মুহাম্মদ আবদুল হাই ও তার কাব্য “উতলা বাতাসে”-মু. আবদুর রহীম
মু.আবদুর রহীম-আঁকা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধান ক্ষেত বিধৃত, হাওর-বিলখচিত, নদীনালা বিধৌত মনোহরিনী সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক রূপচ্ছবি যুগে এখানকার মানুষকে করেছে ভাবে উতলা, দিয়েছে তার চোখে অতীন্দ্রিয় জগতের হাতছানি, কন্ঠে মরমী গানের সুর। এমনি এক মায়াবী পরিবেশের স্বাভাবিক সৃষ্টি মরমী লোক কবি ঊনিশ শতকের হাসন রাজা- রাধারমণ আর বিশ শতকের দুরবিন শাহ ও শাহ আব্দুল করিম। এরই ধারাবাহী আরো অনেক কবি সাহিত্যিকের পদচারণায় সুনামগঞ্জের সাহিত্যাঙ্গন নিকট অতীতেও ধন্য হয়েছে। এ কাতারের এক বিশিষ্ট কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হলেন মুহাম্মদ আবদুল হাই।
আবদুল হাই ১৯২৭ সালে ২৩শে মে সুনামগঞ্জের আরপিননগর মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সামাদ তালুকদার আর মাতার নাম জহুরুন্নেসা চৌধুরী। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় তিনি তৎকালীন আসাম প্রদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন এবং ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর সরকার বিরোধী রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার জন্য কলেজের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাঁকে কারাগারে থেকে বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি ডিস্টিংশন লাভ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। অল্প বয়সেই যখন তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ফলে আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। এতদসত্তে¡ও সংকীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতামুক্ত থেকে তিনি Plain living and high thinking এর আদর্শে জীবন যাপন করেছেন। দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণী কবি সাহিত্যিকদের লিখিত বই পুস্তকের নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে তিনি বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। তার জ্ঞানদীপ্ত উন্নত মন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাবেদ্ প্রায় ৫১/৫২ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমণ করেন। তাঁর এই স্বল্প পরিসর জীবনে তিনি সাহিত্যচর্চা, পাঠাগার পরিচালনা, সভা-সমিতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন, নাটকের ব্যবস্থাপনা ও নাট্যাভিনয়ে অংশগ্রহণ, পাক্ষিক সুরমা, সাপ্তাহিক দেশের দাবী, সাপ্তাহিক সূর্যের দেশ ইত্যাদি পত্রিকা সম্পাদনা, সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় কাজ করা, রাজা জিসি হাই স্কুলের শিক্ষক বন্ধুবর আব্দুর রহমান চৌধুরীর সাথে পাণ্ডুলিপি পত্রিকা ‘প্রতিচ্ছবি’ সম্পাদনা আবদুর রহমান চৌধুরী ও আমার (বর্তমান প্রবন্ধের লেখকের) সাথে মিলে ‘ভাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ শীর্ষক ব্যঙ্গ কবিতা (বিদ্রোহী কবি নজরুলের কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতার প্যারোডি) লেখা, জয়কলস-উজানীগাঁও হাইস্কুল ও এইচ,এম,পি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদগ্রহণ করে ঐ দুই হাইস্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে মূল্যবান অবদান রাখা, সুনামগঞ্জে অন্তত তিনবার হাসনরাজা সাহিত্য উৎসব আয়োজনে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করা, সুনামগঞ্জ আর্ট কাউন্সিলের সম্পাদক ও পাবলিক লাইব্রেরীর যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এবং ভাষা আন্দোলনে সুনামগঞ্জের ছাত্র জনতার নেতৃত্ব দানসহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মত আরো অনেক কাজে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে মননশীলতা, ত্যাগ ও সমাজসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
পাকিস্তান আমলে সুনামগঞ্জের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির অঙ্গনে আবদুল হাই ছিলেন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কারণে ঐ সকল অনুষ্ঠানাদিতে আমারও কিছু ভূমিকা থাকত। ঐ সুবাদেই আবদুল হাই এর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ হয়। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সদালাপী, সুরসিক, বিদগ্ধ, বন্ধু বৎসল, অমায়িক ও অতিথিপরায়ণ আবদুল হাই অতি সহজেই সকলকে কাছে টানতে পারতেন। ফলশ্রুতিতে সুনামগঞ্জের ছাত্র শিক্ষক সুধীজনসহ সকলেরই তিনি প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন।
আবদুল হাই-এর অন্তরের গভীরে লুক্কায়িত ছিলো এক উঁচুমানের জাত মরমী কবি। তাঁর বহু বিস্তৃত বিচরণক্ষেত্রের শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গল্প প্রবন্ধ কবিতা লেখেছেন, লেখেছেন চারটি বই- ‘উদাস, হাসন রাজা কথা,’ ‘দর্শনের দর্শন’ হয়তো পাণ্ডুলিপি আকারে ছিলো, ‘উদাস হাসন রাজার কথা’ বই এর মুদ্রন অনেকটুকু এগিয়েছিলো- আমি তার মুদ্রিত অংশের কিছুটা দেখেছি। এ বই দু’খানির কোন অস্তিত্ব এখন আছে বলে আমি জানি না। বাকি দুটি প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে যেটি (ছিন্ন অবস্থায়) আমার কাছে আছে তার নাম ‘উতলা বাতাসে’। বইখানিতে আবদুল হাই-এর গভীর মরমী কবিসত্তার পরিচয় মেলে। বইখানির শুরুতে হাসন রাজা ও লাউড় তাপস প্রসন্নাচার্যের উদ্দেশ্যে দু’টি কবিতা নিবেদিত হয়েছে। বইখানি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘কবি সাহিত্যিক খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী সাহেবের পবিত্র স্মৃতি স্বরণে।’ বইখানির গর্ভে প্রথমেই স্থান পেয়েছে লেখকের কথা, তারপর একটি হামদ ও একটি নাত। হামদ ও নাতে লেখকের আল্লাহ-রাসূল-প্রেম ফুটে উঠেছে। এরপর বইটিতে স্থান পেয়েছে বিয়ালিশটি মরমী গান। বই এর শেষ পাতায় সৈয়দ মুর্তাজা আলী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ভূষণ রায় ও আমার অভিমত ছাপা হয়েছে। এ গুলোর মধ্যে আমার অভিমতটি প্রাসঙ্গিক বলে হুবহু এখানে উদ্ধৃত করছি: ‘আঙ্গিকে আধুনিক, ভাবে মরমী ‘উতলা বাতাসে’ কবি হাছন পছন্দ এর এক সার্থক সাহিত্য শিল্প।
