(সুনামগঞ্জের কোন মিডিয়া মুখ খোলার সাহস না পেলেও মুখ খুলেছে জাতিয় দৈনিক যুগান্তর। ‘কার্যাদেশ নিয়ে হরিলুট’ এ শিরোনাম নেসারুল হক খোকন, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে  লিখেছেন, ঘুরেফিরে প্রভাবশালী গ্রুপকে বড় বাঁধের ঠিকাদারি * যুবলীগ নেতা চপল ও সল্টুর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট কাজ পায় ৩২টি। ‘সুনামগঞ্জবার্তা ‘অনলাইন পাঠকদের জন্য তা প্রকাশ হলো।)

জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর। গত দুই বছরে এ হাওরে একাধিক বাঁধের ঠিকাদারি পেয়েছে মেসার্স নুর ট্রেডিং। গত দুই বছরেও প্রতিষ্ঠানটি এ বাঁধ নির্মাণ করতে পারেনি। এবার কাজ হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ দরপত্র মূল্যের অর্ধেকের বেশি (২৩ লাখ টাকা) বিল তুলে নেয়া হয়েছে। কারণ এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের সভাপতি খায়রুল হুদা চপল। এই চপল সজীব রঞ্জন দাস নামে আরেক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। গত দুই বছরে এ গ্রুপ ভাগিয়ে নিয়েছে ৩২টি বাঁধের কাজ। যার কোনোটিতেই ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি কাজ হয়নি। কিন্তু ঘুরে-ফিরে এরাই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্ব পেয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, তাহিরপুর উপজেলার হালির হাওর বাঁধ নির্মাণের কাজ পায় জেলা যুবলীগ নেতা সজীব রঞ্জন দাস। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে হালির হাওরে ১৫ শতাংশ কাজ করার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু তাকে বিল দেয়া হয়েছে ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ পাহাড়ি ঢল নামার প্রথম সপ্তাহেই এ হাওর তলিয়ে যায়। আর মাটিয়ান হাওরে হান্নান এন্টারপ্রাইজের নামে ৩০ ভাগ কাজ করার তথ্য উপস্থাপন করা হলেও এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেছেন, সেখানে বাস্তবে কোনো কাজই হয়নি। সেই হাওরটিও তলিয়ে গেছে। এই হান্নান মাটিয়ান হাওরের ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের আরেকটি বাঁধের কাজ নিয়ে এবার কোনো কাজই করেননি। অথচ বিল নিয়ে গেছেন ১৫ লাখ টাকা। গত দুই বছরেও এ কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি এই ঠিকাদার। মাটিয়ান হাওরের মেসার্স এম রহমান, এসআর ট্রেডিং ও মেসার্স আর আর ট্রেডিং নামে তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও তারা কোনো কাজই শুরু করেনি। অথচ চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বিল তুলে নিয়ে গেছে। হাওরটিতে এখন পানি আর পানি।

এদিকে তাহিরপুরের শনির হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের কাজ পান এলএন কন্সট্রাকশন। কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ১৫ পার্সেন্ট লেখা থাকলেও বাস্তবে এ ঠিকাদার ওই এলাকায়ই যাননি। অথচ তাকে ১৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে।

সরেজমিন বৃহস্পতিবার শনির হাওরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) বা কোনো ঠিকাদারের অস্তিত্ব নেই। দুর্গম ওই বাঁধ এলকায় কথা হয় ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মহিবুর রহমানের সঙ্গে। বাঁধ নির্মাণে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা পিআইসি সদস্যরা কাজ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো ঠিকাদারকে এক মুষ্ঠি মাটি ফেলতে দেখিনি। এখানে যারা বাঁধে মাটি ফেলছেন সবাই গ্রামের সাধারণ মানুষ। ফসল রক্ষার স্বার্থে গ্রামের যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে চাঁদা তুলে এ বাঁধ নির্মাণ করছে।’ এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘শনির হাওর, মাতিয়ান হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের কোথাও ঠিকাদার বা পিআইসির সদস্যরা কাজ করেনি। সব লুটপাট করা হয়েছে। অন্তিম মুহূর্তে আমি ব্যক্তিগতভাবে এলাকার সাধারণ মানুষের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ করছি।’ তরুণ এই উপজেলা চেয়ারম্যান পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসি সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

সরেজমিন দেখা যায়, শনির হাওরের পশের মাতিয়ান হাওর রক্ষাবাঁধ (একাংশ) সংস্কারের কাজ পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক টাঙ্গাইলের আফজাল হোসেন মাহবুব। তার লাইসেন্স নিয়ে সিলেটের আবদুল হান্নান ১৮শ’ মিটার বাঁধ নির্মাণে ২৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকায় কাজটি পান। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর তাকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। দরপত্র অনুযায়ী ১৭ মার্চ কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই হান্নান বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা তো দূরের কথা, শুরুই করেননি। এর মধ্যে আকস্মিক পাহাড়ি ঢল নামায় প্রথমেই এ হাওরটি তলিয়ে যায়। যেসব বাঁধে ঠিকাদাররা কোনো কাজই করেনি, এমন বেশ কিছু বাঁধে ৫০ থেকে ৮৫ ভাগ কাজ বাস্তবায়ন দেখিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়। অথচ সরেজমিন ওইসব বাঁধে সাধারণ কৃষককে কাজ করতে দেখা গেছে। পাউবোর সিলেট জোনাল অফিসে পাঠানো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর সর্বশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে মিথ্যাচারের এমন চিত্র দাফতরিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের সঙ্গে আঁতাত করে চপল-সল্টু গ্রুপ সুনামগঞ্জের ঠিকাদারি মহলে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। গত বছর কাজ করে এবারও জেলার বড় বড় হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদারি তারাই পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারি লাইসেন্সের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন নামে অংশ নিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেয় তারা। এর প্রমাণ মেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামের পাশে থাকা মোবাইল ফোন নম্বরে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের পঠানো অগ্রগতি প্রতিবেদনে ঠিকাদারদের নামের পাশে ০১৭১৪০০১৯০৩ নম্বরটি দেয়া হয়। মেসার্স খন্দকার শাহীন এন্টারপ্রাইজ, সজীব রঞ্জন দাস ও খায়রুল হুদা চপলের নুর এন্টারপ্রাইজের পাশেও রয়েছে এ মোবাইল ফোন নম্বরটি। এতেই প্রমাণিত হয়, যুবলীগের এ নেতার সিন্ডিকেট ঠিকাদারিতে সক্রিয়।

পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘জেলা যুবলীগ নেতা খায়রুল হুদা চপল, সজীব রঞ্জন দাস সল্টু, যুবলীগ নেতা আতিকুর রহমান. বাবলু, সেন্টু তালুকদার ও দীপ্ত তালুকদার টিটুসহ কয়েকজন মিলে বিভিন্ন ঠিকাদারদের নামে টেন্ডার জমা দিয়ে কাজ নিয়ে যান। এরপর চাহিদা অনুযায়ী কাজ না করে বিল নিতে চান। কিন্তু কাজ না করে বিল নেয়ার চেষ্টা করলেই এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।’ তিনি বলেন, ‘গত ২১ মার্চ প্রভাবশালী এসব ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা হাওরের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছি।’ যুগান্তরের কাছে ওই প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন হাওরের ২৩টি বাঁধকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ৮টি বাঁধে কোনো কাজই হয়নি। ১৭টি বাঁধের কাজ পেয়েছেন চপল-সল্টু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত সজীব রঞ্জন দাস, খন্দকার শাহীন এন্টারপ্রাইজ, আতিকুর রহমান। এ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের ঠিকাদাররা হলেন- জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদার জেলা যুবলীগ সভাপতি খায়রুল হুদা চপলের নুর ট্রেডিং, ধানকুনিয়া হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদার পার্থসারথি পুরকায়স্থ পরিচালিত এলএন কন্সট্রাকশন, শাল্লার ছায়ার হাওর ও ধর্মপাশার চন্দ্রসোনা থাই হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদার সজীব রঞ্জন দাস, আতিকুর রহমান, টেকবে ইন্টারন্যাশনাল, দিরাইয়ের বান্ডাবিল হাওরের ঠিকাদার শোয়েব এন্টারপ্রাইজ, তাহিরপুরের মাতিয়ান হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদার মেসার্স গুডম্যান এন্টাপ্রাইজ, সুনামগঞ্জ সদরের দেখার হাওর রক্ষাবাঁধের ঠিকাদার মেসার্স খন্দকার শাহীন। ঝুঁকিপূর্ণ এ ২৩টি বাঁধের মধ্যে সজীব রঞ্জন সল্টুর নিজ নামেই আছে চারটি বড় বাঁধের কাজ। এর মধ্যে ধর্মপাশার চন্দ্রসোনার থাই বাঁধে মাটি ফেলা হয়, ২০ পার্সেন্ট। কাজটি ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার। সল্টুর নামে দেড় কোটি টাকা মূল্যের নলুয়ার হাওর রক্ষাবাঁধের আরেকটি ঠিকদারি নিয়ে মাটি ফেলা হয় মাত্র ১৫ পার্সেন্ট। তাহিরপুরের গুরমার হাওরে সাড়ে ৯৫ লাখ টাকার বাঁধের কাজ নিয়ে কোনো কাজই করেননি এই সল্টু। নলুয়ার হাওরে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার একটি বাঁধে খায়রুল হুদা চপল মাটি ফেলেছেন মাত্র ১০ পার্সেন্ট। জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকায় চপল ও সল্টুর নিয়ন্ত্রণে থাকা শাহীন এন্টারপ্রাইজের নামেই রয়েছে ৭টি কাজ। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেসার্স শাহীন এন্টারপ্রাইজের নামে দেখার হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কাজ নিয়ে মাটি ফেলা হয় মাত্র ১০ পার্সেন্ট। নাইন্দার হাওর, খাই হাওর, মাতিয়ান হাওর ও টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতিরক্ষা ৫টি বাঁধের ঠিকাদারি নিয়ে কোনো কাজই করেনি এই শাহীন এন্টারপ্রাইজ। এ ৫টি কাজের চুক্তিমূল্য সাড়ে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। বাস্তবে ঠিকাদারি নিলেও কাজ না করেই বিল তুলে নেয়ার অপেক্ষায় থাকে এসব ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। এ প্রভাবশালী ঠিকাদারদের সহযোগিতা করে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন পাউবোর কর্মকর্তারা। ব্যক্তি হিসেবে তারা লাভবান হলেও দেশের হাজার হাজার একর জমির ধান আজ পানির নিচে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক।

অভিযোগের বিষয়ে খায়রুল হুদা চপলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তার পারিবারিক একটি সূত্র জানায়, তিনি ভারতে আছেন। আর সজীব রঞ্জন দাস সল্টু যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার নামে ৭টি কাজের কার্যাদেশ আছে। শাহীন খন্দকারের নামে যে ঠিকাদারি লাইসেন্স আছে সেটি হয়তো শাহীন নিজেই পরিচালনা করেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনও কয়েকটি কাজের কার্যাদেশই পাইনি। তাহলে কাজ শুরু করব কীভাবে। আমি কোনো সিন্ডিকেট করিনি।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn