মডেল আপন ও রিমিয়া আলোকচিত্র মোহাম্মাদ আসাদ

একসময় ল্যাপটপের বিকল্প হিসেবে উত্থান হয়েছিল ট্যাবলেট পিসি ওরফে ট্যাবের। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশ নজর দিয়েছিল সেসব দিকে। কী অ্যানড্রয়েড, কী আইওএস অপারেটিং সিস্টেম—জনপ্রিয় হয়েছিল বেশ কিছু ট্যাবও। কিন্তু বড় পর্দার স্মার্টফোন এসে ট্যাবকে একপ্রকার হটিয়েই দিল বাজার থেকে। বিশ্বের বাজারেই বা কী অবস্থা ট্যাবের? খোঁজখবর নিয়ে জানাচ্ছেন এস এম তাহমিদ ২০১০ সালে বাজারে এসেছিল বিশ্বের প্রথম আইপ্যাড। তার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল আধুনিক ট্যাবলেটের যুগ। এরপর অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেটের মাধ্যমে পুরোদমে বাড়তে শুরু করে এই বাজার। সঙ্গে যোগ হয় ব্ল্যাকবেরি ও পামওএসচালিত ট্যাবলেট, মাইক্রোসফটও উইন্ডোজচালিত সারফেস ট্যাবলেটের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিল ট্যাবলেটের স্বর্ণযুগ। বছরে ২২ কোটিরও বেশি ইউনিট ট্যাবলেট কিনেছিল ব্যবহারকারীরা। সেই সময় স্মার্টফোনের ডিসপ্লের সাইজ ছিল ৩ থেকে ৪.৫ ইঞ্চি, ৭-৯ ইঞ্চি ডিসপ্লের ট্যাবলেটই ছিল চলার পথে খবর বা বই পড়ার জন্য আদর্শ। এরপর ধীরে ধীরে ফোনের আকৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে, স্যামসাং বাজারে নিয়ে আসতে থাকে গ্যালাক্সি নোট ও মেগা সিরিজের সব ট্যাবলেট। ফোনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে ক্রেতারা, অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেটের বাজার প্রায় শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত টিকে যায় অ্যাপলের আইপ্যাড, মাইক্রোসফটের সারফেস সিরিজ এবং স্যামসাংয়ের অ্যানড্রয়েডকে আমূল বদলে নিজস্ব সংস্করণে তৈরি গ্যালাক্সি ট্যাব।

যেখানে আজ ল্যাপটপের ওজন এক কিলোগ্রামেরও কম, তার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে ১০ ঘণ্টা ব্যাটারি লাইফ ও টাচস্ক্রিন, সেখানে ট্যাবলেট আলাদা করে কেনার প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। বই পড়তে হলে ই-বুক রিডার কেনাই শ্রেয়, আর বাকি কাজের জন্য স্মার্টফোন তো আছেই। ফলে ট্যাবলেট নির্মাতাদের নতুন করে ভাবতে হয়েছে কিভাবে তাদের ডিভাইসগুলো আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। দ্রুতই স্যামসাং এবং পরবর্তী সময়ে মাইক্রোসফট আবিষ্কার করে, ট্যাবলেটের ডিসপ্লেতে স্টাইলাস বা পেন ব্যবহারের সুবিধা দিলে শিল্পীরা তাঁদের ক্যানভাস হিসেবে ট্যাবলেট ব্যবহার করতে পছন্দ করছেন। ফলে জন্ম নেয় গ্যালাক্সি ট্যাব নোট এবং বর্তমানে এস সিরিজ, মাইক্রোসফট সারফেস প্রো সিরিজের জন্য তৈরি করে সারফেস পেন এবং একসময় অ্যাপলও তাদের স্টাইলাস বর্জনের নীতি বাদ দিয়ে অ্যাপল পেন্সিলের ব্যবহার শুরু করে আইপ্যাডে। ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য ডিসপ্লে সাইজ বাড়িয়ে ১০ থেকে ১৩ ইঞ্চি করা হয়, মাইক্রোসফট তৈরি করে ১৫ ইঞ্চি ট্যাবলেট-ল্যাপটপ হাইব্রিড।

