খুজিস্তা নূর ই নাহারিন মুন্নী।।

কাককে আমার সবসময় বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী বলেই মনে হয়। যখন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তারা সমস্বরে দল বেঁধে চিৎকার করে জানান দিয়ে সতর্ক করে। একজন খাওয়া পেলে অন্যদেরও আমন্ত্রণ জানায়, ভাগ দেয়। গাছের মগডালে প্রেম এবং ভালবাসার তোড়ে, ওরাও ঘর বাঁধে। গভীর মমতায় দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে ডিমে তা দিয়ে সন্তান উৎপাদন করে, যত্ন সহকারে মায়ের স্নেহে লালন-পালন করে।

কতদিন কাজের অবসরে একাকীত্বে খাবার ছিটিয়ে কাকদের কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার আনন্দ নিয়েছি। মুখ থেকে বের করে বাচ্চাদের মুখে খাওয়া পুরে দেওয়ার মত অপূর্ব মাতৃস্নেহ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। কাকের বাচ্চাদের ঠোঁট লাল রঙ ছড়িয়ে কালো হওয়া মাত্রই মানুষের বাচ্চাদের মতোই দূরে সরে যায় একদিন। মা ছোট্ট নীড়ে অপেক্ষা করে কিন্তু বাচ্চাদের দেখা মেলে না আর।

সাম্প্রতিক সময়ে কাকদের নিয়ে চারদিকে যে শোরগোল, আলোচনা তা জানতে পারলে কাকেরা নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করবে। কারণ ওরা মানুষরূপী কাউয়াদের মতো অতোটা লোভী, উচ্চাভিলাসী, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী কিংবা ভিখারী নয়।

কাকেরা জীবন ধারণের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই আহরণ করে। কাউয়ারুপী মানুষেরা ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে নিজেদের রং বদলায়। অ্যামিবার মতোন কূটকৌশলে  আকৃতি পরিবর্তন করে আখের গোছায়।

কাউয়ারা বাঁচার জন্য যতটুকু দরকার ততটার জন্য, যেখানে যা পায় তাই খায়। বর্ণচোরা, স্বার্থান্ধ, লোভী হয় কাউয়ারুপী মানুষেরাই। লোভে সম্পদের পাহাড় গড়তে যেখানে পায়, প্রয়োজনের বেশি লুটে নেয়। যখন যে ক্ষমতায় যায় তার কাছেই ভীড় করে, পা চাটে, কা-কা করে। আবার যখন ক্ষমতা নাই তখন তারাও নাই।

সর্বত্র এইসব কাউয়াদের ভীড়ে আসল মানুষেরা আড়াল হয়ে যায়। এইসব আদর্শহীন স্বার্থপর মানুষেরা লোভাতুর চোখ নিয়ে, লকলকে জিভ নিয়ে যখন যারা ক্ষমতায় তাদের পা চাটে। তারা বলে, তারা বদলায় না। কেবল সরকার বদলায়। তারা একদলই করে। সেটি সরকারী দল। তাদেরকেই ‘কাউয়া’ নামে অভিহিত করা হয়।

সম্প্রতি প্রকাশিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘রোজনামচা’ পড়ে দেখা গেছে তিনি বলছেন, আওয়ামী লীগে কাউয়া ঢুকেছে। কাউয়া নিয়ে সর্বত্র যখন আলোচনা তখন সিলেটে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন,  ‘আওয়ামী লীগে কাউয়া ভীড় করেছে’। মানুষের মনের কথা বলায় কাউয়া নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনার ঝড়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টক-শো আর প্রিন্ট মিডিয়ার কলামজুড়ে কাউয়াদের নিয়ে মুক্ত মতামত উঠে এসেছে। ওবায়দুল কাদের মানুষের মনের ভাষা পড়তে পড়তে তা অনায়াসে বলতে পারেন। পর্দার অন্তরালে ঘটে যাওয়া নির্মোহ সত্য এবং যা সবাই দেখেন কিন্তু ধরতে পারেন না, বলতে পারেন না, ওবায়দুল কাদের তা অকপটে উচ্চারণ করতে পারেন। এজন্য তার একটা আলাদা জনপ্রিয়তা বা ইমেজ রয়েছে। সরকার, দল ও জনগণকে তিনি সত্য ভাষণে বার্তা দিতে  ভুল করেন না। সরকার ও দলের কর্মকাণ্ডে পরিশ্রমী, উদ্যমী, কর্মঠ এই নেতা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ঘটে যাওয়া উত্থান-পতনের অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের জায়গায় আসেননি। আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার দীর্ঘ পোড় খাওয়া রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন  ও আওয়ামী লীগের দুর্দিন-সুদিন  ভেতর থেকে নির্মোহ চিত্তে অবলোকন করেছেন। তাই ২০০৮ সালের নাটোর আওয়ামী লীগ নেতা সাজিদুর রহমান খান ‘দলে হাইব্রিড ঢুকেছে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন সেটিকে ওবায়দুল কাদের চুম্বকের মতো টেনে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন।

পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে ছাত্র জীবন থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে যা দেখেছি তা কম নয়। অভিজ্ঞতা আমাদেরও অনেক হয়েছে। দলের মহা দুর্দিনে, প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের আদর্শিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ছাড়া কাউকে কাছে পাওয়া যায় না। বসন্তের কোকিলেরা নতুন খাবারের সন্ধানে উড়ে যায় তখনকার ক্ষমতাবানদের চারপাশে। হাইব্রিডরা স্রোতের মতো ক্ষমতার পিছনে ঘুরে ক্ষমতাবানদের পা চাটা কুকুরের মতো। কাউয়ারা সমস্বরে কা-কা করে। যেখানে ক্ষমতা সেখানে রাজভিখারি, ক্ষমতা ভিখারী, হাইব্রিড, বসন্তের কোকিল, চামচা বা চাটুকর, দাস বা মোসাহেব যাই বলুন তারা একই সম্প্রদায়ের। ওদের কোনো আদর্শ নেই ওদের কোনো লাজ-লজ্জা নেই, ওদের কোনো হায়া-শরম নেই। ওরা শুধু বুঝে নিজের স্বার্থ আদায় করা। যখন যারা ক্ষমতায় তাদের মুখোশ পড়ে তাদের সাথে ভীড়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই লুটেরা চক্রকে বলে গেছেন ‘চাটার দল’। সম্প্রতি এরাই কাউয়া হিসেবে সারাদেশে নিন্দিত হচ্ছে।

সেনাশাসক জিয়া ও এরশাদের জমানায় কাউয়ারা ভীড় করেছিলো সবখানে। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনলে কাউয়ার দল কা-কা করে সেখানেও ভীড় করেছিলো। বিএনপি-জামায়াত শাসনামল থেকে ওয়ান ইলেভেন পর্যন্ত এই কাউয়াদের, এই পা চাটা কুকুরদের, এই মতলববাজদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন তারা যারা ক্ষমতায় তাদের সাথে মিশে ছিলো।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে গণরায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে এলে রাতারাতি কাউয়ারা এসে ভিড় করতে থাকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ, আমলা পাড়া ,ব্যাঙ্ক পাড়া এমনকি পুঁজি বাজারেও এইসব কাউয়াদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিএনপি-জামাত জামানায় ‘মিস্টার টেন পার্সেন্ট’ এর সঙ্গে ব্যবসা করে টাকার কুমির হওয়া, ওয়ান ইলেভেনে বিশেষ জায়গায় মোটা অঙ্কের নজরানা দিয়ে রেহাই পাওয়া কাউয়াদের কেউ কেউ পুঁজি বাজারেও নতুন সুরে গলা উচু করে কথা বলতে চায়। সরকার বদলের সঙ্গে চেহারা অবস্থান বদলে পারদর্শী সব সরকারের দাস এইসব কাউয়া তাড়াতে না পারলে তারা নিকুঞ্জের ভবনের মতোই সমগ্র পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার অনিশ্চয়তায় টেনে নিয়ে যাবে। সমাজটা আসলেই কাউয়ায় ছেয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কমিটেড লোকছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু বর্তমান তখনকার দুর্জনেরা বোল এবং ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগার থেকে অতীব আওয়ামী লীগার হয়ে উঠেছে। নব্য আওয়ামী লীগারদের চাপে পুরাতনরা নিয়মিত পিষ্ট হচ্ছে। যেখানেই স্বার্থ সেখানেই ময়ূরের পুচ্ছধারী কাউয়ারা হাজির। সরকারী দলের মধ্য থেকে কাউয়া তাড়ানো যে আওয়াজ উঠেছে সেটিকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে । স্বাধীনতা উত্তর জামানায় বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে মরিয়া তখনো কাউয়ার তৎপর ছিল। তিনি ব্যথিত চিত্তে বারবার বলেছেন- ‘আমার কৃষক, আমার শ্রমিক, আমার জনগণ, ঘুষ-দুর্নীতি-চোরাকারবারির সাথে জড়িত নয়। ঘুষ-দুর্নীতি, চোরাকারবারীর সঙ্গে জড়িত স্যুট টাই পড়া, ইংরেজি জানা কিছু শিক্ষিতরা।’ এখনই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সবাইকে সাবধান হতে হবে।

কাউয়ারা যখন যে ক্ষমতায় সেখানে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। ক্ষমতা হারিয়ে বিপদে পড়লে সেই দল বা নেতা-নেত্রীদের আশেপাশেও থাকে না। পা চাটা কুকুরেরা লেজ গুটিয়ে পালায়। কাউয়ারা কা-কা করে নতুন খাবারের লোভে ঠোঁট বাড়িয়ে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে যায়। অথচ সেই নীতিহীন কাউয়ারাই  আখের গোছানোর কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে সরকারী দলের জনপ্রিয়তার বারোটা বাজায়। তাই আজ সবার সময় হয়েছে বলার, ‘সাবধান, কাউয়া তাড়াবার সময় এখন’।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn