বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
নূরে আলম জিকু–করোনার কারণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয় বা বিদ্যালয়-পূর্ব উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন চরম বিপর্যয়ের মুখে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন, প্রি-প্রাইমারি, প্রি-ক্যাডেট ও প্রিপারেটরি স্কুলগুলোর প্রায় ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। করোনায় গত ৭ মাসে ৫ শতাধিক কিন্ডারগার্টেন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। বন্ধের পথে আরো সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেকার হয়েছেন কয়েক লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। অনেকেই শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
কেউ কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।
রাজধানীর পূর্ব ধোলাইরপাড় ১নং গলিতে ভাড়া বাসায় গড়ে উঠেছে হলিহার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই এখানে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন। করোনাকালীন সময় স্কুল ভবনের ভাড়া মেটাতে না পেরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষক মো. হানিফের সঙ্গে কথা হলে তিনি মানবজমিনকে জানান, পড়াশোনা শেষ করে কোথাও চাকরি হয়নি তার। বেকার থাকার চাইতে কিছু করার চিন্তা থেকে কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু থেকে ভালোই চলেছিল। ৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬ জন শিক্ষকও নিয়োগ করেন। বিদ্যালয়ের টিউশন ফি থেকে বাড়ি ভাড়া ও শিক্ষদের বেতন দিতেন। গত ৭ মাস বিদ্যালয় বন্ধ। এখন বাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই তার। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাধ্য হয়ে কিন্ডারগার্টেনটি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন পেশা বদল করে গার্মেন্টে কাজ করি। মুগদা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মারুফ মানবজমিনকে জানান, ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছিলাম। আমার প্রতিষ্ঠানে ২ শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত ছিল। ১৭ জন শিক্ষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিবছর ফলাফল ভালো হতো। করোনার কারণে আমি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি। এখনো ভবন ভাড়া বাকি আছে। ভাড়া পরিশোধ করতে এখন দোকান করি। দোকানের আয় দিয়ে বিগত মাসগুলোর ভাড়া শোধ করছি। হলিহার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও মুগদা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো সারা দেশে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেনের একই চিত্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফি ছাড়া আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই। শিক্ষকরা অল্প বেতনে চাকরি করেন। শিক্ষকদের আয়ের আরেকটি উৎস টিউশনি। করোনার কারণে সবই বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল মালিকও পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করেছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে কিন্ডারগার্টেন, প্রি-প্রাইমারি, প্রি-ক্যাডেট ও প্রিপারেটরি পর্যায়ে ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার বেশির ভাগই ঢাকায় অবস্থিত। রাজধানীতে শিশু শিক্ষার্থীদের তুলনায় সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক কম। যার ফলে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠান। ৯০ শতাংশ স্কুলই ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত। বিদ্যালয়ের ন্যূনতম ব্যয় ও টিউশন ফি থেকেই বাড়ি ভাড়া মেটানো হয়। সারা দেশে ১০ লক্ষাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। চলতি বছরের ১৭ই মার্চ থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মার্চ মাসের বেতন পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের নোটিশ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারি মাসেরও বেতন তুলতে পারেনি। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বাড়ি ভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। কেউ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউবা বিক্রি করে দিয়েছেন স্বপ্নের বিদ্যালয়টি।
কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে সারা দেশে অর্ধলক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শিশুদেরকে আদর্শ মানুষ গড়তে নিরলসভাবে কাজ করেছে। ফলাফলও ভালো করেছে। ফলে শিক্ষার মান দিনদিন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে করোনার থাবায় সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এরই মধ্যে দেশের বহু কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে আরো প্রায় কয়েক হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও এইচএসসি পরীক্ষা চলতি বছর না নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষাও চলতি বছর নেয়া হবে না। এতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো আরো বেশি সমস্যায় পড়ছে। যার কারণে বকেয়া টিউশন ফি আদায় হবে না। চলতি বছরে বার্ষিক পরীক্ষা হবে এমন আশায় ক্ষতির মুখে পড়েও অনেক প্রতিষ্ঠান এতোদিন টিকে ছিল। এখন সেসব প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকরা সাড়া দিচ্ছেন না।
চেরী গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডলি ইয়াসমিন বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় কোনো অভিভাবক মাসিক বেতন দেয়নি। করোনাকালীন সময়ও বাড়িওয়ালা ভাড়া কমাননি। শিক্ষকদের নিয়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। দিন দিন দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। পরিবারের সঞ্চয় করা টাকা থেকে স্কুল ভবনের ভাড়া দিয়ে আসছি। এভাবে স্কুল বন্ধ থাকলে প্রতিষ্ঠান বাঁচানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা অন্যত্র চলে যাবে। বহু শিক্ষার্থী ঝরে যাবে। এমন অবস্থায় সরকার আমাদের সাহায্য না করলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। রামপুরা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুল শিক্ষকরা খুব কষ্টে দিন পার করছেন। কতটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কেউ অনুমানও করতে পারবে না। মার্চ মাস থেকেই এখনো কোথাও কাজ পাইনি। সঞ্চয়ের অর্থ ভেঙে এখন সংসার চালাচ্ছি। কোথাও থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। স্কুলের চেয়ার টেবিল বিক্রি করছেন অনেকেই। এ বছর স্কুল না খুললে গ্রামে ফিরে যেতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত স্থায়ীভাবেবন্ধ হয়ে গেছে ৫ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাকালীন সময় অনলাইনে অংশগ্রহণ করেছে ১০ ভাগ শিক্ষার্থী। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার অনলাইন সিস্টেম সম্পর্কে প্রাথমিক কোনো ধারণা না থাকায় ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা কমছে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক অভিভাবক গ্রামে চলে গেছেন। এতে অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে মহা আর্থিক সংকটে পতিত স্কুলগুলো। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান সরকার মানবজমিনকে বলেন, অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালামাল বিক্রি করে দিয়ে পেশা বদল করেছেন। অনেকই বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনজন শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া ১১ জন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো টিউশন ফি পাচ্ছে না। শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলে দিলে সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
আবার বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্যপরিষদ আন্দোলন করে আসছে স্কুল খুলে দিতে। তারা বলছেন, তাদের প্রণোদনা দেয়া হোক নয়তো স্কুল খুলে দেয়া হোক। এই দাবির প্রেক্ষিতে আদালতে যাবার পরিকল্পনাও করছেন তারা। এই পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, সব খুলে দেয়া হলো। কোনো শিক্ষার্থী ঘরে নেই। শিশু পার্ক খোলা, কওমি মাদ্রাসা খোলা তবে কিন্ডারগার্টেন কেন বন্ধ রাখা হচ্ছে। যদি বন্ধ রাখাই হয় তবে আমাদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হোক। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল হোসেন মানবজমিনকে বলন, কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। যদি কোনো কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আগেই আমার একটি নোটিশ করেছি, আমাদের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যেন তাদেরকে ভর্তি নেয়া হয়। সারা দেশে পর্যাপ্ত প্রাইমারি স্কুল আছে। রাজধানী ঢাকাতেও ২৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার্থীরা সেসব স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। যেসব শিক্ষার্থীরা গ্রামে চলে গেছে তারা কাছাকাছি সরকারি স্কুলে টিসি ছাড়া ভর্তি হতে পারবে।