তবে শুধু শিল্পীরাই নন, শিশু ও বৃদ্ধদেরও পছন্দ বড়সড় ডিভাইস—সেটা দ্রুতই অ্যামাজন আবিষ্কার করে। যার ফলে তারা বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি শুরু করে তাদের ফায়ার ট্যাবলেট। ছোটখাটো গেম খেলা, শিক্ষামূলক ও কার্টুন ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে ঘরের স্মার্ট ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ এবং পুরো পরিবারের ভিডিও কলের যন্ত্র হিসেবে ফায়ার ট্যাবলেট সবার মনে স্থান করে নেয়। অবশ্য আজ সেই স্থানটির জন্য লেনোভো, গুগল ও নেস্ট মিলে ব্যাটারিহীন, সরাসরি বিদ্যুত্চালিত এবং সব সময়ই চালু ট্যাবলেট ডিভাইস তৈরি শুরু করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট ডিসপ্লে। তবে এ ধরনের ডিভাইসকে ট্যাবলেট না বলে বরং ইন্টারঅ্যাকটিভ টেলিভিশন বলাই শ্রেয়। স্যামসাং এ বাজারের জন্য ‘গ্যালাক্সি ভিও’ নামের একটি ট্যাবলেট তৈরি করেছিল, যার ডিসপ্লে ছিল ২২ ইঞ্চি, যা কি না ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেট। অবশ্য সেটি বাজার ধরতে পারেনি মোটেই। 

তবে এসব ব্যবহারের ফলে ট্যাবলেট বাজার একেবারে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। প্রতিবছর এখনো ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি ইউনিট ট্যাবলেট বিক্রি হয়ে থাকে, যদিও তার মধ্যে অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেটের সংখ্যা বেশ কম আর অর্ধেকের বেশি বাজার আইপ্যাডের দখলে। অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেটের বাজারের বেশির ভাগ দখল করে আছে স্যামসাং, এর পরই আছে লেনোভো এবং তারপর হুয়াওয়ে। সারফেস এবং অন্যান্য উইন্ডোজ ট্যাবলেট ও হাইব্রিডের বাজারও একেবারে মন্দ নয়। অ্যামাজন ফায়ার সিরিজের ট্যাবলেটগুলোর বিক্রি আছে আইপ্যাড ও উইন্ডোজ ট্যাবলেটের মাঝামাঝি।

এ বছরের শুরুতেই বিশ্বের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে কভিড-১৯। প্রতিটি দেশে চলছে লকডাউন, বাসায় বসে কাজ করছেন চাকরিজীবীরা, আর ছাত্র-ছাত্রীদের করতে হচ্ছে অনলাইনে দূরশিক্ষণ। ফলে প্রায় সারা দিনই ভিডিও কলে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সবাইকে, যার জন্য ট্যাবলেট আদর্শ ডিভাইস। ফলে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে ট্যাবলেট বিক্রি। তবে মজার বিষয়, অ্যাপলের বিক্রি আশানুরূপ বাড়েনি। উল্টো অ্যানড্রয়েড ও অ্যামাজন ট্যাবলেট বিক্রি বাড়ার ফলে অ্যাপলের বাজার ৫৬ শতাংশ থেকে ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি বেড়েছে স্যামসাং ও অ্যাপলের, আর তৃতীয় অবস্থানে আছে মাইক্রোসফট এবং অন্য নির্মাতারা।

বিগত বছরগুলোতে ট্যাবলেট বাজারে প্রতিটি নির্মাতার বেশ কয়েক মডেলের ট্যাবলেট পাওয়া গেলেও ধীরে ধীরে বেশির ভাগ কম্পানিই ট্যাবলেট তৈরি থেকে সরে আসায় ক্রেতাদের পছন্দ অনেকটাই কমে গেছে। হুয়াওয়ে, স্যামসাং, লেনোভো ও অ্যামাজনের বাইরে আর তেমন কোনো নির্মাতা অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেট নিয়ে কাজ করছে না। যারা বাজেটের মধ্যে ট্যাবলেট খুঁজছে তাদের জন্য অ্যামাজন ফায়ার ৭, ফায়ার ৮ এইচডি ও ফায়ার ১০ এইচডি হতে পারে আদর্শ। হাইডেফিনিশন ডিসপ্লে, মাঝারি মানের পারফরম্যান্স এবং মাত্র চার হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু এই ট্যাবলেটগুলো শিশুদের জন্যও উপযোগী। কেননা প্লাস্টিক বডির এই ডিভাইসগুলো সহজে ভাঙার আশঙ্কা নেই, আবার দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেলেও বড় ক্ষতি হবে না। সমস্যা দুটি। প্রথমত, অ্যামাজন ট্যাবলেট দেশে সরাসরি বিক্রি হয় না এবং পাওয়া দুষ্কর। আর দ্বিতীয় সমস্যা, ট্যাবলেটগুলোতে গুগল প্লেস্টোর নেই। অ্যামাজন অ্যাপ স্টোরে থাকা অ্যাপের মধ্যেই ডিভাইসগুলো সীমাবদ্ধ।

