লিঙ্গসূত্র-তসলিমা নাসরিন
তেরো বছর বয়স আমার তখন। একদিন শুনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। নাম ছিল আবুল হোসেন, মেয়ে হওয়ার পর নাম হোসনে আরা। ক’দিন পরই লাল বেনারসি পরে হোসনে আরা বিয়ে করে ফেললো তার রুমমেটকে। ঘটনাটা আমকে খুব আলোড়িত করেছিল। খবরের কাগজে আবুল হোসেন আর হোসনে আরা ছবি পাশাপাশি ছাপা হত। আবুল হোসেন সবসময় মৌলানাদের স্কার্ফের মতো একটা স্কার্ফ পরতো, বুক আড়াল করার জন্য। ভেতরে ভেতরে মেয়েই ছিল সে, কিন্তু জন্মের পর আত্মীয় স্বজন ভেবেছিল সে ছেলে, ভাবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। বড় হয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পেরেছিল সে ছেলে নয়। লজ্জায় ভয়ে অনেক বছর কাউকে কিছু বলেনি। ছেলেদের হোস্টেলে থাকতো, সবাই তাকে ছেলে বলেই জানতো। কিন্তু একসময় অস্বস্তির চরমে পোঁছে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। ডাক্তার কী একটা অপারেশন করলেন, ব্যস, আবুল হোসেন মেয়ে হয়ে গেল। খবরটা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল হঠাৎ একদিন ছেলে হয়ে যাওয়ার। কিন্তু বুঝতাম, আবুল হোসেনের শরীরটা যেমন ভেতরে ভেতরে মেয়ের শরীর ছিল, আমার শরীরটা ভেতরে ভেতরে ছেলের শরীর নয়। আসলে মেয়েদের ওপর পারিবারিক সামাজিক ধার্মিক রাষ্ট্রিক অত্যাচার এত বেশি হত যে ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে এসব থেকে বাঁচতে চাইতাম। অন্য কোনও কারণ ছিল না।
মেয়েদের পোশাক পরতাম, কিন্তু ফাঁক পেলেই ছেলেদের পোশাক পরার ইচ্ছে হত। তখনও আমাদের শহরের মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের প্যাণ্টের মতো প্যাণ্ট পরার চল শুরু হয়নি। মনে আছে প্রথম যখন প্যাণ্টের কাপড় কিনে দরজির কাছে গিয়ে নিজের জন্য একখানা প্যাণ্ট বানানোর প্রস্তাব করলাম, দরজি বানাতে চাইল না, পরে দাদকে দিয়ে অনুরোধ করার পর বানালো বটে, কিন্তু ছেলেদের প্যাণ্টের মতো সামনে চেইন দিল না, চেইন দিল কিনারে। বলার পরও পকেট দিল না প্যাণ্টে। প্যাণ্ট যদি নিতান্তই মেয়েরা পরতে চায়, তবে সেই প্যাণ্ট পুরুষের প্যাণ্টের চেয়ে ভিন্ন করে বানানোর জন্য সত্তর দশকের ময়মনসিংহে দরজিদের কায়দা কানুনের কমতি ছিল না। প্যাণ্ট পরাই তখন রেভুলুশান, সার্টের প্রশ্নই আসে না। অবশ্য সার্টও বানিয়েছিলাম, দরজিরা কায়দা করে ছেলেদের সার্টের চেয়ে একটু আলাদা করে বানিয়েছিল। বুক পকেট তো দেয়ইনি, বরং বুকের ওপর অনর্থক দু’তিনটে কুঁচি বসিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য দরজিকে বেশ ধমক টমক দিয়ে মেয়েদের পোশাক পুরুষের পোশাকের থেকে যে করেই হোক ভিন্ন করার ওদের দুষ্টুমিটা বন্ধ করেছিলাম। যেহেতু নিষেধ ছিল ছেলেদের পোশাকের মতো পোশাক পরা, নিষেধ ভাঙতেই ওই কাজটা করতাম। কিছু লোক নিয়ম বেঁধে দেবে কী করে হাঁটতে হবে, হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, খেতে হবে, কী করে কথা বলতে হবে, কী বলতে হবে, কণ্ঠস্বরটা কতখানির পর আর ওঠানো চলবে না, কী পোশাকের বাইরে কী পোশাক পরা যাবে না, বাড়ি থেকে কখন বেরোতে হবে, কখন ফিরতে হবে, আর আমিও সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো, কোনও প্রশ্ন করবো না, এ মানা আমার সেই কৈশোরেই আমার মনে হয়নি যে