সংসদীয় গণতন্ত্রে পাবলিক সার্ভেন্ট ক্ষমতাধর কেন?
করোনাকালে দেশের কৃতীসন্তান জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ঘুমের মধ্যে ইন্তেকাল করলেন হৃদরোগে। মানুষ শেষ বিদায় জানাবে কি, তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্ররাও যেতে পারেননি। সাবেক কেবিনেট সচিব ও পিএসসির চেয়ারম্যান সৎ সাহসী কথা বলার মানুষ ড. সা’দত হুসাইন অসুখে ভুগে চলে গেলেন, ২২ দিন পর তাঁর স্ত্রীও। কি বেদনার! আরেক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যিনি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন, আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তা নিয়ে পথ হেঁটেছেন। জীবনের শেষবেলায় মৃত্যুর পর জানা গেল করোনা পজিটিভ! রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিলেও এত ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, ভক্ত, অনুসারী- কেউ তাঁকে শেষ বিদায়টা জানাতে পারেননি। জাতীয় বীরের এমন বিবর্ণ বিদায় কি কেউ চেয়েছিল? ছাত্রলীগের দাপুটে নেত্রী, ’৭০-এর নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র যোদ্ধা অধ্যাপক মমতাজ বেগম ইন্তেকাল করলেন, সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তার জানাজা হলো না! প্রিয়জনরা ছুটে গেল না! সুরকার সংগীত পরিচালক আজাদ রহমানও এ সময় মারা গেলেন। করোনার মৃত্যুই নয়, করোনাকালের সব মৃত্যুই মর্মান্তিক।
এমন বিষণ্ন মন খারাপ অসহায় সময় নামেনি পৃথিবীর বুকে! এমন মানসিক যন্ত্রণা আসেনি কখনো! গৃহবন্দী মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। মানসিক অবসাদে ভুগছে সব বয়সের মানুষ। বিজ্ঞানী গবেষক গবেষণাগার নির্ঘুম। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লড়াই চলছে। ওষুধের গবেষণা হচ্ছে। প্লাজমা থেরাপি ঢাকায়ও শুরু। করোনা রূপ পাল্টে তামাম দুনিয়াকে পরাস্ত করে রেখেছে। ভ্যাকসিন কেউ বলছেন এক বছর কারও মতে দুই বছর। কেউ বলছেন ভ্যাকসিন আসবে না, করোনাভাইরাসও যাবে না। আমরা যে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব শিখেছি তা অনুসরণ করে এর সঙ্গে লড়ে জিতলে বাঁচব, হারলে মরব। সামাজিকতা আড্ডাবাজি সমাবেশ শেষ। জীবিকার লড়াই অনিবার্য। পৃথিবীকে দুমড়ে-মুচড়ে বদলে দিয়ে যাচ্ছে করোনা। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তাঁর দূরদর্শী নীতি ও কৌশলে কৃষকের উৎপাদন বাড়িয়েছেন। ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে সরকার ধানও কিনছে। ধান ওঠায় মানুষ বেঁচে গেছে। আনন্দের ঈদ গ্রামে। নয় তো ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার চারদিকে ভয়ঙ্কর রূপ নিত।
করোনার মহাদুর্যোগকালে সারা দেশে সরকারের ত্রাণ তৎপরতায় জেলা সমন্বয়ের দায়িত্ব সচিবদের দেওয়া হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং রুলস অব বিজনেসে তিনি সচিবদেরও ওপরে স্থান পান। আর উপসচিব মর্যাদার একজন ডিসি এমপিদের চেয়ে ১০ ধাপ নিচে। মন্ত্রীরা তো মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। কিন্তু করোনাকালে যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে তাতে সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতার মালিক জনগণের মর্যাদা থাকছে না। মানে তার নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিদের পাশে এখন পাবলিক সার্ভেন্টদের কর্তৃত্ব সর্বগ্রাসী। এমপি-মন্ত্রী যারা সততা, ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাবোধ রাখেন তারা এসব আমল দিচ্ছেন না, নিজের সামর্থ্যে মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছেন ব্যক্তিগত তহবিল থেকে। মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে লড়ছেন। যারা বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, মর্যাদাবোধ নেই, তারা সেখানে নত হয়েছেন। এমনকি যোগ্যতা ছাড়া যারা তৃণমূলে দলের পদবি বাগিয়েছেন তারা পেছন পেছন হাঁটছেন। এক জেলায় দলের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের গণবিচ্ছিন্ন নেতার খবর পেলাম, যিনি ১১ বছরে দলের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। নিজ শহরে আলিশান বাড়ি, ঢাকায় ধানমন্ডিতে রাজকীয় ফ্ল্যাট, বিপুল ব্যবসা সম্পদ গড়লেও মানুষের জন্য ১০ লাখ টাকার ত্রাণ দেওয়ার মন হয়নি। তিনি পৌর মেয়রের নামে ডিসির কাছ থেকে সরকারি ত্রাণের দুই টন চাল নিয়েছেন!