স্যামসাং গ্যালাক্সি ট্যাব এস৬ লাইট ও ট্যাব এ হতে পারে বাজেট ক্রেতাদের জন্য আদর্শ। ট্যাবলেটগুলোর মূল্য ১২ হাজার টাকা থেকে শুরু, হাইডেফিনিশন ডিসপ্লে এবং কোয়াডকোর প্রসেসরসমৃদ্ধ ডিভাইসগুলো ভিডিও কল এবং ই-বুক ও ডকুমেন্ট পড়ার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ডিভাইসগুলোর মধ্যে গুগল প্লেুেস্টার আছে এবং বাংলাদেশের বাজারে সহজেই পাওয়া সম্ভব। তবে গেম খেলা বা কোনো ধরনের ভারী কাজ করার জন্য ট্যাবলেটগুলো একেবারেই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে ট্যাব এ মডেলটিতে ১০৮০পি ডিসপ্লেও দেওয়া হয়নি, তাই ফুল এইচডি ভিডিও দেখেও মজা পাওয়া কষ্টকর।

ট্যাবলেটের বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেলগুলোর মূল্য নেহাত কম নয়। অ্যাপলের সপ্তম ও অষ্টম প্রজন্মের আইপ্যাড, তৃতীয় প্রজন্মের আইপ্যাড এয়ার ও আইপ্যাড প্রো মডেলগুলো এখনো ট্যাবলেটের বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয়, এর পরই আছে গ্যালাক্সি ট্যাব এস৭ এবং এস৭ প্লাস এবং মাইক্রোসফটের আছে সপ্তম প্রজন্মের সারফেস প্রো ও সারফেসবুক। প্রতিটি ট্যাবলেটের মূল্য ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রতিটি ট্যাবলেটের ফিচার বাজেট ট্যাবলেটের চেয়ে অনেক এগিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে এ ট্যাবলেটগুলো দিয়ে ল্যাপটপের কাজ সহজেই চালানো সম্ভব।

আইপ্যাডের ক্ষেত্রে আইপ্যাডওএস অন্য ট্যাবলেটের চেয়ে ডিভাইসগুলোকে এগিয়ে রেখেছে। চাইলেই একসঙ্গে দুই থেকে তিনটি অ্যাপ স্ক্রিন স্প্লিটের মাধ্যমে চালানো সম্ভব। আইপ্যাডের জন্য, বিশেষ করে টাচস্ক্রিনের জন্য উপযোগী করে তৈরি মাইক্রোসফট অফিস ও অ্যাডবি অ্যাপগুলো ল্যাপটপের বেশির ভাগ কাজই সহজে করার সুবিধা দিয়ে থাকে। আইপ্যাডের সঙ্গে ব্যবহারের জন্য কি-বোর্ডগুলো চমৎকার এবং সবচেয়ে বড় ফিচার অ্যাপল পেন্সিল। অত্যন্ত কম লেটেন্সির স্টাইলাসটি আঁকাআঁকি করার জন্য অদ্বিতীয়।

অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেটের মধ্যে সেরা বলা যেতে পারে ‘গ্যালাক্সি ট্যাব এস৭ প্লাস’। সর্বশেষ ফ্ল্যাগশিপ প্রসেসর, প্রচুর র‌্যাম এবং বাজারের সেরা ডিসপ্লে-সংবলিত ডিভাইসগুলো ল্যাপটপের চেয়ে কোনো দিক দিয়ে কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, স্যামসাং ডেস্ক ইন্টারফেস ট্যাবলেটের মধ্যে একাধিক অ্যাপ একসঙ্গে চালানো খুবই সহজ। ট্যাবলেটের সঙ্গে থাকা কি-বোর্ড কাভার টাইপ করার জন্য খুবই কার্যকর, সঙ্গে আছে গ্যালাক্সি এস পেন ব্যবহার করে আঁকাআঁকি করার সুবিধা। সারফেস সিরিজের ডিভাইসগুলোর ব্যাপার আলাদা। ইন্টেল প্রসেসরচালিত ট্যাবলেটগুলো পূর্ণাঙ্গ উইন্ডোজ চালাতে সক্ষম। তাই চাইলে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সব সফটওয়্যার এতে চালানো সম্ভব। সঙ্গে আছে সারফেস পেন ব্যবহার করে ডিজাইন করার সুবিধা। সমস্যা একটিই, উইন্ডোজ টাচ ইন্টারফেসের জন্য ডিজাইন করা নয়। দিনশেষে ট্যাবলেট কিনতে হলে মাঝারি মূল্যের গ্যালাক্সি ট্যাব বা অ্যাপলের আইপ্যাডই সবার পছন্দের তালিকায় থাকা উচিত।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn