‘সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’-নবনীতা চৌধুরী
নবনীতা চৌধুরী:: সৌদি আরব থেকে ধর্ষণ সহ নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এবছর ৯০০ জনের মতো বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। বেড়েছে নারী শ্রমিকদের মৃতদেহ দেশে আসার সংখ্যাও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয় স্ট্রোক বা আত্মহত্যা তাদের মৃত্যুর কারণ। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ দেশে আসার পর ময়নাতদন্তের যেমন কোন সরকারি উদ্যোগ থাকেনা, তেমনি পরিবারগুলোর মনে মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, থাকেনা প্রয়োজনীয় অর্থ। অনেক সময় মৃত্যুর পর লাশ দেশে আসতেই লেগে যায় ৫-৬ মাস। আর ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক নয় জানলেই বা কী প্রতিকার! তাই,আমাদের ২৫-৪০ এর নারী পুরুষ অভিবাসীরা হরহামেশাই মরে ফেরেন আর কেউ জানতে চাননা ঠিক কেন এই বয়সী নারী পুরুষের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে কাজে গেলেই স্ট্রোকের হিড়িক পড়ে যায়২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছর বাংলাদেশের প্রধান শ্রম বাজার সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর শর্তে পুরুষ শ্রমিকের বাজার খোলে। সৌদি আরবে গৃহকর্মীর বিপুল চাহিদা। কিন্তু ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার মত যে দেশগুলো অদক্ষ ক্যাটাগরির এই গৃহ শ্রমিকদের সৌদিতে পাঠাতো, সে দেশগুলো সেসময় থেকেই সৌদি সমাজে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে গেলে অল্প বেতনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি এবং শারিরীক- মানসিক নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগ সম্পর্কে কথা তুলে সৌদি সরকারকে নানা শর্ত দিতে শুরু করে। গার্মেন্টসে যেমন, জনশক্তি রপ্তানি খাতেও আমাদের মূল বিক্রয়যোগ্যতা বা ইউনিক সেলিং পয়েন্ট (ইউএসপি) কিন্তু সেই এক, সবচেয়ে কম দাম, এবং অনেক অনেক যোগান দেওয়ার ক্ষমতা। কাজেই, সৌদি সরকারের সেই প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের গ্রহণ না করার কোন কারণ ছিলনা। ২০১৫ সালের সেই চুক্তির পর চার বছরে প্রায় তিন লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে গেছে। একদম প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দালাল দিয়ে ধরে এনে, দুয়েকদিনের টুকটাক প্রশিক্ষণ দিয়ে অপরিচিত ভাষা, সংস্কৃতি,খাবারের দেশের বাড়িগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা পাঠিয়ে দিচ্ছেন নারীদের। এই নারীরা কোনদিন মরুর দেশের ছবিও দেখেন নাই, জানেননা ঐ দেশে চাইলেই নারী ঘর থেকে বের হতে পারেননা, জানেননা বাংলা ভাষায় সুখ দুঃখের কথা বলার আরেকটা মানুষের দেখা যে মিলবেনা ঐ মুলুকের বাড়িতে, খেতে হবে রুটি, মিলবেনা ভাত। বাঙ্গালীর জান শক্ত! মরুর দেশের তীব্র গরমে শরীর পুড়িয়ে কাজ করে বাঙ্গালী পুরুষ শ্রমিকরা যেমন চারজন থাকার ঘরে ৪০ জন চিতকাত হয়ে শুয়ে কোনরকমে টিঁকে যান, সৌদি যাওয়া তিন লাখ নারীর মধ্যে তেমনি সরকারি হিসেবে ফিরেছেন আট হাজারের মতো।
ফেরত আসার সংখ্যাটা বেশি নয় বলে সরকারি কর্মকর্তারা যুক্তি দেওয়ায় অনেকে খুব খেপে গিয়ে বাংলাদেশের নারীর ‘সম্ভ্রমের’ বিনিময়ে এই রেমিট্যান্স চাইনা, নারীর সৌদি যাত্রা বন্ধ হোক -এসব বলতে শুরু করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে আমাদেরকে ‘সম্ভ্রমে’র বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মনে হয়। কিন্তু, আমি ভাবি, আমরা কী সত্যি বুঝতে পারিনা, যে দেশের ভেতর আমাদের এই লাখ লাখ নারী পুরুষের জন্যে সম্মানের সাথে কাজ করে বেঁচে থাকার সুযোগ আসলেই এখনো সৃষ্টি করা যায়নি? এও নিশ্চয়ই আমরা জানি যে, বাংলাদেশ থেকেই সারা পৃথিবীতে এখনো সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক যায়? ১৭ কোটির দেশ, প্রতি বছর ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ তৈরি করে। সরকারি