উচিত। ‘ছেলেদের পোশাক মেয়েদের পরতে হয় না’- এই উপদেশ উঠতে বসতে শুনতাম বলে ছেলেদের পোশাক পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, যে, ইচ্ছে করলে যা খুশি পরা যায়। আমি তখন বুঝে পাইনি, ছেলেরাও কেন মেয়েদের জন্য বরাদ্দ পোশাক পরে বুঝিয়ে দেয় না যে তারাও নিয়ম মানে না! কেন তারা স্কার্ট পরে না, শাড়ি, কামিজ পরে না? পুরুষ তো কম বিপ্লব করেনি, তবে পোশাকের এই বিপ্লবে এত আপত্তি কেন? পরে অবশ্য বুঝেছি, মেয়েদের স্থান সমাজে এত নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে, যে, বেশির ভাগ পুরুষ মনে করে, নিচুদের পোশাক পরা মানে নিজে নিচু হওয়া, অথবা দ্বিতীয় লিঙ্গের পোশাক পরার অর্থ প্রথম লিঙ্গকে অপমান করা। আর ওদিকে মেয়েরা যারা পুরুষের পোশাক পরে, তাদের মধ্যে অনেকেই মনে মনে এই ভেবে সুখ পায়, যে, একটু বুঝি প্রভুদের কাতারে ওঠা গেল, মানটা বাড়লো। পুরুষ ক্রস-ড্রেসারদের অনেকে ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী হলেও মেয়ে ক্রস-ড্রেসারদের অনেকেই তা নয়। পুরুষ আর নারীর সামাজিক বৈষম্য না থাকলে সম্ভবত একই পোশাক পরতো উভয়েই। হাসপাতালে, জেলখানায় উভয়ের একই পোশাক। ডাক্তারিশাস্ত্রের চোখে সব রোগী, আইনের চোখে সব অপরাধী সমান বলেই হয়তো।
পুরুষ আর নারীর শরীরে, মাঝে মাঝে মনে হয়, এক সুতোর ব্যাবধান। নারীভ্রুণ দিয়ে পুরুষের যাত্রা শুরু, মাঝপথে ওয়াই ক্রেমোজম এসে নারীভ্রুণকে পুরুষভ্রুণে রূপান্তর করে। নারী পুরুষ দু’জনের শরীরেই থাকে পুরুষ-হরমোন টেস্টোস্টেরন আর নারী-হরমোন এস্ট্রোজেন। পুরুষের শরীরে একটু বেশি টেস্টোস্টেরন আর নারীর শরীরে একটু বেশি এস্ট্রোজেন, এই যা পার্থক্য। হরমোনের পরিমাণ একটু এদিক ওদিক হলেই মেয়েকে দেখতে লাগবে ছেলের মতো, ছেলেকে মেয়ের মতো। চাইলে হরমোন কিন্তু আরও ভয়ংকর ভয়ংকর কাণ্ডও করতে পারে। পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ উল্টে পাল্টে ফেলতে পারে।
লিঙ্গ অত সহজ নয়, যত সহজ বলে একে ভাবা হয়। লিঙ্গ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্বিকও। অধিকাংশ লোক ভাবে, জগতের সব সুস্থ মানুষই বুঝি শরীরে পুরুষ, মনেও পুরুষ, অথবা শরীরে নারী, মনেও নারী। কিন্তু এর ব্যাতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রমটা বুঝতে হলে জেণ্ডার বা মনোলিঙ্গ বুঝতে হবে। শরীরে যেমন লিঙ্গ থাকে, মনেও একধরণের লিঙ্গ থাকে, লিঙ্গবোধ থাকে। যাদের জৈবলিঙ্গের সঙ্গে মনোলিঙ্গের কোনও বিরোধ নেই, তারা সিসজেণ্ডার। জগতের সবাই সিসজেণ্ডার নয়, অনেকে ট্রান্সজেণ্ডার, সিসজেণ্ডারের ঠিক উল্টো। পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মনে করে না যে সে পুরুষ, মনে করে সে নারী, আবার ওদিকে নারীর শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মোটেও সে বিশ্বাস করে না যে সে নারী, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে পুরুষ। এই ট্রান্সজেণ্ডারা বা রূপান্তরকামীরা নড়নচড়নহীন রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেইন ইন দ্য অ্যাস। এদের দুর্ভোগ প্রতি পদে পদে। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গেলে সবাইকেই অবশ্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়
।
ধরা যাক, জন্মানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শরীরে পুরুষাঙ্গের উপস্থিতি দেখে বাবা মা বা ডাক্তাররা রায় দিয়ে দিলেন, সন্তান ছেলে, পরিবারের এবং সমাজের সকলে জানলো যে সে ছেলে, কিন্তু নিজে সে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে আর অনুভব করতে থাকে যে সে ছেলে নয়, সে মেয়ে। সে যখন নিজেকে মেয়ে ভেবে মেয়েদের সাজ-পোশাকে বাইরে বেরোয়, এবং সত্য কথাটা প্রকাশই করে ফেলে যে পুরুষের শরীর সে ধারণ করছে বটে, কিন্তু সে আসলে পুরুষ নয়, সে মেয়ে, লোকেরা তাকে হাস্যরসের বস্তু ভাবে, সার্কাসের ক্লাউনের চেয়েও বড় ক্লাউন ভাবে, চিড়িয়াখানার চিড়িয়া ভাবে, তাকে শেকলে বাঁধে, পাগলা গারদে বন্দি করে। লোকেরা কেউ ছি ছি করে, কেউ বিদ্রুপ ছোড়ে, কেউ গালি দেয়, ন্যাংটো করে, পেটায়। কেউ কেউ জন্মের মার মেরে তার মাথার ভুত তাড়াতে চায়। মাথার ভুত মাথা ছেড়ে কিন্তু এক পা নড়ে না। মাথার লিঙ্গ মাথা কামড়ে পড়ে থাকে।
মেয়েরা ছেলেদের মতো আচরণ করলে আজকাল তবু সহ্য করে মানুষ, কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের মতো আচরণ করলে আজও অধিকাংশ মানুষ সহ্য করে না। দ্বিতীয় লিঙ্গ প্রথম লিঙ্গকে অনুকরণ করে করুক, কিন্তু প্রথম লিঙ্গের লিঙ্গাভিমান এমনই যে, দ্বিতীয় লিঙ্গের কিছু অনুকরণ করার মানে দাঁড় করায় প্রথম লিঙ্গের অপমান। মেয়েরা দিব্যি ছেলেদের মতো পোশাক পরছে, ব্যবসাবাণিজ্য করছে, ছেলেদের মতো মদগাঁজা খাচ্ছে, মোটরবাইক চালাচ্ছে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র, বিজ্ঞানী বৈমানিক হচ্ছে, নেতা মন্ত্রী হচ্ছে , অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে, মানুষ খুন করছে। আর, ওদিকে, ছেলেরা চোখে সামান্য একটু কাজল, ঠোঁটে একটুখানি লিপস্টিক আর মেয়েদের মতো জামা জুতো পরলেই সমাজের ভিত কেঁপে ওঠে।
মানুষ তার নিজের জীবনটা যাপন করবে, নাকি নিজের ‘যৌন পরিচয়’কে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার যুদ্ধই করে যাবে সারা জীবন? নিজের যৌনপরিচয় দেবার ভার নিজের কাছে থাকলে উটকো অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচে মানুষ। তুমি নিজেকে যে লিঙ্গের মানুষ বলে মনে করছো, কেউ মানুক বা না মানুক, সেটাই তোমার সত্যিকারের লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন পরিচয়।
কোনও পুরুষ যদি বলে সে নারী, অথবা কোনও নারী যদি বলে সে পুরুষ অথবা কোনও নারী বা পুরুষ যদি বলে সে নারীও নয় পুরুষও নয়, পাগল সন্দেহ না করে তাকে বরং আমাদের বিশ্বাস করা উচিত । কারণ একমাত্র সেই মানুষটাই জানে সে কী। আমাদের সমাজ এখনও নারী আর পুরুষের ভাঙা-ভোঁতা সংজ্ঞা খাড়া করে। জোর গলায় বলে, যাদের শরীরে এক্স এক্স ক্রোমোজম, তারা কেউ পুরুষ হতে পারে না, আর যাদের শরীরে এক্স ওয়াই, তারা কেউ নারী হতে পারে না! কেন হতে পারে না, শুনি? নিশ্চয়ই হতে পারে। কোনও ক্রোমোজম আর কোনও জৈবলিঙ্গের ওপর মনোলিঙ্গ নির্ভর করে না। শরীরের বাহ্যিক বৈশিষ্টের ওপর নির্ভর করে না, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ডাক্তার বদ্যি তাকে কী লিঙ্গে চিহ্নিত করলো, তার ওপরও নির্ভর করে না। জেণ্ডার বা মনোলিঙ্গ সেক্স বা জৈবলিঙ্গের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেটে ছিঁড়ে মাড়িয়ে পুড়িয়ে গলিয়ে থেতলে আর যে লিঙ্গকেই দূর করা যাক, মনের লিঙ্গকে করা যায় না। জৈবলিঙ্গটা শরীর, মনোলিঙ্গটা আইডেনটিটি, প্রেজেনটেশন, সেল্ফ-এক্সপ্রেশন,ইন্টারপারসোনাল সম্পর্ক, সোশিয়-কালচারাল রোল।