প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্র্য তাঁর কবি মানসে অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে। রূপের মাঝে অপরূপের হাতছানি কবিকে আত্মহারা করে তোলে। ক্রমে সেই অপরূপই প্রেমাস্তদরূপে তাঁকে হাসায় কাদায়, বিরহ মিলনের তিক্ত মধুর খেলায় তাঁকে মাতায়।
‘উতলা বাতাসে’র গানে এ খেলায় বিচিত্র রূপ বিধৃত।’ কবি বিশ্বপ্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর উৎস সন্ধান করেছেন, আবিস্কার করেছেন তাঁর প্রেমাস্পদকে। বিস্মিত পুলকে তার অপরূপ রূপের বানে আহত হয়ে গেয়েছেন-
হলুদ পাখির গায়ে
এত রঙ তুমি মেখেছো
শাপলা ফুলের বুকে-কত লাল তুসি এঁকোছো।
হিজলের শিমুলের ফুলভারে অবনত
শাখায় শাখায়-
কতনা রঙের ছোপ মেখে তুমি
বসে রয়েছো।
এমনি কাহার প্রাণ আন মনে
তুমি কেড়েছো।
কবি তার ডাক শুনছেন, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন না। তাই নগরীর লোকের কাছে তার খোঁজ নিচ্ছেন:
কে ডাকে আমায়।
বলো গো নগরীর লোক
তোমরা কি দেখেছো তায় \
দোয়েল কেনো নীরব দাও খবর তুমিমোরে
পরাণ সখা আমায় বলো আরও কত দূরে
বেতসবন পাতা নেড়ে দেখিয়ে দাও সে কোথায়
কবি অস্থির উন্মন হয়ে তাকে কাছে পেতে চেয়েছেন- কিন্তু সে যে নিষ্ঠুর:-
ছল করে শুধু কাঁদায়, ধরা দেয় না
এমন সাজানো বাসরে তুমি নাই
বধু ও শুনো গো কোথা যে তুমি আছো
তোমারে খুঁজিয়া না পাই ।
বুকের আশার সমাধি উপরে কি
কুসুম সাজাতে আসিবে তুমি শেষে
তোমার মনে কি এ আশা
নয়নপথে যে আসিয়া ফিরে যাও
নয়ন ধরিতে পারে না তোমা তাই
পলকে পলকে হারাই ।
বহু আশায় বুক বেঁধে তিনি তাকে মনে প্রাণে পেতে চান:
সুন্দরী বধুয়া ওগো এসো মন মন্দিরে
বাহির দোয়ার খোলা কেহ নাই অন্দরে ।
সন্ধ্যা বনে যত ফুল ফুটিছে
দেখি যেন তব পায়ে লুটিছে
ফাল্গুন বায়ে বেনী দুলায়ে
এসো হে বধুয়া ওগো এসো মন কন্দরে।
কত নিশি গেলো জাগি বিফলে
জোসনার ধারা গেলো অতলে
আমারাতে আজি এসো আঁধারে
পোহাব রজনী কতো পথ চেয়ে কাতরে।
তিনি কেঁদে কেঁদে অস্থির মনে নিরাশার মাঝেও আশার প্রদীপ জ্বেলে তাকে খুঁজতে থাকেন :
নিরাশ রজনী আজো বসিয়া রবে না
হৃদয় যাতনা আর সহে না সহে না ।
ব্যাকুল ফুলপাতা ঝুরিছে শিশিরে
ডাহুকী বিরহিনী ডাকে ঝোপে ঝাড়ে
মগন ঝিঁ ঝিঁ কাঁদে সুরের মাতনে
আমি আকূল শূন্যে যারে খুঁজি সে আসে না ।
বিরহী কবি তাকে না পেয়ে শোকের আগুনে জ্বলতে থাকেন। এ জ্বালা নিবারণের জন্য তাকে কাছে ডাকছেন :
আগুনে দহন সেই থেকে জ্বলে
খুঁজিতেছি তোমা প্রিয়
দরশন বিনা জ্বালায় জ্বলিছে
অঙ্গার তাপিত হিয়া
এসো কাছে এসো, থেকোনা আর অলখে।
কবির ঐকান্তিক আশার এক পর্যায়ে মনে হয়, এ বুঝি সে এলো।
তিনি ক্ষণিকের তরে খুশী হয়ে ওঠেন:
পূর্ণিমার চন্দ্রে
দেখিলাম তুমি যে
ঢল ঢল মাধুরী
