হাছন পছন্দঃ আব্দুল হাই-মো. আব্দুল আজিজ
অধ্যাপক মো. আব্দুল আজিজ-গত পঞ্চাশ দশকে সিলেটের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠে কয়েকজন প্রগতিশীল তরুণের দৃপ্ত পদচারণায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন, আবার কেউ কেউ অকালেই হারিয়ে গেছেন মহাকালের অমোঘ নিয়মে। মুহাম্মদ আব্দুল হাই শেষোক্ত দলেরই একজন।
সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আব্দুল হাই। স্কুল জীবনেই সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে তার গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে সিলেট শহরে আসেন পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে। সে সময় সিলেট শহর থেকে ‘নওবেলাল’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটির মালিক-সম্পাদক ছিলেন সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলী। সিলেটে এসে আব্দুল হাই ‘নওবেলাল’-এর সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। সম্ভবতঃ এর মাধ্যমেই তার সাংবাদিকতার কাজে হাতেখড়ি। পরবর্তী জীবনে সুনামগঞ্জ থেকে তিনি নিজেও একাধিক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেছেন।
সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’ সেকালে এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল অনবদ্য। আর সে কারণে বদর উদ্দিন উমর তার বহু তথ্যের উৎস হিসেবে ‘নওবেলাল’-এর উপর নির্ভর করেছেন। ‘নওবেলাল’-এ কাজ করতে করতে স্বাভাবিক ভাবেই আব্দুল হাই সমসাময়িক রাজনৈতিক স্রোত ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।
‘নওবেলাল’ সম্পাদক মাহমুদ আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সভাপতি। একটি অসা¤প্রদায়িক ও প্রগতিশীল যুব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৫১ সালে ২৭শে মার্চ যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। যুবলীগের কিছু কর্মী ঐ বছরের শেষার্ধে সিলেটে একটি অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্যোগের সাথে জড়িত ছিলেন তৎকালীন যুবনেতা তারা মিয়া, আসদ্দর আলী, সৈয়দ আকমল হোসেন প্রমুখ। ১৯৫১ সালের ১৬ই নভেম্বর ডাকা হয় সিলেট জেলা ছাত্র সম্মেলন। আব্দুল হাই ছিলেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক। এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক ‘সংবাদ’-এর প্রধান সম্পাদক খায়রুল কবীরের এবং উদ্বোধন করার কথা ছিল অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের।
তৎকালীন পরিবেশে একটি অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াসকে কমিউনিস্ট কারসাজি হিসেবে গণ্য করা হয়। ছাত্র সম্মেলন যাতে না হতে পারে সেজন্য সিলেট শহরে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা এবং তারা মিয়া ও আসাদ্দর আলী যাতে এর সাথে কোন সংস্রব না রাখেন সেজন্য তাদের উপর জারি করা হয় ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা; কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা আইনের চোখকে র্ফাঁকি দিয়ে সদলবলে চলে গেলেন ফেঞ্চুগঞ্জ। স্টেশনের অদূরে পাঠানটুলা মাঠে অনুষ্ঠিত হলো সম্মেলন। নির্ধারিত সভাপতি ও উদ্বোধকের অনুপস্থিতিতে প্রাদেশিক যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ইমাদুলাহ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং উদ্বোধন করেন সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। আব্দুল হাই প্রস্তুতি কমিটির প্রতিবেদন পেশ করার সময় স্থানীয় থানার দারোগা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উপস্থিত হলেন মাঠে। ইমাদুলাহ তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে পড়ে জ্বালাময়ী ভাষায় সভাপতির ভাষণ শুরু করে দিলেন। ভাষণ শেষে দারোগার নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
তখন আছরের নামাজের সময়। সবাই মিলে মাঠে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত হলো। ইমামতির দায়িত্ব পড়লো সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র শামসুল হকের উপর। তাকে বলে দেওয়া হলো মোনাজাতের সময় তিনি যেন সভার প্রস্তাবগুলো উচ্চারণ করে যান। অন্যরা তখন ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলে তাদের সম্মতি জানিয়ে যাবেন। এভাবেই সেদিন সম্মেলনের প্রথম পর্ব শেষ হয়।
