মানবতার দৃষ্টান্ত: মাটি খুঁড়ে লাশ বের করলেন তাঁরা
শাকির আহমদ, কুলাউড়া :: ‘এমন সময় কানে আসলো ট্রেনের ভিতরে থাকা কোন এক মেয়ের আর্তচিৎকার। বুকফাটা কান্নার আওয়াজে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে গিয়ে দেখলাম, একজন মহিলার (কুলাউড়ার আব্দুল বারীর স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন) শরীর ট্রেনের ভিতরে আর মাথাটা ট্রেনের জানালার বাইরে মাটির ভিতরে চাপা পড়ে আছে। মেয়েটা (রুকশানা পারভীন) বলতে লাগলো, “ভাই, আমি আমার মাকে না নিয়ে যাবো না, আমার মাকে বের করেন।” লোমহর্ষক এই কথাগুলো বলেন গত রবিবার (২৩ জুন) উপবন ট্রেন দূর্ঘটনাস্থল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের স্থানীয় সাবেক ফুটবলার ফখরুল আমিন চৌধুরী মিছলু। তিনি বলেন, ওই দুর্ঘটনার পর বরমচাল ইউনিয়নের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। প্রতিবেদককে দেয়া প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মী মিছলুর দেয়া বিস্তারিত বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো –
‘মাত্র খেয়ে টেবিল থেকে ওঠলাম। এমন সময় বিকট শব্দ। ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হয়েছে হয়তো। ওই সময় আমার চাচাতো ভাই দীপু (এজাজ কবির দীপু) ফোন দিয়ে বললো, ‘তোমাদের বাড়ির সামনে উপবন ট্রেন এক্সিডেন্ট করেছে, দ্রুত আসো।’ কোন কিছু না ভেবে আমি ও আমার আরও দুই ভাই হুছনুল আমিন চৌধুরী ফাজু, লুৎফুল আমিন চৌধুরী মারফু ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে উপলব্ধি করলাম- বিভৎস অবস্থা, চারিদিকে অন্ধকার, ভীতিকর পরিবেশ, সুনসান নীরবতা। দৌঁড়ে গিয়ে উল্টে যাওয়া ট্রেনের ওপর ওঠে যাই। ওপর থেকে ভিতরের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিলো সবাই লাশ হয়ে পড়ে আছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে দুই একজন বলতে শুরু করলেন, ‘ভাই, আমার হাত নাই, আমাকে বের করেন।’ আর একজন যাত্রী বললেন ভাই, ‘আমার পা তুলতে পারছি না, আমাকে বের করেন।’ বুঝলাম ওখানে লাশের চেয়ে আহতের সংখ্যা বেশী। উদ্ধার কাজ শুরু করলাম, আমাদের স্থানীয় জয়নুল ইসলামকে বলি, ‘একটা মইয়ের ব্যবস্থা করো। নতুবা মানুষদের নামাতে পারবো না। এভাবেই উদ্ধার করা হচ্ছিলো আহত ব্যক্তিদের। এমন সময় কানে আসলো কোন এক মেয়ের আর্তচিৎকার। বুকফাটা কান্নার আওয়াজে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, একজন মহিলার (পরে জানতে পারি তিনি কুলাউড়ার আব্দুল বারীর স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন) শরীর ট্রেনের ভিতরে আর মাথাটা ট্রেনের জানালার বাইরে মাটির ভিতরে চাপা পড়ে আছে। মেয়েটা (রুকশানা পারভীন) বলতে লাগলো, ‘ভাই, আমি আমার মাকে না নিয়ে যাবো না, আমার মাকে বের করেন।
ওই অবস্থাতেই ট্রেনের ভিতর থেকে আমি, জয়নুল ইসলাম, আমার ভাই ফাজু, মারফু, সালামত খান, হাসান উদ্দিন, নুর আলী, শফিক, জাকির আহমদ, সাহিদ মিয়া ট্রেনের দুই জানালার নিচের মাটি সরানো শুরু করলাম। এক পর্যায়ে মহিলার মাথাটি বের করতে সক্ষম হলাম। বিকৃত হয়ে যাওয়া মাথাটা দেখে উপস্থিত কেউ কেউ ভয় পাচ্ছিলেন। আমি মহিলার মেয়ের গায়ের ওড়না নিয়ে অর্ধেক করে লাশটি ঢেকে বেধে নিলাম। পরে মহিলার গায়ের শাড়ীর আঁচল দিয়েও মাথাটা বেধে দিলাম। এদিকে, একই বগির শেষ মাথায় আরও দুইজন মহিলার (সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স সানজিদা আক্তার (২০) ও ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০) পা ট্রেনের ভেতরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু শরীরের বেশীরভাগ অংশ ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমি ওপরে ওঠে উপস্থিত কয়েকজনকে চিৎকার করে বললাম, ট্রেনের ওল্টো পাশে গিয়ে মাটি সরিয়ে লাশ দুটো বের করতে খননে সাহায্য করেছেন স্বপন, শফিক, কালাম। এরপরের সর্বশেষ বগি থেকে একজন পুরুষের (হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার নুর হোসেনের ছেলে কাওছার হোসেন (২৬)) লাশ বগি থেকে বের করে কাধে করে মাটিতে নামান কয়ছর টেইলার। এসময় উদ্ধার কাজে নিরলস শ্রম দেন মো. আবু হানিফ, তাজুল ইসলাম সাইকুল, এম. জামাল হোসেন, চুনু প্রমুখ।
এছাড়াও উদ্ধার কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ভাটেরা ইউপি চেয়ারম্যান একেএম নজরুল ইসলাম, বরমচালের নজরুল ইসলাম লিজাত, আব্দুল বাছিত, আব্দুস সালাম, মাতাব, আব্দুল করিম, রিপন, কাওছার, ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম সহ শতাধিক স্থানীয় লোক। এসময় স্থানীয় অনেক মহিলাও মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। লাশ উদ্ধারের শেষ মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিসের টিম আমাদের কাছ থেকে লাশগুলো গ্রহণ করে। ‘শুধু আমরা না বরমচাল ইউনিয়নের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ মানুষের সাহোয্যে এগিয়ে আসেন। ভাটেরা-ব্রাহ্মণবাজারের অনেক মানুষও উদ্ধার কাজে সহযোগীতা করে। বরমচাল ইউনিয়নের সিএনজি মালিক-ড্রাইভার সমিতির উদ্যোগে মানবতার খাতিরে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলো। সিএনজি মালিক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান, সাহান উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জহুর ডেন ও সিএনজি ড্রাইভার সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক বাবেল মিয়া আহতদের উদ্ধারপূর্বক হাসপাতালে স্থানান্তরে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন।’ এবিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান বলেন, ‘বরমচালের সর্বস্থরের মানুষ অনেক অক্লান্ত পরীশ্রম করে মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে আহত মানুষকে উদ্ধার করে। লাশগুলোকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাকি উদ্ধার কাজে সহায়তা করে। এবিষয়ে সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক এম জামাল হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে বরমচালের সর্বস্থরের মানুষ এগিয়ে আসেন। মানুষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় হতাহতের সংখ্যা কমে যায়।’ সাবেক ফুটবলার ও সংগঠক তাজুল ইসলাম সাইকুল বলেন, ‘উদ্ধারকাজে যেভাবে বরমচালবাসী এগিয়ে এসে সহায়তা করেছে তা সত্যিই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো বরমচালবাসী।’ উল্লেখ্য, ওই দুর্ঘটনায় ৩জন মহিলা ও একজন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।