স্নিগ্ধতা ছড়ালে।
অগণিত তারকা
ঝিকিমিকি মাতনে
উল্লাসে নাচিছে
রাত্রির সভাতে
তারা সব সাথের
সহচরী তোমার
হাসিমুখে তুমিও
মোর পানে তাকালে।
কবি বুঝতে পারেন, এ-যে সেই নিষ্ঠুর প্রেমাস্পদের চলনা মাত্র। কবির আশা বার বার দোল খায়, কিন্তু তিনি প্রাণপণে আশাকে আঁকড়ে ধরেন :
তোমাতে সঁপিয়া জীবন এ হিয়া
ভূল কিছু হয়নি জানি গো।
তোমাতে ভরসা
এ নয় তুমি কেনো আসো আর কেনো যাও চলে
আমারে ভাসাও কেনো নয়নের জলে।
আমি পথ চেয়ে চেয়ে তোমার আশাতে
মন রাখি ছেয়ে কতো কথার মালাতে
বলিতে পারি না কথা ফিরে দেখা হলে।
ফুল শাখা ধরে রাখে মনে ফুলআশা
একদিন ফুল ফুটে, ফুটে তার ভাষা
না বলা কথাটি মোর রবে কি অতলে ।
কেঁদে কেঁদে বহে নদী ছুটে কি আশায়
কি সুরের চোখের জল সাগরে মিশায়
আমার মানব নদী যাবে কি বিফলে ।
সহসা চিরদিন করেছি আমি গো ।
আবার গভীর নৈরাশ্য কবিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তীব্র অভিমানে তিনি প্রেমাস্পদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারেন। ক্রমে তাঁর অভিমান আরো শান্তি হয়ে ওঠে। তীক্ষè কথার আঘাতে প্রেমাস্পদকে জর্জরিত করে তুলেন:
আমার মনের ঢেউ
তোমার মনের গভীরে তো
ওগো দেয়না দোলা,
সে যে এক অশান্ত সাগরের ঢেউ
আর তুমি বেলাভূমি অচলা ।
তিনি অভিমান ভরে প্রাণ বিসর্জন দিতে চান :
কালার বাঁশীর সুর কে বলে মধুর
সে যে আগুনের সন্তাপ বেদনা বিধুর।
চমকিয়া ঘুম হতে জাগিয়া উঠি গো
কোন দিক হতে সুর ভাসিয়া আসে গো
কোন বনে বসে ডাকে শ্যাম মন চোর
আর কত দিন মোরে রাখিবে বিভোর।
পরাণ সঁপিয়া চাই তাহার চরণ
কী কাজ রাখিয়া এই অসার জীবন
বলো সখি তাকে যদি থাকে দূর
কালিন্দীজলে ডুবে যাব যমপুর ।
আরেকবার কবির আশা জাগে সে বুঝি ঐ এলো। তাই তাঁকে (কবিকে) সাজাবার জন্য সখিকে বলেন:
চন্দন কুম কুম আনো সখি আনো
বুধুয়ার মনোমত সাজিব সাজন।
ফুল আনো সাজি ভরি
ধুপ জ্বালো ঘটা করি
বাসর সাজাও সখি করিয়া যতন।
পেটিকায় ছিলো তোলা
নীল শাড়ি দেখো খোলা
পরাও আমারে বয়ে যায় যে লগন।
পায়ে দাও এই মন রুমঝুম
ঝলমলবিনুনী বাঁদিয়া দাও
নাগিনী যেমন।
এইত কাজল, তোলা চোখ তীর মিশ কালো
কানুকে বিধিলো রাধা এই তীরে জোনো ।
কবিকে বুঝতে পারেন, এভাবে তার চিরকামনার ধন প্রেমাস্পদকে পাওয়া যাবে না। অন্তরের ধন সব উজার করে তাকে সমর্পণ করতে হবে, নিজের আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে তার চরণপ্রার্থী হতে হবে:
তুমি ছাড়া আমি
যেনো এক তরু
শুষ্ক চৈত্র মাঠে
হৃত পল্লব হতাশ ।
আমি চাই ওগো
তোমাকে আজিকে
চাঁদ সুধা নিশি রাতে
আমার বাহু সিথানে,
তুমি ছাড়া জেনো
নিভে যাবে মোর
জীবনের দীপ তাই
আসো হে না করে নিরাশ।
কবির সন্দেহ তবু ঘুচে না। বিরহের জ্বালায় উচাটন হয়ে সজনীকে ডেকে মনের কথা বলেন :
সজনী,
আসিবে সে কি বলো
হৃদয় মন্দিরে
উথলি উঠে ঢেউ
মানস সরোবরে ।
শেষে কবি সকল লজ্জা অভিমান ছেড়ে কাতর কণ্ঠে তাকে আত্মহনন করেন:
সুন্দরী বধুয়া ওগো এসো মন মন্দিরে,
বাহির দোয়ার খোলা কেহ নাই অন্দরে।
প্রেমাস্পদের মন গলে যায়।
সে তাঁকে মধুর ভাষায় সম্ভাষণ করে।কবির বর্ণনায়:
আমার হাতে
তোমার হাতটি রেখে শুধালে,
অচেনা ওগো
পথিক এতোদিন কোথা ছিলে,
এসো আমার কুঞ্জে নদীর কিনারে।
কবির আন্তরিক কামনা ব্যর্থ হয় না। নিদারুণ প্রেমাস্পদ একদিন এসে তাকে ধরা দেয়:
অজানিতে নিশিরাতে
এলে মোর অঙ্গনে
কি দিয়ে সাজাবো বলো বাসর সাজ।
জীর্ণ আমার ঘরে
ছিন্ন এ শয্যায়
কেমনে বসাবো, কোথা লুকাবো লাজ।
তোমারে যে দোবো মালা
অবকাশ কোথা তার
নাই কোন ফুল দেখি পথের ধারে।
চন্দন টিপ আর
ধূপের সৌরভ
কিছু নাই ঘরে, ওগো সাজাতে সাজ ।
মনপোড়া ধূপ আছে
মালা আছে দু’হাতের
অশ্রুর টিপ, আসো মুখেতে মাখি।
তাপিত হিয়ায় বসো
জুড়াক হৃদয় জ্বালা
চোখে চোখ রাখা হোক দুয়ের কাজ।
সফলতার আনন্দে কবি উদ্বেলিত হন। প্রচন্ড উলাসে তিনি গেয়ে উঠেন:
দরোজার পরদা সেই সরিলো
দেখিলাম অপরূপ তাহার মুখ গো ।
বাহু পাশে আমারে সে যে বাঁধিলো
পাইলাম প্রতীক্ষিত মিলন সুখ গো ।
হাতে ধরি সহাসে পথে চলিলো
হতবাক নগরীর যতেক লোক গো ।
কবি আবদুল হাই এর ‘উতলা বাতাসে’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আজ মনে পড়ছে- এ বইটির পান্ডুলিপি তৈরী করে আবদুল হাই হঠাৎ একদিন আমার ষোলঘরস্থ বাসায় এসে হাজির হন। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর খুশী মনে তাঁকে নিয়ে ঘরে বসালাম। কোন ভূমিকা না করেই তিনি বললেন- আমার লেখা সুনামগঞ্জ শুধু আপনাকে আর রামেন্দু ভূষণ রায়কে দেখাই। বুঝলাম বই এর পাণ্ডুলিপি দেখতে হবে। চা পানের পর দুজন বই নিয়ে বসলাম। লেখকের কলম চালনায় বাহাদুরী আছে। অনেকক্ষণ আরাপ আলোচনা ও গল্প করে বই এর পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করা হলো। ততক্ষণে দুপুরের খানার সময় হয়ে গেছে। সাদামাটাভাবে খানার পর্ব শেষ হলো। আবদুল হাই সালাম জানিয়ে বিদায় নিলেন। তার যাওয়ার সময় মনে মনে বললাম- ‘একজন মরমী কবিকে বিদায় দিচ্ছি।’ আজ আবদুল হাই আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু সুনামগঞ্জের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘উতলা বাতাসে’ আবদুল হাইকে চিরকালীন মরমী কবিদের সারিতে আসীন করে দিয়েছে। মরমী কবি হাসন রাজাকে নিয়ে তিনি প্রচুর গবেষণা করেছেন, হাসন রাজাকে ভালবেসে নিজে হাছন পছন্দ নাম গ্রহণ করেছেন। ‘উতলা বাতাসে’ হাছন পছন্দের নামে প্রকাশিত হয়ে এক দূর প্রসারী গভীর তাৎপর্য লাভ করেছে। বইটি সুনামগঞ্জেরতো বটেই, বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যেরও এক উল্লেখযোগ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ভাবের গভীরতা ও সামঞ্জস্য, সার্থক শব্দযোজনা এবং চমৎকার উপমা অলংকারে বইটি উচ্চ মর্যার দাবী রাখে। কিন্তু দঃখের বিষয়, বইটি বাজারে অথবা পাঠাগারে পাওয়া যায় বলে আমি জানি না। সুনামগঞ্জের কোন সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমী সদাশয় ব্যক্তি বা সংস্থা বইটির এক নতুন সংস্করণ প্রকাশে এগিয়ে এলে ধন্যবাদের পাত্র হবেন, সন্দেহ নেই।