৫৯ জন ত্রাণ চোর ধরা পড়েছে, বরখাস্ত হয়েছে, জেলেও গেছে। ৫০ লাখ মানুষকে প্রধানমন্ত্রী ২৫০০ টাকা করে যে অর্থ দিয়েছেন তাও লুটপাটের চেষ্টা ব্যর্থ। এমপি-মন্ত্রী দায়িত্বে থাকলে এ নিয়ে হৈচৈ হতো। কেউ বলে না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তালিকা কী দেখলেন? এমপি হলে গণমাধ্যমও শেষ করে দিত, কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানার ভয়ঙ্কর অপরাধ সাত খুন মাফ!
সাড়ে ৪ কোটি মানুষের ঘরে শেখ হাসিনা খাদ্যপণ্য পাঠিয়েছেন। এমপি-মন্ত্রী নেতা বিত্তবান সমাজকর্মীরাও অব্যাহত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও ত্রাণ বিতরণ করছে। ডিসিদের এলআর ফান্ডের টাকা কি যাচ্ছে? একসময় মন্ত্রীরাই থাকতেন জেলার সমন্বয়ের দায়িত্বে। এবারের দুর্যোগে তাদের জায়গায় পাবলিক সার্ভেন্ট সচিব! জেলায় কদিন গেছেন? আর তাকে কেন? এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। সবাই যে বিতর্ক করবেন তা নয়। কারণ সুবিধাভোগী মর্যাদাহীনরা কখনোই বিতর্ক করবেন না। কথা বলতেও বুকের পাটা লাগে। সাংবিধানিক অধিকার ও সংসদীয় গণতন্ত্রের চেতনাবোধ আবেগ অনুভূতি জুড়ে থাকতে হয়। আজ ক্ষমতার মালিক জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জায়গায় পাবলিক সার্ভেন্ট বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের যেভাবে ক্ষমতাধর করা হচ্ছে সেটি সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এমন পরামর্শ কারা দেয়! এটা রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি কেড়ে নেওয়ার চতুর কৌশল। এটা জনগণের ক্ষমতাহরণের ষড়যন্ত্র নয় তো? রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থায় বা সামরিক শাসন জমানায়ও এতটা উপেক্ষিত হয়নি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সামরিক শাসন-উত্তর সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রায় তো নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতার কাছে পাবলিক সার্ভেন্টদের কর্তৃত্ব বলে কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগ আমলে আজ এমন হলো কেন? তাও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের ক্ষমতাকালে!
ঈদে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডার থেকে গরিবদের দানে এমপিদের যে শাড়ি দেওয়া হতো তার সংখ্যা মাত্র দু-তিন শ। ভারতীয় শাড়ি অবৈধ আমদানিকালে আটক। সিলছাপ্পড় মারা শাড়ি নেহাতই দুস্থ ছাড়া কাউকে দেওয়া যায় না। এসব যে কাউকে দিয়েও বিতরণ করা যায়। এত দিন যখন এমপিদের মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে তাহলে আজ কেন হঠাৎ ডিসির হাতে? এটা জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতার মালিকানা ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বিধিবিধান রীতিনীতির প্রশ্ন। নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপি ব্যর্থ হলে দল মনোনয়ন দেবে না। অথবা ভোটে জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। তার পথে পথে জবাবদিহির দরজা থাকলেও পাবলিক সার্ভেন্টদের বেলায় নেই। আছে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি, পদোন্নতি, ক্ষমতা, অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পুরস্কার এবং তারও পরে পারলে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত করে এনে কখনো বা মন্ত্রিত্ব দান। জুনের সংসদে এই দুর্বল বিরোধী দল কি এ নিয়ে কথা বলবে?
বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের মতো দলে অনেক অভিজ্ঞ দক্ষ ত্যাগী নেতৃত্ব থাকার পরও যেমন মন্ত্রিসভার অর্ধেক ব্যবসায়ী, কতিপয় অদক্ষ তেমনি প্রবল ক্ষমতাধর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। এটা কখনোই সংসদীয় রাজনীতির চরিত্র হতে পারে না। আওয়ামী লীগের মতো দলের শাসনামলে তো নয়ই। একসময় পড়াশোনা জানা জাঁদরেল সিএসপিরাও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ব মেনেই পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দলকানা দলদাস হতে হয়নি। আজ সবাই নেতা-কর্মীর চেয়ে তো বড়ই, শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার! ভয়টা এখানেই। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্স করেন। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে বসেন। আরেকদিকে মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, অন্যপাশে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গণতন্ত্রের শহীদ ময়েজ উদ্দিন কন্যা সাবেক প্রতিমন্ত্রী এমপি মেহের আফরোজ চুমকি! সংসদীয় রাজনীতির কি বর্ণহীন ধূসর চিত্র!
রাজনৈতিক দলের শক্তি হচ্ছে আদর্শবান নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া নেতাদের সমাহার। এক কথায় শক্তিশালী সংগঠন। সঙ্গে জনগণের তুমুল আস্থা। জনগণের সমর্থন শক্তিই দলের শক্তি। প্রশাসন নয়। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধরা অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন না। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী মনে করছেন। কেউ ভাবছেন না বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কাল ক্ষমতায় না থাকলে দেশ দোজখে পরিণত হবে। কারণ তিনিই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির উত্তরাধিকার, ঐক্যের প্রতীক। তিনি না থাকলে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ভয়ঙ্কর আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার আগুনে পোড়ার শঙ্কাও আছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বামশক্তির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। দুঃসময়ের নেতা-কর্মী ও সাথীরাই শেখ হাসিনার ভরসার জায়গা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা অতীতের কোনো দুঃসময়েও পাশে দাঁড়ায়নি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে না। আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণের দল ছিল। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই তার বিকাশ জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে এ দেশের জন্মই দেয়নি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে। পরতে পরতে গণতন্ত্রের সংগ্রামের ইতিহাসে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী দল। মুক্তিযুদ্ধের পরই দলের ভাঙনে জাসদ সৃষ্টি করে মেধাবী স্বাধীনতা সংগ্রামী সাহসী তরুণ নেতা-কর্মীকে বের করে নিয়ে যে জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয় তা দলকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে। এ ষড়যন্ত্রের করুণ পরিণতি ঘটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারসহ নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে। সেদিন পিতৃহত্যার মধ্য দিয়ে খুনি অবৈধ শাসনের প্রতি সব বাহিনী আনুগত্যই প্রকাশ করেনি, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া চার নেতাকেই হত্যা করা হয়নি, আওয়ামী লীগকে নির্যাতনে দমন-পীড়ন-ভাঙনে শেষ করার চেষ্টাই হয়নি, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শকেও সংবিধান এবং রাজনীতিতে নির্বাসিত করা হয়েছিল। পাকিস্তানের পরাজিত আদর্শ ও শক্তির নতুন রূপ আবির্ভূত হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগে স্বাধীনতা সংগ্রামী গণমুখী জনপ্রিয় রাজনীতিবিদরাও ছিলেন। তবু লড়াই কঠিন হয়ে ওঠে। সেনাশাসন জমানার দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের আবেগ অনুভূতির ওপর ঐক্যের প্রতীক হয়ে শেখ হাসিনার আগমন, লড়াই, জীবনের ঝুঁকি সবটাই ইতিহাস। সবার জানা। তার নেতৃত্বে দল চারবার ও টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায়। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের গ্রেনেড হামলা তাঁকেসহ নেতৃত্ব উড়িয়ে দেওয়ার কি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্রের সমঝোতার রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক। ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে ক্ষমতায় আসার খেলা যেমন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ করেছে, তেমনি ওয়ান-ইলেভেনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রাজনৈতিক বা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করার নাটকের শেষ দৃশ্যটিই সম্পন্ন করেছে। এতে অনভিজ্ঞ অযোগ্যদের কপাল খুলে দল ও ক্ষমতার রাজনীতিতে। শেখ হাসিনার ওয়ান-ইলেভেন জয় করে গণরায়ে আসা ক্ষমতাকালে হেফাজতের তান্ডব, বিএনপি-জামায়াতের সহিংস হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পুলিশ বাহিনী ও র্যাব সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জীবন দেয়।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হলেও নেতৃত্বহীন বিএনপি জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হতো। কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্টরা এতটাই অতি উৎসাহী হন যে, কেউ ওভারটার্ম করেছে কিনা সেই সন্দেহ থেকে যায়। বিএনপির আর যাই হোক সাত আসন হওয়ার কথা ছিল না। বলা হয়, এর পর থেকেই সচিব-ডিসিদের অনেকেই ভাব দেখান যে, তারাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। সেই যাত্রায় কোথাও কোথাও তাদের কর্তৃত্ব বেড়ে যেতে থাকে। দক্ষ অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অনেকেই মন্ত্রিত্বের বাইরে থেকে যান। আর নির্বাচনের আগে বিতর্কিতদের মনোনয়ন না দেওয়ার অঙ্গীকার থেকেও দলকে সরে দাঁড়াতে হয়। অন্যদিকে দলের অনেকে হারান মনোনয়ন, আবার অনেকে হারান দলীয় পদ।
অনেক দুঃসময়ের দক্ষরা দলেও নেই সরকারেও নেই। সরকার ও দল আলাদা করার ভ্রান্তনীতিতে লেজেগোবরে অবস্থা। বিশেষ করে দলের পরীক্ষিত দুঃসময়ে তৈরি আদর্শিক নেতা-কর্মীরা যেখানে আজ পরিত্যক্ত সেখানে গুরুত্বহীন মান্নান খানও প্রেসিডিয়াম সদস্য বড় রহস্যময়। আওয়ামী লীগ মানে জনগণের শক্তি বা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের শক্তিশালী করা কি ভয়ঙ্কর নয়?
