বার্তা ডেস্ক :: ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সব আসামির এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দিতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ আদেশ দেন। গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। চারদিন যন্ত্রণা সহ্য করার পর ১০ এপ্রিল নুসরাত মারা যান। এই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের পর ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই)। ঘটনার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা ছিল তা উল্লেখ করা হয় এতে।

এস এম সিরাজ উদ দৌলা

সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে অভিযোগ নুসরাতকে যৌন হয়রানি ও হত্যার নির্দেশ দেওয়ার। তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি। তবে তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে। হুমকিতে কাজ না হওয়ায় তিনি নুসরাতকে ভয়-ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা দেন। কীভাবে হত্যা করতে হবে তারও নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও দেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

নুর উদ্দিন

সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের আগে যে কক্ষে বোরকা রাখা ছিল তা পরিদর্শন করে। ছাদে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর ভবনের নিচের পরিস্থিতি খুব চাতুর্যের সঙ্গে সামলে নেয় সে। পুরো ঘটনাকে নাটক বানাতে সহায়তা করে।

শাহাদাত হোসেন শামীম

হত্যাকাণ্ডের ছক সাজানোর বৈঠকে ছিল একই মাদ্রাসার ছাত্র শামীম। কীভাবে কে কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা করে সে। ঘটনার আগে সে কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়, যে টাকা দিয়ে বোরকা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরকা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাস উদ্ধার করা হয়।

মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর

ঘটনার পর ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেয় মাকসুদ আলম। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেয় সে। হত্যাকাণ্ডের জন্য সে ১০ হাজার টাকা দেয়। ঘটনার সবকিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে অবস্থান করছিলেন জেলা শহর ফেনীতে।

সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের

ঘটনাস্থলে নুসরাতকে শোয়ানোর পর তার পা বাঁধে জোবায়ের। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় সে।

জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন

নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালে সাখাওয়াত। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর সে ঠান্ডামাথায় পরীক্ষার হলে যায়। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যায় ছাদে, এমন ভাব করে যেন কিছুই জানে না সে।

হাফেজ আবদুল কাদের

ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহারায় ছিল কাদের। সে নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা, নোমান তা দেখতে চাইলে তাকে বাধা দেয় কাদের। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয়ে জানতে চাইলে সে জানায়, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে সে জানায়, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

আবছার উদ্দিন

ঘটনার সময় গেট পাহারার দায়িত্বে ছিল আবছার। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও সে নুসরাতের মাকে ফোন করে যৌন হয়রানির অভিযোগে হওয়া মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।

কামরুন নাহার মনি

মনিকে দুই হাজার টাকা দিয়ে বোরকা ম্যানেজ করতে বলে শামীম। ওই টাকায় মনি দুটি বোরকা ও হাতমোজা কেনে। পরে ওই দুই বোরকা ও তার নিজের একটি বোরকাসহ মোট তিনটি বোরকা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসে। ছাদে নেয়ার পর নুসরাতকে শোয়ানোর কাজে সহায়তা করে এবং নুসরাতের বুকের ওপর হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখে সে। ঘটনার পর ঠাণ্ডামাথায় এসে সেও পরীক্ষায় অংশ নেয়।

উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা ওরফে শম্পা

নুসরাতকে ছাদে নেয়ার পর মামলা তুলে নিতে নুসরাতের মাকে প্রথমে ফোনে চাপ দেয় সে। রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ের ওড়না খোলে সে। এরপর ওই ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে, যা দিয়ে নুসরাতের হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছনে নিয়ে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়; যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।

আবদুর রহিম শরীফ

বাইরের গেটে পাহারায় ছিল শরীফ। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় সে। ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল তারাও গেটে পাহারায় ছিল। সবকিছু স্বাভাবিক বোঝাতে যা যা করণীয় তা করছিল তারা।

মোহাম্মদ শামীম

প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিল শামীম, যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে।

রুহুল আমিন

ঘটনার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ করার আশ্বাস দেয় রুহুল আমিন। নুসরাত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে যা যা করার সব করে সে। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দুই দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত করা হয়। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন নুসরাত হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এরমধ্যে নুসরাতকে যৌন হয়রানির কথা স্বীকার করেছে সিরাজ উদ দৌলা। আদালতের পিপি হাফেজ আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে ১৬ জনের একে অপরের সঙ্গে প্রত্যেকে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। তাদের এই অপকর্মের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৬ জনের প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।সৌজন্যে : যুগান্তর

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn