জাহান্নামের আগুনে পুড়ে দেখি ইবলিশের হাসি
পীর হাবিবুর রহমান- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘সকালে ঘুম ভাঙার পর আগে জায়নামাজ খুঁজি। নামাজ পড়ি। তারপর কোরআন তিলাওয়াত করি। সকালের নিজের চা-টা নিজে বানিয়ে খাই। আমার ছোট বোন রেহানা আছে। যে আগে ওঠে, সে চা বানায়। এখন আমার মেয়ে পুতুলও রয়েছে। সেও যদি ঘুম থেকে আগে ওঠে তাহলে সেও চা বানায়। তার আগে নিজের বিছানাটা গুছিয়ে রাখি নিজের হাতে।’ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এখন তো করোনাকালে নামাজ পড়ে, চা খেয়ে বই-টই পড়ার থাকলে পড়ি। আর একটু হাঁটাহাঁটি করি। গণভবনে একটা লেক আছে। সেই লেকের পাশে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরি।’ ‘আমাদের বাবার শিক্ষা, রিকশাওয়ালাকে আপনি করে বলতে হবে। ড্রাইভারকে সাহেব বলতে হবে। বাড়ির কাজের লোকজনকে হুকুম দেওয়া যাবে না। আমরা সেই শিক্ষাই অর্জন করেছি। আমার বাসায় যারা কাজ করে, তাদের কখনো হুকুম দিই না। বলি, আমাকে এটা করে দিতে পারবে? সেই শিক্ষাই জাতির পিতা আমাদের দিয়েছেন।’
আমরা যখন রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে নব্বই-উত্তর গণতন্ত্রের শুরুতেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সংবাদ সংগ্রহে সারা দেশ তাঁর সঙ্গে সফর করি তখনই তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে তাঁর জীবন শুরুর রিপোর্ট করি। বড় কেয়ারিং ছিলেন তিনি সফরসঙ্গীদের বিষয়ে। তিনি সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়েন এবং বই পড়ার প্রবল নেশা রাখেন। কঠোর পরিশ্রমও করতে পারেন। শারীরিকভাবে ফিট, খাবারে পরিমিতিবোধ নিয়ে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড মনিটর করেন। তাঁর ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রমের গতিময়তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষিপ্রগতির জন্য তাঁকে অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সও বলা হয়। যাক, আমি ইতিহাসের রাজকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতি ও শাসন নিয়ে লিখতে আসিনি। সংসদে সরল-সহজ ভাষায় তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আমাকে নস্টালজিক করেছে। তিনি পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে যেমন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান তেমনি একই ধারায় পিতার আদর্শে একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ। ধর্মের রাজনীতি যে ধর্মেরই হোক, মানবজাতিকে প্রতিহিংসার আগুনেই পোড়ায় না, সমাজ-সভ্যতা-মানবিকতাকে বিষাক্ত করে। সংসদে মুজিবকন্যার বক্তব্য আমাকে নস্টালজিক করেছে। আমার কাছে শেখ হাসিনা মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের স্নেহময়ী বড় বোনের প্রতীক।
আমাদের সেই সাদাকালো সময়ে মা-বাবা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে জীবন শুরু করতেন। ভোরের আলোয় কোরআন তিলাওয়াতের সুরে ঘুম ভাঙত। বোনদের কণ্ঠে সুরেলা আওয়াজে ‘ফাবি আইয়্যি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ এখনো কানে বাজে। আমাদেরও ফজর ও মাগরিবের নামাজ আদায় করে পড়তে বসতে হতো। আট ভাইবোনের সংসারে পরিবার ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা গভীরে দিয়েছে। দিয়েছে অসাম্প্রদায়িক পাঠ মননে চেতনায়। স্বশিক্ষিত মা শিখিয়েছেন ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ এমন আদর্শলিপি। মানুষের প্রতি সহানুভূতি, মায়া-মমতা, সততা, আত্মমর্যাদা ও আভিজাত্যের পাঠ পরিবার থেকেই দেওয়া হয়েছে। আবেগ-অনুভূতিপ্রবণ সহজ-সরল জীবনের চিত্তসুখও সেখানেই পাওয়া। তখন যাত্রাপালা, কবিতা, গান, নাটক ব্যাপক হতো। আলেম-ওলামারা ধর্মপ্রচার করতেন। ওয়াজ মাহফিল হতো। ধর্মবিদ্বেষ ছড়াতেন না। একালে ওয়াজ করেন হেলিকপ্টারে চড়ে। মূল্যবান পোশাক, মোটা চাঁদা নেন। ভুলে যান মহানবী থেকে খলিফাদের সাধারণ জীবন। সবখানে লোভের আগ্রাসন।
সে সময়টা আদর্শিক রাজনীতির স্বর্ণযুগ। হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান মিলে আমাদের পাড়া থেকে শহরে এক আত্মিক সম্পর্কে জড়ানো ছিল। যিনি যে দল করেছেন কেউ তাকে দুর্নীতিবাজ, অপকর্ম, অপরাধের প্রশ্রয়দাতা বলেনি। পরিবারের বন্ধন হয়ে সামাজিক বন্ধন বড় শক্তিশালী ছিল। সমাজের শিক্ষাও অভিন্ন ছিল। সেই সহজ-সরল সাদামাটা নিরাভরণ জীবনের আদর্শিক পরিবার, সমাজ, রাজনীতি সারা দেশেই বহমান ছিল। সেনাশাসকরা অস্ত্র অর্থ পেশিশক্তির দখলদারি রাজনীতি চালু করলেও আদর্শিক শক্তিতেই সে শক্তি মোকাবিলা করা হয়েছে। অর্থ আর অস্ত্রই যদি রাজনীতির শক্তি হতো তাহলে আজ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমন করুণ দশা হতো না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যেসব ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসকে অস্ত্র ও পেশিশক্তিতে দাবড়িয়ে রাখত তাদের রাজনৈতিক দাফন কবে হয়ে গেছে। সশস্ত্র রাজনীতির রগকাটা শিবির এখন কোন গর্তে? রাজনীতি আদর্শ সৎ সাহসী নেতা সংগঠক ও জনগণের শক্তির ওপরই দাঁড়ায়। সে আদর্শিক রাজনীতির যৌবনকালটাতে রাজনৈতিক বাণিজ্য ছিল না। রাজনীতিবিদরা সাদামাটা জীবনে চলতেন। শুভাকাক্সক্ষীরা সহযোগিতা করতেন নির্বাচনে ও রাজনীতি চালাতে। অনেকে ভিটেমাটি বেচতেন। সব পেশার মানুষ, প্রশাসনসহ বাড়াবাড়ি করতেন না। মানুষের সম্মান সবার জন্য ছিল। এখন যেন এসব মিথ।
সে সময় জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে আদর্শিক জননেতা থেকে ছাত্রনেতারা ছিলেন আইডল। একজন জাতীয় বা কেন্দ্রীয় নেতা এলে জনসভায় সব দলের মানুষ যেত বক্তৃতা শোনতে। রসবোধ মানুষের কথা আর সরকারের সমালোচনা হতো। এখন চিৎকার হয়। অর্থবিত্তের অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই, ছিল পড়াশোনা ও জ্ঞান আহরণের তাগিদ ও নেশা। শিক্ষক লেখক সাংবাদিক সাহিত্যিকরা ছিলেন সমাজের বাতিঘর। সংবাদপত্র ও বইবিহীন বাড়ি ছিল না বললেই চলে। সবার বিনয়ী আচরণ আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর। জীবন জৌলুসের চেয়ে চিত্তের আনন্দে ছিল ভরপুর। কার কত টাকা, কার কত সম্পদ, কার কত বড় প্রাসাদ এসব হিসাবে ছিল না। ক্ষমতার দম্ভ কখনো কোথাও দেখা যায়নি।
আজ সব বদলে গেছে। তখন ঘুষখোর, থানার দালাল, মিথ্যুক, টাউট বাটপাড়রা সমাজে ছিল অবহেলিত, ঘৃণিত। সমাজ এড়িয়ে চলত। উকিল মোক্তার শিক্ষকরাই বেশি ছিলেন নির্লোভ চরিত্রে রাজনীতির নেতৃত্বে। সেই মুগ্ধতায় ভরা একটা অসহ্য সুন্দর সমাজে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। আজ অসহ্য কুৎসিত দয়ামায়াহীন লোভ হিংসা-বিদ্বেষে ভরা একটা অপরাধপ্রবণ কলুষিত বিকৃত সমাজে বসবাস। সেই অসহ্য সুন্দরকালে পৃথিবীজুড়েই নয়, আমাদের দেশ ও সমাজে সামনে-পেছনে চারদিকে তাকালেই আইডল দেখতাম। আমরা এতটা লোভের বিষে বিষাক্ত ছিলাম না। হিংসা-প্রতিহিংসায় আক্রান্ত ছিলাম না। এমন স্বপ্নহীন জীবন কখনো দেখিনি। লোভ, সন্দেহ অবিশ্বাস রক্তে মাংসে অস্থিমজ্জায় ছিল না। এমন করে দুর্নীতিকে কখনো ভালোবাসিনি। ঘুষকে দিইনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। রাজনৈতিক বাণিজ্য বলে শব্দ ছিল না। রাজনীতি মানেই আদর্শ, মানবকল্যাণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নেতা মানেই সাহসী নীতিমান। চরিত্রবান। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ থেকে সরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তা, লুটেরা ঠিকাদার, সমাজে দুর্বল, ঘৃণিত ছিল।
এখন সৎ নির্লোভ নেতা-কর্মীরা, বিনয়ী ভদ্র রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা। যোগ্যতাই তাদের অযোগ্যতা, ভদ্রতা রুচি শিক্ষাই দুর্বলতা। এরা আজ সমাজে বিদ্রƒপ উপহাসের পাত্র। দুর্নীতি করতেও যোগ্যতা লাগে- এমন নির্লজ্জ অহংকারে নষ্টদের মিছিলে লোভে ভাসে সমাজে তথাকথিত শিক্ষিতরা। যে যত দুর্নীতিবাজ, যে যত মিথ্যুক, চাপাবাজ, আমিত্বের অহংকারে অন্ধ, লোভী, প্রতারক, যৌনবিকৃত সেসব নর-নারী একালের সমাজে প্রবল দাপটে। পরিবার, সমাজ লোকলজ্জার ভয় যার নেই তারাই প্রতাপশালী। কমিশন খায়, হোন্ডা-গুন্ডা পোষে সে-ই শক্তিমান দাপুটে নেতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী ও মানুষ সৎ হলেও ওদের কাছে অসহায়। বিতর্কিত নষ্টরাই এখন ক্ষমতাধর প্রতিপত্তিশালী। সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করা মধ্যবিত্তের একাংশ লোভে তলিয়ে গেছে। আরেক অংশ টিকে থাকার লড়াইয়ে। হাতে হাতে স্মার্টফোন, সন্তানদের বলি না গুগুল সার্চ করে জগদ্বিখ্যাতদের কাহিনি পাঠ কর। ইউটিউব থেকে বিকৃতি নয়, ফেসবুকে সংগ্রহ নয়, জানো বীরদের ইতিহাস। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আল্লাহর তরবারিখ্যাত ইসলামের ইতিহাসের বীর খালিদ বিন ওয়ালিদের গল্প বলি আমাদের জাতীয় বীর বাঘা সিদ্দিকী থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনি কি জানাই?
বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পন্ডিত মর্যাদাবান আলোকিত শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না সেখান থেকে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীরা লোভে গা ভাসাবে না সে গ্যারান্টি কোথায়? দেশের ছাত্ররাজনীতি যেখানে দেউলিয়া সেখানে আদর্শিক কর্মী-নেতার জন্ম হবে? এ অসহ্য ভয়ঙ্কর সমাজে অসংখ্য রাজনীতিবিদ নর-নারীর ড্রইংরুম থেকে খাবার টেবিলে উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু, নেতাজি, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথ কবে কোথায় কী বলেছিলেন তা আসে না। আসে বাণিজ্য, অর্থ, এলাকার নিয়ন্ত্রণ। এমপিদের আসরে ঠিকাদারি, উন্নয়ন কর্মকান্ডে কমিশন, টিআর কাবিখার ভাগ। হাট মাঠ ঘাট। প্রশাসনের কর্তাদেরও তাই। প্রতাপে কাটিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শেষে দেখে এমপি-মন্ত্রীর স্বপ্ন! এভাবেই চলছে দেশ। বেশ্যা ও তার দালালরা এখন ভরদুপুরে ভরা মজলিসের মধ্যমণি।
যৌন নিপীড়ক ও নিপীড়নের শিকার নর-নারী একসঙ্গে হাঁটে লোভের হিসাবে। ব্যক্তিত্বহীন নারী বিগলিত হয় ক্ষমতাবানের ভোগের প্রস্তাবে। নিজের সম্মান মর্যাদা বুঝবে কি, সস্তার কাতারে নামায় স্বার্থে! প্রতিবাদ দূরে থাক ঘৃণাও করতে পারে না। কি বিকৃতি নিয়ে শয্যায় শয্যায়, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে, তদবির বাণিজ্যের রমরমা হাটে। কেউ কাউকে সাহায্য করে না, তদবিরও এখন স্বীকৃত পেশা। আদালতপাড়া থেকে সচিবালয়, মন্ত্রিপাড়া থেকে ন্যাম ভবন, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে দৌড়ায় দালালরা। শিক্ষকের কাছে ছাত্রী, ডাক্তারের চেম্বারে রোগী, ধর্মশালায় হুজুরের কাছে মাসুম বাচ্চারা লালসার শিকার। শিল্প-সাহিত্য কবিতা থিয়েটার সিনেমা এখন আলোচনায় আসে না। প্রচারবিমুখ দলমুক্ত পন্ডিত সাহিত্যিক গবেষক আলোচক সমালোচক খোঁজে না অনুষ্ঠানের চেয়ার। মন্ত্রী ছাড়া কোথাও কোনো অনুষ্ঠানও হয় না। বঙ্গবন্ধু ’৭০ সালের আগে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে অতিথি হননি। বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা হতেন। কি চমৎকার ছিল সেই জ্ঞান আহরণের রাজনীতি ও সমাজের সময়।
অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন হঠাৎ। ভিতরে তরুণ পন্ডিত সৈয়দ আহমদের বক্তব্য শুনতে। হলভর্তি শ্রোতার সারিতে বসে শেরেবাংলা বললেন, শুনেছি ছেলেটি বলে ভালো তাই আমিও চলে এলাম। কেন তার আলোচনা শুনব না? সৈয়দ আহমদ সম্পর্কে শেরেবাংলার শ্যালক ছিলেন। পন্ডিত নেহরুর বোন বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিত তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন মেধা, শিক্ষা বাগ্মিতায়। বিয়ে করতে চাইলে গান্ধী দেননি। ভারতের স্বাধীনতায় আহমদ আমেরিকায় গণজাগরণ ঘটান। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও পক্ষে আসেন। স্বাধীনতার পর নেহরু সৈয়দ আহমদকে মিসরে, বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিতকে রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত করেন। তখন বিজয় লক্ষ্মী প্রায়ই মিসরে চলে যেতেন অবকাশে প্রেমের টানে। প্রেম ও রাজনীতিহীন এ কালে কেউ কারও কথা মন দিয়ে শোনেন না। মন্ত্রী-এমপিরা প্রধান অতিথির আসন ছাড়া যাবেন, ইজ্জতের বিষয়। সংসদে আসতে সবাই পাগল। কার্যপ্রণালি বিধি পড়তেও নারাজ। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে কী বলবেন তাও জানেন না। ছাত্ররাজনীতি করে এসেও সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঠ করেন লিখিত ভাষণ। সংসদ বোঝেন না বাণিজ্য ঠিক বোঝেন। দলের পদবি লাভে জ্যোতিষীর রত্ন মিলে ভাগ্য ফিরে। অর্থবিত্ত সম্পদ অঢেল হয়। এই নষ্ট রাজনীতির সিঁড়িতে তুলে আনা হয় পাপিয়া, সাহেদ, লুপা সহস্রজোড়া মুখ। সবখানে ঠাঁই হয় সমাদরে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পবিত্র পোশাক সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে মুজিবকোট পরে হাঁটে প্রতারক অভিযানে। দলও উপকমিটিতে ঠাঁই দেয়। বিএনপির শাসনে হাওয়া ভবনসহ নানাখানে যারা কামান তাদের টাকা কাজে লাগেনি খালেদা জিয়ার দুঃসময়ে। আজকের ব্যাংক ডাকাত, অর্থ পাচারকারী দুর্নীতির বরপুত্রদের টাকাও লাগবে না আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে। জেনারেল ওসমানীকেও সাজেদা চৌধুরীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠক করে ধানমন্ডি কমিটির সদস্যপদ নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ’৭০ সালে মনোনয়ন নিতে হয়। সেই ধারায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী থেকে শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ কত যোগ দেন। দলের পদবি পেতেও সময় লাগত। এখন লাগে না। যখন তখন গার্মেন্ট মালিক মনোনয়ন পান, এমনকি দলের ওয়ার্কিং কমিটির নেতা হন প্রেস রিলিজে। যেন সামরিক শাসকদের দলের স্টাইলে ফরমান!
’৭৮-৭৯ সালে মতিয়া চৌধুরী যিনি ষাটের অগ্নিকন্যা ছিলেন তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দলের মধ্যমণি তখন আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ। ’৮১ সালের সম্মেলনেও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হননি মতিয়া। দলে এলে তিন বছর লাগত পদলাভে। ’৭২ সালে দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, আবদুর রাজ্জাক সাংগঠনিক সম্পাদক। তোফায়েল আহমেদ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বকনিষ্ঠ ২৭ নম্বর সদস্য। অথচ আজ আসেন, দেখেন, জয় করেন। আতিক উত্তরের মেয়র। মহিউদ্দিন এমপি। সিদ্দিক সম্পাদক হলেন। তারা ভদ্র-ভালো মানুষ। কিন্তু দলের কবে সদস্য? দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী তারাই, যারা দেশে বিশাল বিনিয়োগ করেন। উৎপাদন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। তাদের কতটা পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়? অর্থ পাচারকারী ব্যাংক লুটেরা দেশের শত্রু। এদের কেন ধরা হয় না? দুদক বোয়াল ধরে না, পুঁটি মাছ নিয়ে খেলে। এভাবে অর্থনীতি বাঁচে? অর্থ পাচারকারীদের ধরতেই হবে। ব্যাংক ডাকাতদের ধরতেই হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে।
এই আওয়ামী লীগই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর রক্ত দেওয়া দল। কত নেতা মহাদুঃসময়ে সারা দেশে জন্ম নিল তারা না দলের পদে; না সংসদে না সরকারে। কেন? দেশে এ দল ছাড়া কোনো আদর্শিক গণমুখী দল নেই। এই দলের জনপ্রিয়তা রাখতে হবে। ভুলের সংশোধন অনিবার্য। কাল বিরোধী দলে গেলে আন্দোলন-কর্মসূচিতে কি সিদ্দিক ফার্মগেটে মতিয়ার মতো, মহিউদ্দিন রাসেল স্কয়ারে সামাদ আজাদ-নাসিমের মতো, আতিক তোফায়েলের মতো, মহাখালী থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে প্রতিরোধ গড়বেন?
১৯৭৫ সালের কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনকবলিত আমাদের রাজনীতি ও সমাজে দিন দিন সব নীতি আদর্শ মূল্যবোধ নির্বাসিত। সামরিক শাসনকে দায়ী করা হলেও গণতন্ত্রের বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিও আর সেই আদর্শিক মূল্যবোধের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে পারেননি। রাজনীতিবিদরা কি আদর্শিক নেতা-কর্মী তৈরি, লালন ও নেতৃত্ব তৈরিতে অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছেন? করেননি। অনেকেই ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি কর্তৃত্ব রাখতে গিয়েই হোক আর নানা কারণেই হোক নিজের লোক প্রতিষ্ঠায় আদর্শিক কর্মীদের কোরবানি দিয়েছেন। অর্থবানদের দলে টেনেছেন। গণতন্ত্রের জমানায় ছাত্ররাজনীতির মৃত্যু ঘটেছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বেও নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করেছেন। ’৯১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আদর্শিকদের ধরে রাখে। ’৯৬ সালেও অনেকটাই। তারপর বিশেষ করে গত এক যুগের শাসনে ক্ষমতার দম্ভে কি ভুল করছে না? ’৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের রাজনীতি প্রশংসনীয়। গ্রহণযোগ্য। তারপর সর্বনাশ!
বালিশ, পর্দাসহ সরকারি কর্মচারীদের কত লুট! পুকুর খনন থেকে গাড়ি দর্শনে বিদেশ যাত্রা। এখন শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার শিখতে বিদেশ যাবেন। ফাতরামির পর্যায়ে লুটপাট। সব সেক্টরে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। সরকারি আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কর্মচারী ছাড়া কখনো কোথাও দুর্নীতি সম্ভব না। একটা আদর্শহীন মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ে পতিত দেশ ও নষ্ট সমাজে আজ, আমাদের জাহান্নামের আগুনে পুড়ে দেখতে হয় ইবলিশের হাসি! শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি থিয়েটার চিত্রকর্ম, কবি ও কবিতা- এক কথায় সাহিত্য ও তার রসবোধ আসে না আড্ডার আসরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা নেই, পন্ডিত মর্যাদাবান শিক্ষকের আকাল, আছে সব পেশায় দলকানা দলদাস। রাজনীতি সে তো কারও বিনিয়োগ কারও বিনা বিনিয়োগে লাভ আর লাভ, হাত দিলেই ফলে সোনা। আমরা কেউ কোথাও দাঁড়াচ্ছি না, সরবে বলছি না আমাদের সেই আদর্শিক রাজনীতি, সেই মানবিক সমাজ ফিরিয়ে দাও। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বলেছেন, তিনি একজন মুসলমান তবে রাজনীতিতে সেক্যুলার। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেশি ধর্মচর্চা করেন। কিন্তু রাজনীতিটা অসাম্প্রদায়িক। দলটি চরিত্র অনেক হারালেও মুক্তিযুদ্ধ ও সেক্যুলার রাজনীতিটা এখনো হারায়নি। আওয়ামী লীগকেই আজ দেশ ও সমাজকে সেই অসহ্য সুন্দর সময়ের আদর্শিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে ব্যবসায়ী-আমলাদের রুখতে হবে। জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ইউএনওদের দেহরক্ষী, বাড়িতে আনসার বসাতে হয়। আদর্শের সমাজ-রাজনীতি ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।