গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মত!
জুয়েল রাজ -একের পর এক ভয়ংকর সব সংবাদ বাংলাদেশে। সাধারণ একজন মানুষ হিসাবে অস্থির লাগে, বিক্ষিপ্ত মনে হয়। কিছু লিখতেও ভয় হয়। গত ছয় মাসে প্রায় ছয় শতের মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেশে। আরো কয়েকশত হয়তো বা হিসাবের খাতায় আসে নাই, সামাজও লোকলজ্জার ভয়ে। কতোটা অমানবিক হলে, একটি দেশের সাধারণ মানুষ তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে মেরে ফেলাকে সমর্থন করে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি কতোটা অনাস্থা থাকলে সেটি হতে পারে। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ কেউই নিরাপত্তা দিতে পারছে না ধর্ষণ থেকে। ২ মাসের শিশু থেকে শতবর্ষী নারী কেউই রক্ষা পাচ্ছেন না। ধর্ষণ যেন বাংলাদেশে একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে! ধর্ষক এখন আবার সেই ধর্ষণের ভিডিও বা ছবি সংরক্ষণ করে, কেউ কেউ আবার সেই ভিডিও ভাইরাল করে। শিক্ষকের কাছে ছাত্রী, শশুরের কাছে পুত্রবধু এমনকি খোদ পিতার কাছে কন্যা সন্তান পর্যন্ত নিরাপদ না। বাকী সম্পর্কগুলো না হয় বাদই দিলাম।
ভয়ংকর যে রূপ দেখলাম ধর্ষণ শেষে অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল খায়ের বেলালীর।(পত্রিকার ভাষ্যমতে) বেলালী কলিংবেল চাপেন আর ওনার পছন্দমতো একজন কোমলমতি ছাত্রীর ডাক পড়ে তার শরীর টিপে দেয়ার জন্য। এক পর্যায়ে তিনি সেই অবুঝ শিশুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষে আবার কোরআন শরিফ হাতে দিয়ে শপথ করান কাউকে কিছু না বলার জন্য। বললে আল্লাহ তাকে দোযখের আগুনে পোড়াবেন বলেও হুমকি দেন। ভয়ে কোমলমতি ছাত্রীরা কাউকে কিছু বলে না। ঢাকার যে শিশুটিকে ধর্ষণ শেষে নিজের বিল্ডিংয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করলো। এদের একেকটা ঘটনা অন্যটার থেকে ভয়ংকর। প্রধানমন্ত্রী পিতার সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানদের সম অধিকারের কথা বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন সম্পত্তি আইনে যেন ছেলে মেয়ে না লিখে সন্তান লেখা হয়। সম্পত্তি দিয়ে কি হবে, কন্যা সন্তান যদি না থাকে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যারা পিতা মাতা হবেন তারা হয়তো আর কন্যা জন্ম দিতে চাইবেন না। অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে ভ্রুণেই সেই কন্যা শিশুটিকে হত্যা করে ফেলবেন। অথবা আইয়ামে জাহেলিয়ার মতো কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও দেখলাম ধর্ষকের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপিও দেবেন বলে জানিয়েছেন। অনকেই ধর্ষকদের ক্রসফায়ারের দাবিও তুলছেন। কেউ কেউ বলছনে কোন আইনজীবী যেন ধর্ষকের পাশে না দাঁড়ান। কিন্তু এইভাবে কি আদৌ ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব? উৎপাদন বন্ধ না করে, বাজার খালি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি শুধু ফাঁসি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করতে পারবেন। সেই একই আগাছা আবার জন্ম নিবে। রাষ্ট্র, সরকার সমাজ সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। আইনজীবি অবশ্যই দাঁড়াবে, যদি কোন আইনজীবি না দাঁড়ায় সরকারের উচিত ধর্ষকের পক্ষে আইনিজীবি নিয়োগ দেয়া। ধর্ষণের ঘটনায় যারা এই পর্যন্ত আটক হতে দেখেছি, প্রায় সবাই ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে গিয়ে ধর্ষণ বা খুনের কথা স্বীকার করে। তাই প্রচলিত আইনে দ্রুত বিচার করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয় বিচারের দীর্ঘসুত্রতা ধর্ষণ নিয়ে চারদিকে এতো হৈচৈ হচ্ছে এর ভিতরেই এক কলেজছাত্রী ধর্ষণের মামলায় জাজিরা পৌরসভার মেয়র ইউনুছ ব্যাপারীর ছেলে মাসুদ ব্যাপারী (৩১) গ্রেপ্তারের আট দিনের মাথায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
