অনুভূতি এবং বাক স্বাধীনতা -তসলিমা নাসরিন
তসলিমা নাসরিন- লাখো মুসলমানের ঢল নেমেছিল ঢাকা শহরে। ভিডিওতে এ দৃশ্য দেখে আমি চমকে উঠলাম। ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক কয়েকটি মুসলিম দেশে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত বড় মিছিল আর কোনো দেশে হয়নি। যখন দেশে ছিলাম, মিছিল দেখেছি অনেক। কিন্তু এত বড় তো দেখিনি। দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে। অবশ্য সংখ্যায় বাড়া সরকারের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। সাধারণত প্রগতিশীল মানুষের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে, তাঁদের ফাঁসির দাবিতে, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল বের করত। কখনও দেখিনি সমাজের মঙ্গলের জন্য মিছিল বের করতে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, দারিদ্র্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদির প্রতিবাদ কখনও করতে দেখিনি। তারা শুধু ধর্মীয় অনুভূতির জন্য পথে নামে। তাদের ওই অনুভূতিতে যেন কখনও কোনও আঘাত না লাগে, এই হুমকি দিতেই নামে। মানুষের নানা অনুভূতিতে দিনভর আঘাত লাগছে, প্রাপ্ত-বয়স্ক মানুষ এসব আঘাত সামলে নিতে পারে। যারা অনুভূতিতে আঘাত লাগলে অন্যকে খুন করে, বা খুন করাকে সমর্থন করে, তাদের নিয়ে সমাজে সমস্যা হয়।
ফ্রান্সের পণ্য বাংলাদেশ বয়কট করলে ফ্রান্সের খুব হয়তো অর্থনৈতিক অসুবিধে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য ফ্রান্সে না রপ্তানি করলে কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। গার্মেন্টস ব্যবসায় ক্ষতি হলে বাংলাদেশের মানুষই ভুগবে। আর বাংলাদেশের মুসলমানদের যদি ফ্রান্স থেকে বর্জন করা হয়, তাহলে সমস্যা কি ফ্রান্সের হবে, নাকি বাংলাদেশি মুসলমানদের হবে? ফ্রান্সের কাছে অনেক সাহায্য সহযোগিতার জন্যই তো ঋণী বাংলাদেশ। ওদের রাগ দেখে মনে হচ্ছে, ওরা ফ্রান্সে তৈরি বাংলাদেশের স্যাটেলাইটকেও মহাকাশ থেকে নামিয়ে আনবে। নামিয়ে আনলে কার ক্ষতি? কার আর, বাংলাদেশের!
কূটনৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে সমস্যার সমাধানে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও করে কোনও সম্পর্ককে বন্ধুত্বপূর্ণ করা যায় না। ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা আর মত প্রকাশের অধিকার ওরা দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জন করেছে, ওদের এই মূল্যবান অর্জনকে কোনও মিছিল আর পণ্য বর্জনের হুমকি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আর মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার কোনও বালাই নেই। যেটা আছে, সেটা হলো ধর্মীয় অনুভূতি। অন্য হাজারও অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও এই ধর্মীয় অনুভূতি যেন অনন্তকাল অক্ষত অবস্থায় থাকে, তার গ্যারেন্টি চাই সবার। এই গ্যারেন্টি বাংলাদেশের সরকার দিয়েছে, কিছু প্রগতিশীল ব্যক্তি দিতে পারেনি বলে তাদের খুন করা হয়েছে এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
কেবল নিজের মত প্রকাশের অধিকারেই কিন্তু এরা বিশ্বাস করে। অন্যের মত প্রকাশের অধিকারে করে না। ফ্রান্সে তো কম জঙ্গি হামলা হয়নি এ পর্যন্ত। ফরাসিদের মনে হয় সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে। এক শিক্ষকের প্রাণও চলে যায় উন্মত্ত ধর্মান্ধের হাতে। প্রায় ৬০ লাখ মুসলমান বাস করে ফ্রান্সে। আমার তো ভয় হয়, যদি ফ্রান্স কখনও ঘোষণা করে দেয়, ৬০ লাখ মুসলমানকে তারা আর ফ্রান্সে থাকতে দেবে না, তবে? কোথায় যাবে এই ৬০ লাখ?
