি। বরং বাংলাদেশের আলাদা হওয়ার জন্য ভারত দায়ী সেই তথ্য তাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
লন্ডনে একটা পাকিস্তানি সেলুনে প্রায়ই চুল কাটতে যাই, যার সিংহভাগই বাংলাদেশি কাস্টমার। কিন্তু অবাক করার বিষয়, সবাই দেখি এসেই এদের সাথে উর্দুতে কথা বলে। আমার সাথে যতবার উর্দুতে কথা বলেছে আমি বলেছি উর্দু বুঝি না। তখন থেকে বাধ্য হয়েই ইংরেজিতে কথা বলে। এমন না যে, আমি উর্দু বুঝি না, বা খুব ভাল ইংরেজি পারি। শুধুমাত্র নিজের আত্মপরিচয়ের জানান দিতেই ইচ্ছাকৃতভাবে সেটা করি। অথচ যে পরিমাণ বাঙালি এইখানে বসবাস করেন নিয়ম মতো সেলুনের মালিক ও কর্মচারীদের বাংলা মুখস্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। যেখানে ইংরেজি ভাষাভাষীরা বাংলা শিখে গেছেন। একই অবস্থা কাস্টমার কেয়ারের ক্ষেত্রে। ব্রিটেনের বহু বড় বড় কোম্পানির কল সেন্টার এখন ইন্ডিয়ায়, যেখান থেকে ফোন করে তাদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে এবং অবাক করার বিষয় ফোন করে নাম ধাম জিজ্ঞাসা করে যখন বুঝে এশিয়ান, তখনই অনর্গল হিন্দিতে কথা বলা শুরু করে। সুললিত নারী কণ্ঠ যখন বলে, ‘আপ হিন্দিসে বাত কর ছাকতা হ্যে স্যার’। আমাদের স্যারেরা তখন সেই আলাপ চালিয়ে যান। বিশ্বায়নের এই যুগে ভাষা জানা অবশ্যই ভাল বিষয়। তবে আগে নিজের আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচয়টুকু ঠিক রেখে সেটা করা উচিত। পাকিস্তানের নাগরিক আপনার বন্ধু হতেই পারে, প্রশংসা করতেই পারে। কিন্তু তার আগে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধ, তাদের বর্বরতা নিয়ে অনুশোচনা সেই বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। যদি বন্ধু হতেই হয়, আগে ৭১ নিয়ে কথা বলুন। ক্ষমা চাইতে বলুন, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে আসুন।
পাকিস্তানের সাহায্য বা প্রশংসা ছাড়াই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব দরবারে। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই, ছিলও না। বরং পাকিস্তানের প্রয়োজন বাংলাদেশকে। তাদের বুদ্ধিজীবীগণ এখন চিৎকার করে সেই কথা বলেন। বাংলাদেশ তাদের রোল মডেল এখন। হুমায়ুন আজাদের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘পাকিস্তানিও যখন গোলাপ নিয়ে আসে, তখনো তাদের আমি অবিশ্বাস করি’। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেপ্রাণে এই উক্তিটি বিশ্বাস করি। তাই তাদের এই প্রেম বা প্রশংসার পিছনে ও তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ থেকে যারা প্রশ্নগুলো পাকিস্তানে পাঠায় বা যারা এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করছে তারা বুঝে শোনে ঠাণ্ডা মাথায় এই কাজগুলো করছে। পাকিস্তানপ্রেমী পূর্বসূরিদের সব রাস্তা যখন সংকুচিত হয়ে গেছে তখন এই রিভার্স খেলা খেলছে।জুয়েল রাজ, ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক