আওয়ামী লীগের ‘কাউয়া’ এবং ‘হাইব্রিড’ সমস্যা
স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে। তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন তাতে অনেকের কাছে মনে হয়েছে, ওবায়দুল কাদের ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিয়েছেন। তিনি ‘৪৭ বছর পরে এ ধরনের বিষয়টি দেখার তো কোনও যুক্তি নেই’ বলে মন্তব্য করায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রবল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং শহীদ পরিবারের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওবায়দুল কাদেরের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন ওবায়দুল কাদেরকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেয়। বিষয়টি সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য কিছুটা বিব্রতকর হওয়ার জন্যই সম্ভবত ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার বক্তব্য বলে যেটা প্রচার করা হচ্ছে, তেমন কথা তিনি বলতেই পারেন না। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়েছেন, হত্যা-লুটপাট-নারী নির্যাতনে অংশ নিয়েছেন, যারা চিহ্নিত অপরাধী তারা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন না—এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের কোনও সদস্য যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চায় তাহলে তাকে সদস্যপদ দেওয়া সমীচীন হবে না। সে রকম ঘটনা ঘটলে আওয়ামী লীগ নৈতিকভাবে পরাজিত হবে। নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক এবং চেতনার পাহারাদার বলে দাবি করার অধিকার থাকবে না। এখনই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নানা কৌতুককর মন্তব্য করে থাকেন। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের অনেক কাজকর্মই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই মনে করা হয়। তারপর ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পরিবারের সদস্যদের দলের সদস্যপদ দেওয়া হলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে এবং আওয়ামী লীগ নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়বে। সে রকম কিছু ঘটবে না বলে ওবায়দুল কাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে ইস্যুটি এখনই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হয় না।
এখন স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগে যোগ দিতে পারবে কিনা, সে প্রশ্নটি সামনে আসায় এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু অনেক আগে থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী বলে পরিচিত জামায়াত-শিবিরের অনেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ কেউ তাদের সাদরে বরণও করে নিয়েছেন। দেশের অনেক জায়গায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিষয়টি নিয়ে আরও খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন আছে। এটাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে একটি নিষ্পত্তিমূলক অবস্থান তৈরি হওয়া দরকার। বাংলাদেশে কারা রাজনীতি করার যোগ্য, নাগরিকমাত্রেরই রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত কিনা, এগুলো নিয়ে আমাদের কারোই হয়তো স্পষ্ট ধারণা নেই। যে ব্যক্তি আওয়ামী লীগ করতে পারবেন না, তিনি কেন অন্য দলের সদস্য হতে পারবেন?
দলে কাদের নেওয়া হবে বা কারা আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবে—এ বিষয়ে খুব কঠোর নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয় বলে মনে হয় না। আজ একদল, কাল আরেক দল—এটা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। দল বদলের রাজনীতি কার্যত নীতিহীনতার রাজনীতিকেই শক্তি জোগায়। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা ব্যক্তিগত নানা সমীকরণ মিলিয়ে অন্য দলের নেতাকর্মীদের নিজ দলে ভেড়াতে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করে থাকেন। এখানে নীতি-আদর্শের বিষয়টি সব সময় প্রাধান্য পায় না। আওয়ামী লীগের ভেতরেই এখন এই আলোচনা আছে, দলের মধ্যে ত্যাগী নেতাকর্মীদের চেয়ে বহিরাগতদের দাপট বেশি। ‘কাউয়া’ এবং ‘হাইব্রিড’ শব্দ দুটি বহুল ব্যবহৃত এবং আলেচিত।
আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ার জন্য বিশেষ কোনও যোগ্যতার প্রয়োজন আছে কিনা, তা আমরা জানি না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সদস্যপদের যোগ্যতা সংক্রান্ত বিশেষ কোনও ধারা নেই। তবে ৫-এর(১) ধারায় আছে, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিশ্বাস করে ১৮ বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী-পুরুষ নির্ধারিত ফরমে প্রদত্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে ২০ টাকা চাঁদা দিয়ে আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের কেউ যদি এমন ঘোষণায় স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগের সদস্য হতে চায়, তাহলে তাকে বাধা দেওয়া হবে কীভাবে? মতিউর রহমান নিজামী কিংবা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে যদি আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ‘বিশ্বাস’ স্থাপনের কথা বলে তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগ যদি আদর্শের প্রতি দৃঢ় থাকতে চায়, তাহলে এসব বিষয় স্পষ্ট করতে হবে।
আমাদের দেশে রাজনীতি ক্রমশ ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে না থাকলে কোনও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই কিছু মানুষ সবসময় সরকারি দল করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারা দল বদল করেন। মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের প্রভাব বলয় তৈরির জন্য এই নীতি-নৈতিকতাহীন দল বদলকে উৎসাহিতও করে থাকেন। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী, টাউট-বাটপাড়দের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যেখানেই যে অপরাধ সংঘটিত হবে এবং অপরাধী ধরা পড়বে, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার খবর প্রচার হলে সেটা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করে। বরগুনা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনিরা ক্ষমতাসীনদের কোনও না কোনও পক্ষের সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদও বরগুনার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে নয়ন বন্ডরা তৈরি হতে পারে না।’ আওয়ামী লীগ এখন আসলে কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং তার পরিণতি দলটিকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা খুঁটিয়ে দেখার সময় হয়েছে।
আওয়ামী লীগে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে ১ জুলাই থেকে। কাদের সদস্য করা হচ্ছে? কারা নতুন করে আওয়ামী লীগের সদস্য হচ্ছেন? বলা হয়ে থাকে, সমাজে ভালো মানুষ বলে পরিচিত যারা, তারা এখন আর রাজনীতিতে আগ্রহী নন। সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানীরাই এখন রাজনৈতিক দলে ঢুকতে চায়। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে তারা আখের গোছানোর ধান্দা করে। সদস্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ এই বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখছে কি? সদস্য বাড়ানোর নামে ‘আবর্জনা’ বাড়িয়ে লাভ নেই। আওয়ামী লীগের বরং এখন উচিত দলের মধ্যে একটি শুদ্ধি অভিযান চালানো। যাদের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সব ভালো অর্জন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তাদের দল থেকে বের করার ব্যবস্থা নেওয়া। আওয়ামী লীগকে এখন ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা উচিত। লেখক: কলামিস্ট