ধর্ষক জেল থেকে বের হয়ে যা করে ধর্ষিতা ও ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি হয়রানী শুরু করে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষক প্রভাবশালী হয়ে থাকে। সেই ক্ষেত্রে হয় ধর্ষিতা বা তার পরিবার হয় আপোষ করে না হয় এলাকা ছেড়ে পালায়। সেই মামলার বিচার আর আলোর মুখ দেখে না। ধর্ষক যতো বড় ক্ষমতাশালী হউক বিচারের আগে কোনভাবেই যেনো জামিন না পায় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অনেকে আবার এক কাঠি সরেস, ধর্ষণ কমাতে দেশে যৌন পল্লী বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন। যৌন পল্লীতে যে নারীরা আসে তারা কারা? সেই নারী তো কারো না কারো কন্যা, জায়া কিংবা জননী। যৌনকর্মীরা কি খুব শখ করে এই পেশায় আসে! মানে ঘুরে ফিরে নারী মানেই ভোগ্য, নারী মানেই যৌন লালসা চরিতার্থ করার মাধ্যম। সেই ধারণা থেকে বের হতে পারছেন না।
ধর্ম বলেন আর আধুনিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থা বলেন সব জায়গায় নারী পণ্য হিসাবে গণ্য। ২০১৭ সালে মধুমিতা পান্ডে নামক এক ব্রিটিশ ভারতীয়, ভারতের ১০০শ ধর্ষকের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য, ভারতে জেলে আটক ধর্ষকদের, সেখানে বেশীরভাগ ধর্ষকের মাঝেই কোন অনুশোচনা দেখেন নি। এক ধর্ষক শুধু বলেছে- সে একটা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল, বাচ্চাটার সতীত্ব নষ্ট হয়ে গেছে, তারে আর কেউ গ্রহন করবে না। তাই সে জেল থেকে বের হয়ে এসে মেয়েটাকে বিয়ে করতে প্রস্তত। এইটা শুধু ভারতের চিত্র নয়, আমার মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্র এইটা। মায়ের পেট থেকে এসেই একটা ছেলে ধর্ষক হয় না নিশ্চয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এই ছেলেটিকে পুরুষ বানায়, ধর্ষক বানায়। সন্তানের কাঁধে চড়ে বেহেসতে পাওয়ার লোভ পরিত্যাগ করুন। সন্তানকে সুন্দর স্বপ্ন দেখা একটি ছেলেবেলা দিন। তাদের চিন্তার আকাশকে উন্মুক্ত করে দিন। নিজের কর্মফলে বেহেস্তের স্বপ্ন দেখুন। আমরা তসলিমা নাসরীনকে নষ্ট বলে, দেশ থেকে বের করে দেই। যতোটা না ধর্মীয় কারণে তার চেয়ে বেশী পৌরুষ নামক দানবে আঘাতের কারণে বেশী। অভিজিত রায়, অনন্ত বিজয়দের গলা কেটে দেই। যারা ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা ছিল। দিনদিন দেশে টুপি বাড়ছে, রথের রশি দীর্ঘ হচ্ছে, হজ্বের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। পুজায় রাস্তাঘাট জ্যামে আটকে থাকছে- এই দেশে তো ধর্ষণ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকার কথা না। সব ধর্মেই জেনা বা অবাধ যৌনাচার ব্যাভিচার আখ্যা দিয়ে তার জন্য রয়েছে চরম শাস্তির বিধান। মাদ্রাসায় শিশুদের ধর্ষণের হিসাব হয়তো কারো কাছেই নেই। কোনদিন সেই হিসাব পাওয়াও যাবে না।
ব্রিটেনে vulnerable ( অসহায়) বা যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তাঁদের সেবাদানকারী ব্যাক্তির ক্রিমিনাল রেকর্ড এর প্রতিবেদন জমা সাপেক্ষে চাকরীতে নিয়োগ দেয়া হয়। যাকে বলা হয়, DBS (Disclosure and Barring Service), আগে বলা হতো CRB (Criminal record burea)। নির্দিষ্ট ফিস দিয়ে অনলাইনে সেই আবেদন করতে হয়। বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাঁদের এই রিপোর্ট অবশ্যই জমা দিতে হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বা পুলিশ ভেরিফিকেশন। সেটিকে যুগোপযোগী করে সাজানো যেতে পারে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সহ যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়ার আগে শিক্ষক শিক্ষিকাদের এই ক্লিয়ারেন্স দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে, যেখানে পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন কোন ধরণের তদন্ত ছাড়াই দিয়ে দেয় পুলিশ, ফোন করে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে যাচাই বাছাই ছাড়াই সেই প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সেখানে এই পদ্ধতি কতোটুকো কার্যকর হবে এই বিষয়টিও ভাবনার। আমার আত্মীয় এক মেয়ে প্রথম বিভাগ পেয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে। কিন্তু মাস্টার্স ভর্তি হয়নি। মেয়েটির ভাই যে নিজেও মাস্টার্স পড়ছে, সে ঝুঁকি নিতে চায়নি। কারন উপজেলা শহর থেকে সিলেটে এসে ক্লাস করা, পরীক্ষা দেয়া, কখন কি হয়! আমি কোন কথা বলিনি। মনে মনে অসহায়ের মতো কাজী নজরুলের কবিতার চরণ আওড়াচ্ছি-
“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে আমরা তখনও বসে,
বিবি তালাকের ফতুয়া খুঁজেছি ফেকাহ ও হাদিস চষে!
হানাফী ওহাবী লা-মজহাবীর তখনো মেটেনি গোল
এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল তল্পী তোল!
ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মত!