হিসেবেই বলছে, দেশে ১ কোটির বেশি ছদ্মবেকার আর ২১ লাখ কর্মক্ষম মানুষ সপ্তাহে এক ঘন্টার কাজও পাননা। আবার প্রতি বছর দেশে যে সাড়ে ৯ লাখের মত কাজ সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে সবসময় দেশের বেকারদের দক্ষতা মেলেনা। তাহলে এদের নিয়ে কী করে বাংলাদেশ? বাংলাদেশ বিদেশে শ্রমিক পাঠিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। কিন্তু গত দশ বছর ধরে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জায়গা কিন্তু কমতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা, অনেক দেশে যুদ্ধ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দরজা বন্ধ সেই ২০১৩ সাল থেকে। ‘টাকা চাই, দুবাই যামু’র দিন শেষ। এই অবস্থায় খোলা আছে একটা মাত্র দরজা, সেটা সৌদি আরবের। এ বছরেও, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই গেছেন প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার জন। অর্থাৎ, এ বছর বিদেশ যাওয়াদের ৫৭ শতাংশের বেশি গেছেন ঐ এক দেশেই।
২০১৮ সালে আড়াই লাখের বেশি শ্রমিক গিয়েছিলেন সৌদিতে আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় দুই লাখ মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশ আর মালয়েশিয়ার ভেতরের সিন্ডিকেট দুর্নীতিতে এবার এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ৪০০ লোকও পাঠানো যায়নি। হাইকোর্টের তাগাদার পরেও সেই দুর্নীতির তদন্তের কূলকিনারাতে কারো আগ্রহ নাই। ২০১৮ সালেও এই প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্সের পয়সায় দেশের রিজার্ভ আরো শক্তিশালী হয়েছে। দেশের অর্থনীতির এই উন্নতিতে আমাদের মত সুবিধাশালী গোষ্ঠীর সরকারি বেসরকারি খাতে সৎ রোজগারও গত এক দেড় দশকে দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে এ দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আমাদের অনেকেই তাই মনে করছেন, আজই ঘোষণা আসা দরকার আমরা আর নারীদের কাজে পাঠাবোনা। আমাদের আঁতে ঘা লাগছে, সৌদি বাড়িতে আমাদের নারীর সঙ্গে এমন আচরণে। কিন্তু, তার আগে অনেক বেশি প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন কী কাজ, কী সম্মানের ব্যবস্থা আমরা দেশে রেখেছি এই জনগোষ্ঠীর জন্যে!
আমাদের পুরুষ কর্মীরা তো বহু দশক হল মিসকিন ডাক শুনে, মিসকিনের মত ব্যবহার পেয়েই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যে! এর মধ্যে আবার এ বছরের শুরু থেকে পুরুষ শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কাফেলা দীর্ঘতর হচ্ছে। ‘স্ট্রোকে’ মরে দেশে ফিরলে তবু সরকারি বেসরকারি তালিকায় ঠাঁই পাওয়া যায়, কিন্তু, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে বিদেশে যেয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় বিরাট ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যারা আধাপাগল হয়ে দেশে ফিরছেন তাদের জন্যে কিন্তু কোন তালিকা নাই।
ইন্টারনেট, বিদেশ যাত্রার সক্ষমতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক টেলিভিশন দর্শন এমন নানা কিছুর কারণে আমাদের হয়তো আজকাল নিজেদের বিশ্ব নাগরিক কিংবা ইউরোপ- আমেরিকার বাসিন্দা মনে হয়। আমাদের এক মন্ত্রী মহোদয় সম্প্রতি বলেছেন ঢাকাকে ‘প্যারিস’ মনে হয় তাঁর। ভ্রম হতেই পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আপনি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের বাসিন্দা। আরো স্পষ্ট করে বললে, আপনি সবচেয়ে বড় অদক্ষ জনশক্তির দেশের বাসিন্দা। কাজেই আজ গোমর দেখিয়ে বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই বলে, দরজা বন্ধ করে এই নিরুপায় মানুষের স্রোত আটকে দিলে তারা ভাতের চিন্তায়, ভবিষ্যত চিন্তায় ফ্রিজে করে, ভেলায় ভেসে মহাদেশ, সাগর পাড়ি দিয়ে ভাগ্যান্বেষণে রওনা হবেন।