সম্মেলনে যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী ছাড়াও অন্যান্য যুব নেতার মধ্যে নূরুর রহমান, পীর হাবিবুর রহমান, এএইচ সা’দত খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তী পর্যায়ে সবাই দল বেঁধে ঢুকে পড়েন এডভোকেট জালাল উদ্দিনের মাঠ সংলগ্ন বাড়িতে। সে বাড়ির বড়সড় বৈঠকখানার এক কোণে বসলো একটা তাৎক্ষণিক গণ সঙ্গীতের আসর। অন্যকোণে চলতে থাকে প্রস্তাবিত ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক কমিটি গঠনের কাজ। এভাবে জন্ম নেয় সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি নতুন অসা¤প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন। এর সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে আব্দুল হাই ও খন্দকার রুহুল কুদ্দুস। সাংবাদিকতার সাথে সাথে আব্দুল হাই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে গেলেন ছাত্র আন্দোলনের সাথে।
উলেখ্য, সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন ছিল পরবর্তীকালের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পূর্বগামী এবং সে প্রতিষ্ঠানের নামটি পর্যন্ত নির্বাচিত হয় সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তারা মিয়ার প্রস্তাব অনুসারে।
আব্দুল হাই তখন মদন মোহন কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র; কিন্তু বিএ পাশ করতে তার অনেকদিন লেগে যায়। এর কারণ মাঝে মাঝে তিনি সুনামগঞ্জ চলে যেতেন এবং একবার গেলে দীর্ঘদিন থাকতেন লাপাত্তা। তখন নাকি তিনি নাটক নিয়ে মেতে থাকতেন।
আব্দুল হাইয়ের লেখার হাতও ছিল চমৎকার; কিন্তু তাকে দিয়ে কিছু লেখানো ছিল শক্ত কাজ। তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুর রহমান চৌধুরীর সাথে মিলে ‘ত্রিভুজ’ ছদ্মনামে গোটা কয়েক চমৎকার প্যারোডি তিনি লিখেছিলেন। চুয়ান্নর নির্বাচনোত্তর কালে নজরুলের ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতার প্যারোডি ‘ভান্ডারী হুশিয়ার’ খুবই আলোচিত হয়েছিল। তার হাতের লেখার ছাঁচটিও খুব সুন্দর।
চুয়ান্ন সালে ৯২ক ধারা জারি হবার পর আব্দুল হাই জেলে গেলেন। বেরিয়ে এলেন এক নতুন মানুষ হয়ে। যদিও তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সিলেট জেলা শাখার সভাপতি; তবুও মনে হলো তার মনোজগতে কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে। শুনেছি জেলে মাহমুদ আলীর সঙ্গে ছিলেন তিনি এবং মাহমুদ আলী তখন খুবই হতাশায় ভুগছিলেন। সে হতাশাই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সহ-রাজবন্দিদের মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত আব্দুল হাই বিএ পাশ করলেন। তারপরে শুরু হলো তার জীবন সংগ্রামের পালা। একাধিক স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন এবং তার গতিশীল নেতৃত্বে স্কুলগুলো স্বল্পকালের মধ্যে যথেষ্ট উন্নতিও করেছে; কিন্তু কেন যেন তিনি কোন স্কুলে বেশিদিন টিকে থাকতে পারতেন না।
শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে তিনি সুনামগঞ্জে প্রেস খুলে বসেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পত্রিকা বের করেছেন। সে পত্রিকা চালিয়ে গেছেন অনেকদিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথেই তিনি সুনামগঞ্জ থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলেন; কিন্তু পরবর্তীকালে আব্দুল হাই এক ভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যান। তিনি তার নাম পাল্টে রাখেন ‘হাছন পছন্দ’। শুনেছি এ নামে না ডাকলে নাকি তিনি রেগে যেতেন। এমনিভাবে এক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যান।
আশির দশকের গোড়ার দিকে আব্দুল হাই পরলোক গমন করেন। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আব্দুল হাইয়ের নাম নতুন প্রজন্মে সম্ভবত: কেউই জানেনা। তার তিরোধানের পর তার এককালের সহকর্মীদের কেউ তাকে তেমনভাবে স্মরণ করেছেন বলেও কোন সংবাদ চোখে পড়েনি। অবশ্য তার কিছুদিন আগে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ এ নামটির প্রস্তাবক তারা মিয়াও অকাল মৃত্যু বরণ করেছেন। আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর অল্পদিন পরে একই পথ অনুসরণ করেছেন সৈযদ আকমল হোসেন।
আমরা তাদের বিদেহী আত্মার অনন্ত শান্তি কামনা করি। পঞ্চাশ দশকের এই ত্রয়ী ছাত্র ও যুবনেতার কর্মপ্রয়াস ও আত্মত্যাগের কাহিনীর সাথে নতুন প্রজন্মের পরিচিতি থাকা প্রয়োজন। আশাকরি এ ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবেন।
অধ্যাপক মো. আব্দুল আজিজ সাবেক অধ্যক্ষ এমসি কলেজ সিলেট, কোষাধ্যক্ষ- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। লেখক ও ভাষা সৈনিক। মুহাম্মদ আব্দুল হাইকে কাছে থেকে দেখেছেন।