মুহাম্মদ আব্দুল হাইকে যেমন দেখেছি-সুজাত আহমদ চৌধুরী
সুজাত আহমদ চৌধুরী- সবেমাত্র কলেজে পদার্পন করেছি। একজন যুবকের মন যেমনিভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে ঠিক তেমনিভাবেই আমার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। পূর্ব বাংলার জনগণ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, পশ্চিমা শাসকদের রোষানলে পড়া পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বঙ্গবন্ধু আপোষহীন ছয়দফা উত্থাপন করেন। ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। আমি ছয়দফা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হয়ে উঠি। সুনামগঞ্জে এ সময় আওয়ামী লীগের দুর্দিন চলছিল। রাজনৈতিক মঞ্চে আওয়ামী লীগের কোন কর্মকান্ড দেখা যেত না। আইয়ুব খানের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে ছয়দফার পক্ষে কোন সভা-সমাবেশ করার মতো সাহসী নেতৃত্ব দেখা যায়নি। আকমল আলী মোক্তার ও আব্দুল হাই চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘোর সমর্থক ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তবে তারা উভয়ে প্রকাশ্যে রাজপথে না আসলেও নেপথ্যে কাজ করছিলেন।
আমি একজন নবাগত কলেজ ছাত্র। রাজনীতি পুরোপুরিভাবে না বুঝলেও এ কথা বুঝতে পারতাম যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বলছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা দাবি সাধারণ মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করেছে। একদিন সহকর্মী নূরুজ্জামান শাহীকে নিয়ে আব্দুল হাই চৌধুরীর বাসায় গেলাম। আরপিননগরের বাসভবনে পেয়ে গেলাম। শাহী ঊনার ভাগিনা । আলাপ ও পরিচয় হতে সময় লাগেনি। অনেকক্ষণ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে নীরবতা পালন করছেন। তার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ও ছয়দফা। নানা কারণে প্রকাশ্যে রাজপথে আন্দোলন করতে পারছেন না। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বললেন যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে আন্দালনকে খুবই চাঙ্গা করে তুলেছিলেন।
তিনি আমাকে জানালেন যে, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার নির্বাচনে জয়লাভ করার পিছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন। এ সময় তিনি সক্রিয় রাজনীতি করতেন। জেল খেটেছেন। পুলিশ অনেক নির্যাতন করেছিল তার উপর; কিন্তু আন্দোলন থেকে তিনি সরে যান নি। তিনি অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও মার্জিত ভাষায় কথা বলতেন। রাজনীতিতে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলেই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন। পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য নিয়ে কথা বলতেন। সাক্ষাতে বুঝতে পারলাম যে, তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যক্তি। আমার খুবই ভাল লাগলো তার সাথে আলাপ করে। এতে ছাত্রলীগ গড়ে তোলার আগ্রহ আমার বৃদ্ধি পায়। তিনি আমাকে বললেন যে, এখনতো তোমরা যুবক। দেশে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শ্রম দিতে পারো, তোমাদের কোন অসুবিধা নেই। তার সাথে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ছয়দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রচারের কাজে লেগে যাই। সুনামগঞ্জের দেয়ালে দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ছয়দফা বাস্তবায়নের দাবি লিখন শুরু করি।
১৯৬৭ সালের শেষদিকে আব্দুল হাই চৌধুরী আমাকে বললেন, তুমি সব কটি থানায় গিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন শুরু করো এবং ধর্মপাশায় গিয়ে আব্দুল হেকিম চৌধুরীর সাথে দেখা করে এসো। তার পরামর্শ আমার কাছে খুব ভাল লাগলো। আব্দুল হেকিম চৌধুরীর সাথে আলাপ করলাম। এদিন তার ওখানে রাত্রিযাপন করলাম। পরদিন গঠন করলাম ধর্মপাশা থানা ছাত্রলীগের কমিটি। সুনামগঞ্জ এসে আব্দুল হাই চৌধুরীর সাথে আবার দেখা করলাম। এছাড়া আকমল আলী মোক্তারের বাসায় ঘনঘন যাওয়া আসা করতে লাগলাম। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে সুনামগঞ্জ শহরে ৪/৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী সৃষ্টি হয়। শহরে ছাত্রলীগ নামে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলতে থাকে। তখন সুনামগঞ্জে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ খুবই শক্তিশালী। মুসলিম লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ছিলেন আবু হানিফা আহমদ ও আব্দুল খালিক। তারা আমাদের কোন ক্ষতি করেননি। তাদের আচার-আচরণের সাথে মোনায়েম খার আচরণের বিরাট পার্থক্য ছিল। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১দফা দাবি আদায়ের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আব্দুল হাই চৌধুরী সে সময় আমাকে অনেক সময় পরামর্শ দিয়েছেন। এ আন্দোলনের সময় মুজিবুর রহমান চৌধুরী, প্রবোধ দাস, মখলিছুর রহমান নূরুজ্জামান শাহী ,তালেব আহমদ প্রমুখ সাংগঠনিক কাজে তৎপর ছিলেন। রাজপথে আন্দোলনে আমরা ছিলাম খুবই সক্রিয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের পক্ষে আওয়ামীলীগের সাথে ন্যাপ কেউকেউ বেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর আব্দুল হাই চৌধুরী আমাকে সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্টের সামনে পেয়ে বললেন যে, তোমাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে সুনামগঞ্জ এলেন। দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর বাসভবনে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। এ সময় দেখলাম বঙ্গবন্ধু আব্দুল হাই চৌধুরীকে নাম ধরে ডাকলেন। আমার ধারণা হলো যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে খুবই পরিচিত ব্যক্তি। এ সময় আমি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে নিশ্চিত হলাম যে, তিনি যাকে একবার দেখেন তাকে কোন দিন ভুলেন না। আব্দুল হাই চৌধুরীর সাথে বঙ্গবন্ধুর বহুদিন পরে দেখা হলো। এরপরও বঙ্গবন্ধু তাকে নাম ধরে ডাকলেন। অবাক হয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর স্মরণ শক্তি দেখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আব্দুল হাই চৌধুরী সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে মানুষের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেন। সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে আব্দুল হাই চৌধুরীর অবদান কম নয়। মূলতঃ তিনি আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই এ রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে অসহযোগ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল বিরাট। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবেও তার অবদান কম নয়। রাজনীতিতে দেখেছি, শিক্ষকতা জীবনেও তাকে দেখেছি, তিনি প্রকৃত পক্ষে একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বহুদিন তার সংস্পর্শে গিয়েছি। নীতিবান আদর্শবান হিসেবে আজীবন আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে ছিলেন। তার সাথে সে সময়ও আমি ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখি। শরণার্থী শিবিরে তিনি অনেক জনসেবামূলক কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। ন্যাপ নেতৃবৃন্দ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রসূন কান্তি রায়ের(বরুন রায়) সাথে আব্দুল হাই চৌধুরীর ছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক। সুনামগঞ্জে রাজনীতির পুরোধা হিসেবে খ্যাত বরুন রায়ের প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাবান ছিলাম। বরুন রায় ও আব্দুল হাই বিবেকের মহা নিদর্শন হিসেবে মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমি আমার ছাত্র রাজনীতির শুরু থেকে আব্দুল হাই চৌধুরীর অতি ঘনিষ্ঠজন ছিলাম। আমার দৃষ্টিতে নির্লোভ বলেই বিবেচিত হবেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে তার অনেক সুনাম আছে। তিনি এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন উঁচু মাপের একজন পন্ডিত। সুনামগঞ্জ শহরে পারিবারিক ভাবেও তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। আমি কোনদিন শুনিনি তার বিরুদ্ধে কাউকে কিছু বলতে। সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, সৎ লোকের কোন শত্র“ থাকে না। নিবেদিত প্রাণের এই রাজনীতিক-শিক্ষক মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন সারাজীবন। তিনি নিজে বাজার করতেন। অহমিকা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। শিক্ষা-দীক্ষা-পরিবেশের দিক থেকে তার সমসাময়িক অনেকের অভিলাস দেখেছি; কিন্তু তিনি এ ধরনের চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে ছিলেন।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে ফিরে আসার কয়েকদিন পর আব্দুল হাই চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আমি ঢাকা যাচ্ছি কিনা। আমি তাকে বললাম যে, আমি সপ্তাহখানেক পর দেখা করতে যাবো। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও এবং বঙ্গবন্ধুকে সুনামগঞ্জে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। তোমরা একটা প্রোগ্রাম করে ফেলো। তিনি জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার ইচ্ছা তার মধ্যে খুবই প্রবল হয়ে উঠেছে; কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও তিনি স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ কাজের চাপে কোথাও যেতে পারছেন না। অনেক রাজনীতিককে দেখেছি। অনেকেই সুবিধা মতে দলত্যাগ করেছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন; কিন্তু এই পন্ডিত ব্যক্তি মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভক্ত ছিলেন। মনেপ্রাণে একশ’ ভাগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও বঙ্গবন্ধু অনুসারী ছিলেন। আমার রাজনৈতিক জীবনে আব্দুল হাই চৌধুরীর মতো বিবেকবান ও সৎ চরিত্রের অধিকারী লোকের সংখ্যা খুব কম দেখেছি। তিনি যা ভাবতেন তা করতেন। পীর-মুর্শিদ ভক্ত ছিলেন। প্রকৃত আলেমদের প্রতি তিনি খুবই দুর্বল ছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তিনি খুবই হিসাব নিকাশ করে চলাফেরা করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অসা¤প্রদায়িক ও গণতন্ত্রমনা। তিনি কিছু চিহ্নিত ব্যক্তিকে পছন্দ করতেন না। গণতন্ত্রের পরিপন্থী কোন শাসনকে সমর্থন করেননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে তিনি সমর্থন করতেন। তার মত ছিল, সদস্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে কঠোর হতে হবে এবং কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন সেদিন দেখলাম তাকে খূবই উৎফুল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আজ আপনাকে এতো বেশি খুশি লাগছে কেন? তিনি সহাস্যে উত্তর দিলেন, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক কর্মসূচি খুব ভাল লেগেছে। তাই প্রাণ খুলে হাসছি। মিনিট দশেক পর আবার বললেন, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক কর্মসূচি তার মনে সংশয় সৃষ্টি করেছে। এধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদীরা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধুকে সুযোগ দেবেনা। বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে নিহত হবার পর তিনি আমাকে বললেন, তোমার স্মরণ আছে, আমার সেই কথাগুলো। তিনি আরো বললেন, আজ থেকে নেতৃত্ব শূন্য হলো বাংলাদেশ। এ দেশ পরিচালনা করতে বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। তিনিও এরপর আর বেশিদিন বেঁচে থাকেননি।
সুজাত আহমদ চৌধুরীঃ লেখক ও রাজনীতিবিদ। সুনামগঞ্জে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (সংগঠক হিসেবে মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের খুব কাছ থেকে দেখেছেন)