সৌদি পরিবারে আমাদের মেয়েরা গেলেই বাবা পুত্রের সম্মিলিত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এ ধরণের ঢালাও মন্তব্যকে আমি ক্ষতিকর বলে মনে করি। এই যে সৌদি সমাজের বিষয়ে আমাদের একরকম অবজ্ঞা, আমাদের উচ্চতর মানসিক-সামাজিক অবস্থান নিয়ে আমাদের গৌরব, সেটা একটু ভেঙ্গে দেওয়া জরুরি বলে আমার বোধ হয়। আমি বুঝি, আমরা কেন নিজেদের অগ্রসর ভাবি। প্রায় অর্ধশতক আগে, স্বাধীনতা লাভের পরেই আমরা যে সংবিধান নিয়েছিলাম তাতে লিখেছি, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এই মাটিতে সমান অধিকার পাবে। বাংলায় আমরা মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আবহমানকালের সংগ্রামে- সংসারে থেকেছি। আর সৌদি সমাজে ২০১৫ সালে মেয়েরা প্রথম ভোট দিতে পেরেছে আর ২০১৭ সালে প্রথম গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন, আমাদের এই ‘অগ্রসর’ সমাজে ৮ বছর বয়সে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীর বাড়িতে কাজে আসা জান্নাতি নামের শিশু মেয়েটিকে যখন পিটিয়ে মারা হল এই অক্টোবরের শেষে, ওর ১২ বছর বয়সে, তখন ময়নাতদন্তে ধর্ষণের প্রমাণও মিলল কেন? ঐ বাড়িতে প্রকৌশলী বাবা ছাড়াও তার ক্লাস সেভেনে পড়া কিশোর পুত্র ছিল। আমি জানতে চাই, আপনার কী মনে হয়? জান্নাতিকে পিটিয়ে মারার দায়ে যেই গৃহকর্ত্রী একা ধরা পড়েছেন পুলিশের কাছে, যার স্বামী পলাতক, তিনি কেন এখনো ধর্ষণের কথা শিকার করছেননা? তার বাড়িতে ঠিক কী ঘটছিল? ঐ বাড়িতে কে বা কারা ধর্ষণ করছিল সেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ না করলে শিশু মেয়েটিকে পিটিয়ে মারার পেছনের বিষাক্ত ক্ষমতা কাঠামোর মূলে কী পৌঁছানো যাবে? নাকি বোঝা যাবে এই সমাজের একটি সাধারণ শিক্ষিত পরিবারের ভেতরকার অত্যাচারী মানস? পত্রিকার পাতা ঘাঁটলে দেখবেন, গত কয়েকবছরে সেসব বাড়ির গৃহকর্মীর মৃত্যুর খবরই মনোযোগ পেয়েছে যেগুলোতে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী কোন পরিচিত সরকারি বেসরকারি সংস্থায় বড় পদে কাজ করেন। এসবের মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যকের বাড়িতে কাজ করতে থাকা ৮-১৪ বছরের মেয়েগুলো ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলে পরবর্তী ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসার পরেও কখনো রিকশাওয়ালা, কখনো গ্রামের ভূমিহীন, কখনো অসুখে শয্যাশায়ী বাবা মা মামলাও করেননি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এসব ‘বিশিষ্ট’ পরিবারের বাইরের গৃহকর্মী হত্যা- ধর্ষণের খবর পত্রিকার পাতায় জায়গাও করতে পারছেনা। এমন সমাজ বাস্তবতায় সৌদিতে কাজ করা মেয়েদের জন্যে কান্নায় আমি তো কোন সার খুঁজে পাইনা।
সৌদি আরবের অত্যাচারে আপনার হৃদয় বিদীর্ণ অথচ, আপনি কী করেন যখন, পাশের বাসার ৯-১০ বছর বয়সী কাজের মেয়েটা প্রায়ই মার খেয়ে চিৎকার করে কাঁদে, তারপর গোঙ্গায়, তারপর একদম চুপ মেরে যায়? বা তখন আপনি কী করেন, যখন পাশের বাসার ভাবীর গালে, হাতে প্রায়ই দাগ দেখেন, আর উনি নানারকম ব্যথা পাওয়ার গল্প ফাঁদেন? সরকারী জরিপ বলে, বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি বিবাহিত নারী নির্যাতনের শিকার হন। আর মেয়েরা নির্যাতনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জায়গা বলে মনে করে স্বামীর বাড়িকেই! স্বামীর বাড়ির নামই না আমরা সংসার দিয়েছিলাম! আর যে শিশু কাজে যায়না, বাড়িতেই থাকে, সেই কী নিরাপদ থাকে এই সমাজে? শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে।
সৌদি সমাজ নিয়ে আলোচনার আগে আসুন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই। আমাদের ঘরের ভেতরে ক্ষমতার কোন খেলা, নির্যাতনের কোন চর্চা আর দুর্বল সবলের কোন সমীকরণ চলে সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আজ ঘুমাতে যাই। আপনার আমার ঘরের ভেতরে কিন্তু ছাত্রলীগ নাই, সৌদি রাষ্ট্রের মত মধ্যযুগীয় সংবিধান নাই, মন্ত্রী এমপি নাই, নাই কোন ক্যসিনোবাজ। নাহ, আমার মনে হয় সেভাবে ভেবে দেখার, বুঝে দেখার সাহস থাকলে আজ বোধহয় আমাদের অনেকের ঘুমই হবেনা। না হওয়াই বোধহয় উচিত। ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’!লেখক: বিশ্লেষক