কোনও মেয়ে তার নিজের শরীরের দিকে তাকালেই যদি দেখে শরীরটা অন্য কারো, শরীরটা অচেনা, অদ্ভুত, শরীরটা পুরুষের, যে শরীরটা তার শরীর হলেও তার শরীর নয়, শরীরটাকে নিজের বলে ভাবতে তার অস্বস্তি হয়, কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়, এ শরীর তাকে শুধুই দুঃসহবাস দেয়, তবে কী করবে সে? গুমরে গুমরে একলা ঘরে কাঁদবে সারা জীবন? দরজা বন্ধ করে সকলের চোখের আড়ালে পুরুষের পোশাক খুলে নারীর পোশাক পরে চোরের মত নিজেকে দেখবে আয়নায়, বছরের পর বছর? বন্ধ দরজাটা খুললেই বা সত্য উচ্চারণ করলেই লোকের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হবে তাকে! এ কার দোষ, তার, নকি যারা বাস্তবকে মেনে নেয় না, তাদের? এ তাদের দোষ, যারা প্রকৃতির এক রূপকে স্বীকার করে, আরেক রূপকে করে না, যারা মনে করে দুনিয়াতে সিসজেন্ডারই বা অরূপান্তরকামীরাই সত্য, ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরা নয়, যারা মনে করে নারী ও পুরুষের যৌনআকর্ষণই সঠিক যৌন আকর্ষণ, বাকি সব যৌন আকর্ষণ ভুল, মিথ্যে।
তুমি ট্রান্সজেণ্ডার, রূপান্তরকামী। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে এখন ট্রান্সসেক্সুয়াল হয়েছো। তুমি সাজতে ভালোবাসো, গয়না পরতে ভালোবাসো, মেয়েদের পোশাক পরতে পছন্দ করো, পুরুষের সঙ্গে শুতে পছন্দ করো, তাই বলে কিন্তু তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করোনি। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছো, কারণ তুমি মূলত নারী, তুমি তোমার মতো করে তোমার নারীত্বকে প্রকাশ করেছো। তোমার জেণ্ডার নারীর, তোমার শরীরটা দেখতে আকাশ বাতাস হাতি ঘোড়া এক্স ওয়াই যা কিছুই হোক না কেন, তুমি মনে প্রাণে, অন্তরে বিশ্বাসে নারী। যৌনসম্পর্কের জন্য পুরুষকে পছন্দ না করে, তুমি কোনও মেয়েকেও পছন্দ করতে পারতে। সম্ভবত তুমি মনে মনে ‘বিষমকামী বা হেটারোসেক্সুয়াল নারী’ বলেই পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেছো। তুমি কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষকে বিষমকামিতার সুখ দিতে নিজের লিঙ্গ বদলাওনি, তুমি লিঙ্গ বদলেছো কারণ তোমার ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছিল একটা পুরুষের শরীরকে বছরের পর বছর অকারণে বহন করতে, এ অনেকটা কাঁধে হিমালয় নিয়ে হাঁটার মতো। ভালুকের ছাল পরে প্রতিটা দিন যাপন করলে আমার ঠিক কেমন বোধ হবে, ভাবি। ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের বোধহয় ঠিক সেরকমই অসহ্য অস্বস্তি হয় আর ওই ওপরের আবরণটা খোলসটা ঝামেলাটা উপদ্রপটা খুলে ফেলতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। লিঙ্গ-বদল সব ট্রান্সরা করে না। কেউ কেউ করে। করুক বা না করুক, করার অধিকার সবারই আছে। মানবাধিকার সবার জন্যই।
জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা একে কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন বা মস্তিস্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে- সেই লিঙ্গকে যদি শরীরে স্থাপন করতে চায় করুক। অনাকাংখিত অবাঞ্ছিত লিঙ্গের বোঝা শরীরে বহন করে জীবনভর ভোগা থেকে বাঁচুক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেলা যদি সম্ভব হয় তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করবো, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার নাকি অন্যের?
লিঙ্গান্তর করে যদিও একশ ভাগ পুরুষ বা একশ ভাগ নারী হওয়া যায় না, কিন্তু যতটুকুই হওয়া যায়, তাতে যদি সুখ পায় মানুষ, সুখ পাওয়ার অধিকার তাদের একশ ভাগ।
নাতালি নামে আমার এক বন্ধু এখন আপাদমস্তক মেয়ে। ক’দিন আগে তার গোটা শরীরটাই ছিল পুরুষের। তার মন তার শরীরকে কখনও মেনে নেয়নি। শুধু নারীর পোশাক পরে নাতালির নারী হওয়ার সাধ মেটেনি, লিঙ্গ বদলে ফেলে সে তার সাধ মিটিয়েছে। নিজের শরীর নিয়ে যা কিছু করার অধিকার তার আছে। কাউকে কৈফিয়তই বা দিতে হবে কেন সে কী করেছে বা যা করেছে কেন করেছে? নাতালিকে মেয়ে বলে না মানা মানে নাতালিকে অশ্রদ্ধা করা, নাতালির মানবাধিকার, ট্রান্সঅধিকার লঙ্ঘন করা। পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল, সেই পুরুষাঙ্গটির কারণে লিঙ্গান্তরিত নাতালিকে এখন পুরুষ বলে সম্বোধন করলে তাকে ঘোরতর অপমান করা হয়। ওই কাজটা আমি অন্তত করিনি। তাকে মিস্টার এক্স বলিনি, মিস নাতালি বলেই ডেকেছি। যারা লিঙ্গ বদলে নিয়েছে শুধু তাদেরই কেন, শরীরে আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের নারী বলে মনে করছে, বিশ্বাস করছে, তাদেরও নারী হিসেবেই সম্বোধন করা উচিত সবার।
পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তাহলে দুনিয়াটা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুটে আর বোরিং কিছু একটা হত। ভালো যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভালো যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইতো, তাহলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকতো না দুনিয়ায়।
প্রচুর মেয়ে ওয়াই ক্রোমোজম নিয়ে দিব্যি জীপন যাপন করছে। জিনটা পুরুষের, কিন্তু ‘অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম’ থাকার কারণে অ্যান্ড্রাজেন রিসেপটর কম, ফলে পুরুষ হরমোন বেরিয়ে যে ভ্রুণকে পুরোপুরি পুরুষের ভ্রুণ করে গড়ে তুলবে, তা হয় না। কলকাতার পিংকি প্রামাণিক সম্ভবত এই সিনড্রামের শিকার। আবার ওদিকে অনেকে আছে, জিনটা মেয়েদের, কিন্তু ‘কনজেনিটাল অ্যাডরেনাল হাইপারপ্লাসিয়া’ হওয়াতে মেয়েদের হরমোন জোটে না, সে কারণে তারা মেয়ে হয়েও ঠিক মেয়ে নয়।
নারীর যৌন আকর্ষণ পুরুষের জন্য, আর পুরুষের যৌন আকর্ষণ নারীর জন্য, এটাই ন্যাচারাল, বা প্রাকৃতিক, বাকি সব অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরুদ্ধ—এরকম ভাবাটা সম্পূর্ণ ভুল। সমকামীর সংখ্যা দুনিয়াতে যে কম নয়, তা মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সব সমকামীকেই এক বাক্সে ফেলা যায় না। সমকামীরা যে সবাই একশভাগ সমকামী তা নয়। বাইজেণ্ডার বা উভকামীর সংখ্যাও প্রচুর। সব উভকামীও একশ ভাগ উভকামী নয়। পুরুষ আর নারীর প্রতি কোনও কোনও উভকামী একই রকম যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ কেউ আবার ভিন্ন রকম।
বিচিত্র সব কাম চারদিকে। কেউ কেউ বহুকামী বা পলিজেণ্ডার। কেউ আবার সর্বকামী বা প্যানজেণ্ডার। কেউ কিন্তু নিস্কামী। কোনওরকম কামের বালাই নেই। খাঁটি এজেণ্ডার বা জেন্ডার-নিউট্রাল যাকে বলে। আবার জেণ্ডারকুইয়ারও আছে, যারা নিজেদের নারীও মনে করে না, পুরুষও মনে করে না, বা দুটোই মনে করে, দুটোতেই সাঁতার কাটে, তাদের যৌনপরিচয়-যৌনবোধ-যৌনতা সব একাকার হয়ে যায়। সব কামই, সব যৌন আচরণই–যত কম সংখ্যাক লোকই সে আচরণ করুক না কেন–প্রাকৃতিক, যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর ভ্যারিয়শনকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।
প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়াও শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌনপ্রবৃত্তি; সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা। সমকামিতা আগাগোড়া বাস্তব, এ কোনও ব্যতিক্রমী কাম নয়, বিকল্প যৌনতা নয়। সমকামিতা বিষমকামিতার বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, বনোবো, যাদের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ-র মিল শতকরা আটানব্বই ভাগ, ভীষণই উভকামী। প্রকৃতি শুধু ‘প্রজনন করো, প্রজাতি টেকাও’ মণ্ত্র জপে না। প্রকৃতি আরও অনেক কিছু করে। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও সমকামিরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়। যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য বংশ বিস্তার করা নয়। সামাজিকতাও যৌনতার উদ্দেশ্য। বনোবোরা হাতের কাছে স্ব-প্রজাতির যাকেই পায়, তার সঙ্গেই যৌনসঙ্গম করে, এর ফলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুতা গড়ে ওঠে, একজনের বিপদে-বিপর্যয়ে আরেকজন দাঁড়ায়, সকলে মিলে নিজেদের প্রজাতিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচায়। যদি বংশ বিস্তারই প্রজাতির টিকে থাকার পেছনে একমাত্র পদ্ধতি হত, তাহলে পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতাদের জগতে এত বন্ধ্যা সৈন্য থাকতো না, যাদের কাজ বংশ বিস্তার করা নয়, বরং প্রজাতিকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করা।
সমকামীদের এককালে মানসিক রোগী বলা হত। ভয়াবহ নির্যাতন করা হত সমকামীদের। সমকামকে জেনেটিক রোগও একসময় বলা হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, এ জেনেটিক ভেরিয়েশন বা জেনেটিক প্রকারণ হতে পারে, জেনেটিক রোগ নয়। আর, সমকামিতা কোনও অ্যাণ্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম নয়, কোনও মানসিক রোগ তো নয়ই।
রূপান্তরকামীরা ভুগছে সব দেশেই। তবে সব রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেণ্ডারদের সমস্যা এক নয়। ট্রান্স মেয়েদের সমস্যা ট্রান্স পুরুষের সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। ট্রান্স মেয়েরা নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা বা মিসোজিনির শিকার। সিস মেয়েরা মেয়ে হওয়ার অপরাধে জন্মের পর থেকে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা, হেনস্থা, উৎপাত, উপদ্রব, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়, ট্রান্স মেয়েরা সেসব তো আছেই, আরও দ্বিগুণ লাঞ্ছনার শিকার হয়, কারণ পুরুষের মতো একটা উন্নততর লিঙ্গকে অস্বীকার করে নিম্নলিঙ্গ নারী বনতে যাওয়া যে নিতান্তই বোকামো, পাগলামো, আর ধৃষ্টতা —তা বিরতিহীন বিদ্রুপে লিঙ্গান্তরিত মেয়েদের জীবন জর্জরিত করে জানিয়ে দেয় পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষীরা।