এদিকে শেখ হাসিনা দেশকে অর্থনীতিতে বিস্ময়কর উত্থান ঘটিয়ে রাজনীতিতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে সাফল্য অর্জন করার পাশে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝোলাতে সক্ষম হলেও আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে কি শক্তিশালী? কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের স্বাধীনতা সংগ্রামী অধিকাংশ নেতৃত্ব মারা গেছেন। জীবিতরা থেকেও নেই! মুক্তিযুদ্ধ ও পঁচাত্তরের বীরদের অনেককেই দল ধরে রাখতে পারেনি। দুঃসময়ে নেতৃত্বে উঠে আসা অনেককে জায়গা দেয়নি কোথাও। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসময়ে শেখ হাসিনার পাশে লড়াকুরাও উপেক্ষিত।
অনেক এমপি বিতর্কিত। অনেক তৃণমূল নেতৃত্বও। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব চাঁদাবাজির কলঙ্কে বিদায়, বর্তমান নেতৃত্ব করোনায় প্রশংসিত হলেও এক নেতা নথি জালিয়াতিতে বহিষ্কার ও জেলে। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বও বিদায় নিয়েছিল ক্যাসিনোঝড়ে। পাপিয়া কেলেঙ্কারিতে উন্মোচিত যুব মহিলা লীগের কীর্তি। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডদের দাপট! ১১ বছরে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের অনেক নর-নারীই অঢেল অর্থবিত্তের মালিক। এর মাঝে মাদকবিরোধী যুদ্ধ চললেও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান করোনার আগেই থেমে গেছে। ব্যাংক, শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটেরাদের স্পর্শ করা যায়নি। ৫ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারীরা ধরা পড়ে না! পাবলিক সার্ভেন্টরা এদের সহায়তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো দলের দুর্বলতাটা কোথায় যে লুটেরাদের পাকড়াও করে না! পাবলিক সার্ভেন্টদের ক্ষমতাবান করে?
আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কমিটি কি আদৌ গণসম্পৃক্ত কর্মীবান্ধব? সমাজে প্রভাব বিস্তার করা নেতৃত্বে শক্তিশালী যে কখনো বিরোধী দলে গেলে চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে? রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতানির্ভর বিএনপি জামায়াতকেও দেখেছে দেশ। এখন তাদের অবস্থা কী করুণ! অনেকে ক্ষমতার আসমানে বসে ভাবেন আওয়ামী লীগবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ধুলোয় মিশে গেছে। সর্বনাশা চিন্তা। বিএনপি-জামায়াত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়েই আবির্ভূত হবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষমতা হারালে। আওয়ামী লীগের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতা অনন্তকালের নয়। জবাবদিহি দলকেই করতে হবে। এমপি-মন্ত্রী নেতাদেরই করতে হবে। রাজনীতি নেতা-কর্মীকেই করতে হবে। পাবলিক সার্ভেন্টরা রাতারাতি পেশাদার হয়ে যাবে। দুঃসময়ে দল করবে না। দুঃসময়ে গণমুখী সাহসী নেতৃত্বে শক্তিশালী দলকেই জনমত নিয়ে চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। প্রশাসন ও ক্ষমতানির্ভর আওয়ামী লীগের কি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাংগঠনিক শক্তি আছে? বিএনপি-জামায়াত জমানার বৈরী সময়ে গঠিত মহাজোটের ঐক্য কি তখন থাকবে? আন্দোলন নির্বাচন মহাজোটের হলেও সরকার কি মহাজোটের? সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।