ফ্রান্স মুসলমানদের উপকার কি কম করেছে? জমজমের পানিতে নাইট্রেট, আর্সেনিক, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি পাওয়া গেছে বলে বিবিসির খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ফ্রান্সের কারসো-লেসেল ল্যাবই তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে যে জমজমের পানি নিরাপদ! ফ্রান্সের এই সার্টিফিকেট সৌদি আরবকে কতটা উপকার করেছিল, তা সৌদি আরবই ভালো জানে।
ফরাসি পণ্যের মধ্যে শুধু তো সুগন্ধি আর রূপচর্চার জিনিসপত্র নয়, অস্ত্রও পড়ে। মুসলিম দেশগুলো নিজেরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর, সুতরাং তাদের অস্ত্র চাই। কে কী কার্টুন ছাপিয়েছে, এতে কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, কোথায় আগুন লেগেছে, তারা থোড়াই পরোয়া করে। তারা মুসলিম হয়ে অন্য মুসলিমকে কী করে খুন করতে হয়, কী করে তাদের বাড়ি ঘর শহর গ্রাম ধ্বংস করে দিতে হয়, শিখে ফেলেছে। এটি করতে বোমা চাই, যুদ্ধ-বিমান চাই, আধুনিক সব অস্ত্র চাই। তখনই তো ফ্রান্স এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর দিকে হাত বাড়ায় তারা। পাশ্চাত্য যতই ইসলাম-বিরোধী হোক, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।
মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য নেই। কিছুদিন আগে কিছু মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সৌদি আরব তার তেলের ব্যবসার স্বার্থে মুসলিম-বিরোধী শক্তিকে আলিঙ্গন করতে কোনও আপত্তি করে না। জ্বালাও-পোড়াও শুধু গরিব মুসলমানের আবেগ। যেটিকে পাশ্চাত্য কেন, ধনী মুসলিম দেশই প্রশ্রয় দেয় না। মুসলমানরা কিন্তু অমুসলিমদের পাশ্চাত্যে বাস করে বেশি মর্যাদা এবং সম্মান পায়, মুসলিম দেশে বাস করে সেটা পায় না। সৌদি আরবে কত গরিব মুসলিমকে নির্যাতিত হতে হয়। কত বাংলাদেশের নারী শ্রমিককে ধর্ষিতা হয়ে ফিরতে হয়েছে তা কি গুনে শেষ করা যাবে!
মুসলিমদের কোনও ঐক্য নেই। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই মিথ্যে কথা। সাধারণ মুসলিম জনতাকে কারা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করে? মুসলিম-দেশগুলোর মুসলিম সরকার। সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ঘোচানো, তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা, তাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কোনও কাজই সরকার করে না। তারা শুধু জনতাকে ধর্মান্ধ বানানোর সব রকম ব্যবস্থা করে দেয়। এতে খরচ কম, পরিশ্রম কম। পঙ্গপালের মতো মূর্খ জনতার জন্ম হতে থাকে, আর সরকার ব্যস্ত আখের গোছাতে। দেশের সম্পদ লুট করে দেশের সর্বনাশ করতে ক্ষমতাসীন লোকদের জুড়ি নেই। মুসলিমদের ধর্মান্ধ করে গড়ে তোলা সহজ। মুসলিমদের সভ্য শিক্ষিত সচেতন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি কঠিন। এই কঠিন কাজটি কোনও সরকারই করতে চায় না। অথচ এটিই সবচেয়ে জরুরি। মুসলিম জঙ্গিরা যেদিন থেকে ধর্মের নামে আর মানুষ খুন করবে না, সেদিন থেকে সাধারণ মুসলিমদের সমস্যা হবে না পৃথিবীতে। তাদের কেউ ঘৃণা করবে না, তাদের কেউ ভয় পাবে না।
২০০ কোটি লোক পৃথিবীতে মুসলমান। দিন দিন এই সংখ্যাটি বাড়ছে। এই ধর্ম নিয়ে গেল গেল রব তোলার কোনও অর্থ হয় না। মুসলমানরা যত গভীরভাবে ধর্মে বিশ্বাস করে, সেরকম গভীরভাবে অমুসলিমরা তাদের ধর্মে বিশ্বাস করে না। ইহুদি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। সুতরাং ধর্ম টিকে থাকলে ইসলামই টিকে থাকবে। এই ধর্মই সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াবে। কিন্তু এতেই কি ধর্মের সার্থকতা? কোনও ধর্মকে ভালোবেসে যদি মানুষ তার উদারতা, স্বার্থহীনতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি গুণগুলো নষ্ট করে ফেলে, তবে কি তা ভালো লক্ষণ? নিশ্চয়ই শুভবুদ্ধির মানুষেরা রাজনৈতিক ইসলাম চায় না, চায় উদারনৈতিক ইসলাম।-লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।