দুনিয়াতে দুষ্ট ধর্মান্ধরা যেমন অন্যের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে ঘোর অন্যায় করে, দুষ্ট বিষমকামীরাও ঠিক তেমন অন্যকে বিষমকামী হওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে ঘোর অন্যায় করে । ধর্মান্ধরা ধর্ম-না-মানা মানুষদের আজ শত শত বছর ধরে অত্যাচার করছে, বিষমকামীরাও ঠিক তাই করছে, তাদের হেনস্থা করছে, যারা বিষমকামী বা হেটারোসেক্সুয়াল নয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যাদের যৌন আকর্ষণ নেই। ধর্মীয় আর বিষমকামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে আজ মানববাদী, নাস্তিক্যবাদী, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত, লিঙ্গান্তরিতরা সিঁটিয়ে থাকে।
বিবর্তনের ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ বিবর্তনে না বিশ্বাস করে ভগবানে করছে, যে ভগবানের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ মেলেনি। যুক্তি বুদ্ধির সমুদ্রে মানুষকে ডুবিয়ে রাখলেও মানুষ অনড় মূর্খতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। প্রকৃতি থেকে তুলে যত প্রমাণই চোখের সামনে রাখি না কেন, রূপান্তরকাম, সমকাম, উভকাম –কোনওটাই ন্যাচারাল নয়, এমন কথা বলবেই কিছু লোক। ধরা যাক, ন্যাচারাল নয়। তাতে কী? সবাইকে ন্যাচারাল হতেই বা হবে কেন, শুনি? ন্যাচারাল ব্যাপারগুলো বরাবরই বড় পানসে। ন্যাচারাল হওয়ার জন্য স্বাধীনতা বা অধিকারের দরকার হয় না, আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য দরকার। আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য বুকের পাটারও বেশ দরকার।
‘প্রকৃতি’কে হাতিয়ার করে মূর্খ আর দুষ্ট লোকেরা কি আজ থেকে মানুষকে ভোগাচ্ছে! একসময় মেয়েদের লেখাপড়া করা, ঘরের বার হওয়া, চাকরি বাকরি করা, সব কিছুকেই এরা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বলেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় এসব। প্রকৃতির কিছই না জেনে প্রকৃতি-বিশেষজ্ঞ সাজার লোক চারদিকে প্রচুর।
প্রকৃতি চিরকালই বিস্ময়কর, বৈচিত্রময়, বর্ণময়। যৌনতার মতো। আবার, আরও একটা প্রশ্নও এখানে করা যায়, কে বলেছে প্রকৃতির সবকিছু সবসময় ভালো এবং গ্রহণযোগ্য, কে বলেছে প্রকৃতিকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ? প্রকৃতিকে দিনরাত আমরা অস্বীকার করছি না? অস্বীকার করে নির্মাণ করছি না প্রকৃতি যা দিতে পারে, তার চেয়েও চমৎকার কিছু? পঙ্গু শিশু জন্ম নিলে তার পঙ্গুত্ব সারাচ্ছি, নকল হিপ লাগাচ্ছি, পা লাগাচ্ছি, ফুটো হৃদপিণ্ড নিয়ে জন্মাচ্ছে, নকল হৃদপিণ্ড অবধি লাগিয়ে নিচ্ছি। আমাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা সারাতে কাগজ-কলম-কম্পিউটার ব্যাবহার করছি। নানা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রকৃতির ভুল ভ্রান্তি, প্রকৃতির অপারগতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা সংশোধন করছি প্রতিদিন, আমাদের ডানা নেই, বিমান বানিয়েছি ওড়ার জন্য, প্রকৃতি আমাদের যে চোখ দিয়েছে, তার ক্ষমতা যথেষ্ট নয় বলে টেলেস্কোপ বানিয়েছি, মাইক্রোসকোপ ব্যবহার করছি।
সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের সমান। পুরুষ লিঙ্গের যেমন অধিকার, নারী লিঙ্গেরও একই অধিকার, উভলিঙ্গেরও একই। হেটারোসেক্সুয়াল বা বিষমকামীদের অধিকার যতটুকু, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদেরও ততটুকুই। এতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মানবাধিকারে বিশ্বাস নেই। যারা সমকামী আর রূপান্তরকামীদের নিগ্রহ করছে, যারা সিসজেণ্ডার আর বিষমকামী ছাড়া, অর্থাৎ পুংলিঙ্গের পুরুষ ও নারী-লিঙ্গের নারী ছাড়া আর সবাইকে, পুরুষ আর নারীর কাম ছাড়া আর সব কামকে অস্বাভাবিক আর প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করছে—তাদের শিক্ষিত করা, সচেতন করা, মানুষ করা অত্যন্ত জরুরি। আকাটমূর্খের সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মূর্খামি মেনে নিতে হবে, গণতন্ত্রও বলে না। গণতণ্ত্র সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে। সমকামী বলে বা রূপান্তরকামী বলে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অধিকার কিছু কম জোটে কোথাও, তবে তা নিতান্তই বিষমতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়।
রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছে চারদিকে। ওরা চাইছে নিজের জেণ্ডার নিজের নির্ণয়ের অধিকার এবং সেই জেণ্ডারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার অধিকার, রূপান্তরকামী বলে নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার, নিজের জৈবলিঙ্গকে পরিবর্তন করার অধিকার, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার অধিকার, যৌনসঙ্গমের অধিকার, বিয়ে করার অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। যে সমাজে আজও নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয়, সে সমাজে সমকামী আর রূপান্তরকামীদের অধিকারের জন্য আরও দীর্ঘ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হবে, অনুমান করতে পারি। মানুষ প্রজাতি সেদিন সত্যিকার সভ্য হবে, যেদিন কোনও মানুষকেই নিজের মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।
সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয়, তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে, হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়।
একবিংশ শতাব্দি চলছে। মানুষ আর কবে সভ্য হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও বুঝি গুহায় বাস করছে মানুষ। হাজার বছর ধরে খেটে খুটে যা একখানা সমাজ বানিয়েছে, মূর্খতার জাঁকালো উৎসবই চলে প্রতিদিন। সমাজের চেহারা চরিত্র দেখলে মনে হয়, এগুলো আর কিছু নয়, এক একটা অন্ধকার গুহা। মানুষগুলো চোখ কান বন্ধ করে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গুহা থেকে বেরোচ্ছে না, চোখে আলো লাগবে এই ভয়ে আলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।
(২০১৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা যাওয়ার পর ‘লিঙ্গসূত্র’ লিখেছিলাম। লেখাটির কিছু অংশ ছাপা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়।। এখানে আনকাট ভারশানটা প্রকাশ হলো।–স,সু,বার্তা)